Loading..

খবর-দার

১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০৮:২৯ অপরাহ্ণ

প্রাথমিকে অনুপস্থিত ২০, মাধ্যমিকে ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী

টানা দেড় বছরের ছুটি শেষে ১২ সেপ্টেম্বর খুলেছে স্কুল-কলেজ। পাঁচদিন ক্লাস শেষে মাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উপস্থিতি পাওয়া গেছে ৯২ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত রয়েছে। তাদের খোঁজ মিলছে না। এসব শিক্ষার্থীর ঝরেপড়ার আশঙ্কা করছেন শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের ‘যেকোন’ মূল্যে স্কুলে ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)।

মাধ্যমিকের তুলনায় প্রাথমিক শিক্ষায় অনুপস্থিতি বেশি। প্রাথমিকে এখন পর্যন্ত ২০ শতাংশ শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থীর ঝরেপড়ার আশঙ্কা করছেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) কর্মকর্তারা। ডিপিই’র আওতায় সারাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার দেখা গেছে ৮০ শতাংশেরও কম। শনিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রাকিব উদ্দিন। 

প্রতিবেদনে আরও জানা যায় কায়সার আলম গত বছর ঢাকার মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। এবার কায়সার আর স্কুলে যায়নি। খোঁজ নিয়ে যোগাযোগ করা হলে কায়সারের বাবা কায়সার রশিদ বলেন, ‘একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতাম। করোনা মহামারীতে প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে গেছে। এজন্য হবিগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছি। চাকরি বা ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারলে ছেলেকে এখানেই কোন একটি স্কুলে ভর্তি করাবো।’

করোনা সংক্রমণের কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। গত ১২ সেপ্টেম্বর প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছে। টানা দেড় বছর বন্ধ থাকায় এই দুই স্তরে শিক্ষার্থীর প্রকৃত তথ্য নেই শিক্ষা প্রশাসনের কাছে।

সর্বশেষ গত বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থী ছিল চার কোটি ২৭ লাখ ৫২ হাজার ১৫৮ জন। এর মধ্যে মাধ্যমিক স্তরে (মাদ্রাসাসহ) শিক্ষার্থী ছিল এক কোটি ৮৫ লাখ ৭৪ হাজার ২৬৬ জন। আর প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী ছিল দুই কোটি ৪১ লাখ ৭৭ হাজার ৮৯২ জন।

সাধারণত বছরে গড়ে ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পায়-এমনটি ধরে নিয়ে প্রতিবছর বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক ছাপে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। কিন্তু এবার সংস্থাটি প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীর সঠিক সংখ্যা এখন পর্যন্ত পায়নি।

আর মাউশি কর্তৃপক্ষ মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপার জন্য গত বছরের শিক্ষার্থীর তথ্যই এনসিটিবিকে দিয়েছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়েনি। তবে প্রাথমিকের বই এবার কমছে। এতে শিক্ষার্থী কমছে- এমনটি ধরে নেয়া হচ্ছে। ডিপিই কর্তৃপক্ষও গত বছরের শিক্ষার্থীর তথ্য দিয়ে ২ শতাংশ পাঠ্যবই কম ছাপার চাহিদাপত্র দিয়েছে।

মাউশির মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন উইংয়ের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে মাউশির অধীনে ২৩ হাজার ৪১৬টি স্কুল-কলেজ রয়েছে। এর মধ্যে ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯ হাজার ৮৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মোট ৫০ লাখ ৫৭ হাজার ৬৫১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে উপস্থিত ছিল ৩০ লাখ ৪৮ হাজার ৭৪৩ জন। এ হিসেবে ওইদিন উপস্থিতির হার ছিল ৬০ দশমিক ২৭ শতাংশ।

৬০ দশমিক ২৭ শতাংশ উপস্থিতির হারের বিষয়ে জানতে চাইলে মাউশির মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন উইংয়ের পরিচালক প্রফেসর আমির হোসেন গতকাল বলেন, ‘কেউ একদিন এলে পরদিন আসেনি। আমরা এক সপ্তাহে গড়ে ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত পেয়েছি।’ অনুপস্থিত শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়েছে কীনা জানতে চাইলে মাউশি পরিচালক বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ৮ শতাংশ অনুপস্থিত রয়েছে। তাদের মধ্যে হয়তো ৫ শতাংশ ‘ড্রপ আউট’ হতে পারে।’

মাধ্যমিক স্তরে এক কোটি ৮৫ লাখ ৭৪ হাজার ২৬৬ জন শিক্ষার্থী ধরা হলে তাদের মধ্যে যদি ৮ শতাংশ অনুপস্থিত থাকে- এক্ষেত্রে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪ লাখ ৮৫ হাজার ৯৪১ জন। বিদ্যালয়ে না আসা শিক্ষার্থীদের ফেরাতে সারাদেশের মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের ইতোমধ্যেই নির্দেশনা দিয়েছে মাউশি কর্তৃপক্ষ।

স্কুলে অনুপস্থিত থাকা সব শিক্ষার্থীকে ফেরানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে জানিয়ে প্রফেসর আমির হোসেন বলেন, ‘সব শিক্ষার্থীর ঠিকানা স্কুলে রয়েছে। সেই অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠান প্রধানরা অভিভাবকদের সঙ্গে সরাসরি বা টেলিফোনে যোগাযোগ করছেন। কারোর আর্থিক সমস্যা থাকলে প্রতিষ্ঠান প্রধানকে দায়িত্ব নিতে বলা হয়েছে, প্রয়োজনে বেতন মওকুফ করা হবে, উপবৃত্তির ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। সব কিছুই সরকার বহন করবে।’

নারায়ণগঞ্জের একটি উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমি প্রতিদিন ন্যূনতম তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেছি। এতে দেখা গেছে, করোনা মহামারীতে দীর্ঘ ছুটির কারণে প্রতিটি বিদ্যালয়েই ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী কমেছে। আমি নিজে স্কুলে বসে খোঁজ নিয়ে দেখেছি, স্কুল কর্তৃপক্ষ কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে একেবারেই যোগাযোগ করতে পারছে না। অভিভাবকদের পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো তারা আর স্কুলে ফিরবে না।’

ঢাকার একটি থানার মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমি পাঁচদিনে ১৩টি স্কুল পরিদর্শন করেছি। শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার পেয়েছি ৮০ থেকে ৮৭ শতাংশ। করোনা মহামারীর আগে ঢাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উপস্থিতির হার এমনই ছিল।’

বিদ্যালয় পরিদর্শনের সময় নতুন কী কী সমস্যা পাওয়া যাচ্ছে- জানতে চাইলে মাউশির পরিচালক আমির হোসেন বলেন, ‘আমরা টানা দুইমাস পরিদর্শন অব্যাহত রাখব। এতে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সমস্যা চিহ্নিত করা হচ্ছে, একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সমস্যাও দেখা হচ্ছে। পরিদর্শন শেষে প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হবে। সেই আলোকেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিতে পারবে।’

প্রাথমিকে সাড়ে ৪৮ লাখ শিক্ষার্থীর খোঁজ নেই

সারাদেশে মোট ৬৫ হাজার ৫৬৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। গত বছরের তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিক স্তরে মোট শিক্ষার্থী রয়েছে চার কোটি ২৭ লাখ ৫২ হাজার ১৫৮ জন। এর মধ্যে ন্যূনতম ২০ শতাংশ অনুপস্থিত থাকলে- এক্ষেত্রে বিদ্যালয়ে না আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৮ লাখ ৩৫ হাজার ৫৭৮ জন।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলম সম্প্রতি এক সভায় মন্ত্রণালয়ের সব কর্মকর্তাকে সারাদেশের মাঠ পর্যায়ের বিদ্যালয় পরির্দশনের নির্দেশ দিয়েছে। তিনি প্রতিটি বিদ্যালয়ের সমস্যা চিহ্নিত করার পাশাপাশি অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের খোঁজ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

ডিপিই থেকে জানা গেছে, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ১৪ সেপ্টেম্বর ৭৩ দশমিক ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্লাসে উপস্থিত ছিল। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৭০ দশমিক ২৭ শতাংশ, ময়মনসিংহ বিভাগে ৬৪ দশমিক ৫১ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৭১ দশমিক ৩৫ শতাংশ, খুলনায় ৮১ দশমিক ৪৬ শতাংশ, সিলেটে ৬৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ, বরিশালে ৭৬ দশমিক ২৯ শতাংশ, রাজশাহীতে ৭৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ ও রংপুর বিভাগে ৭৬ দশমিক ১১ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল।

রাজধানীর একটি থানার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিদ্যালয়ে না আসা শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের বেশিরভাগই একেবারে গ্রামে চলে গেছেন। অনেকের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা ঢাকায় আর না ফেরার কথা জানিয়েছেন।

জানতে চাইলে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার সহকারী উপজেলা শিক্ষা (প্রাথমিক) হাবীবুর রহমান বলেন, ‘আমার ক্লাস্টার হলো- হায়দরগঞ্জ, এখানে ১৯টি স্কুল আছে। এসব স্কুলে এখন পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থীদের ৭৮ থেকে ৮০ শতাংশ উপস্থিত পাওয়া গেছে। তবে উপজেলায় গড়ে উপস্থিতির হার ৮০ শতাংশ হবে।’

অনুপস্থিত শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়েছে কীনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটি এখনই বলা যাবে না। আমরা শিক্ষার্থীদের খুঁজছি, অভিভাবকদের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করছি। তবে দীর্ঘ অনুপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে অনেকের। আবার ৩-৪ শতাংশ ঝরে পড়তে পারে।’

এ ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লার তিনটি উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সব মিলিয়ে ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকছে; এই সংখ্যাটা কম নয়। কারণ গ্রামের বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এমনিতেই একে অপরের পরিচিত। শিশু শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফেরাতে নানাভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু আর্থিক সংকট, আয়-রোজগার কমে যাওয়া, কর্মসংস্থানের অভাবসহ নানা কারণে শিশুদের বিদ্যালয়ে ফেরানো ‘কঠিন’। অনেকেই বিদ্যালয়ে আসতে চাচ্ছে না। এই বিষয়ে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।