Loading..

খবর-দার

০৬ নভেম্বর, ২০২১ ০৪:০২ অপরাহ্ণ

মানস্মমত শিক্ষা ও উন্নয়ন ভাবনা

গুণগত শিক্ষা বা মানসম্মত শিক্ষা বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। এটি উন্নত বিশ্ব এবং উন্নয়নশীল বিশ্বেও শিক্ষাবিদদের মনোযোগ আকর্ষণ করে চলেছে। জাতিসংঘের শিক্ষাবিজ্ঞান  সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো টেকসই উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে গুণগত শিক্ষার ধারণা  গুরুত্ব বিশেষভাবে তুলে ধরেছে। ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছর সময়কে জাতিসংঘ শিক্ষা দশক হিসেবে গণ্য করে ইউনেস্কো গুণগত শিক্ষার লক্ষ্যউদ্দেশ্যউপাদান এবং কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করেছে। সংস্থাটি গুণগত শিক্ষাকে টেকসই উন্নয়নে শিক্ষার পূর্বশর্ত হিসেবে গণ্য করেছে। সবার জন্য শিক্ষা এবং সহস াব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা  আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অভীষ্ট ফলে গুণগত শিক্ষার বিকাশ ঘটতে পারে বলে অনেকে মত প্রকাশ করেন। এক্ষেত্রে ইউনেস্কো দ্বিমত পোষণ করে বলেছেশিক্ষার পরিমাণগত  গুণগত বিকাশ একই সঙ্গে ঘটতে পারে।

বর্তমান সরকারের আমলে গত দশকে বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষায় ছেলে   মেয়ে উভয়েরই অংশগ্রহণের হার অভূতপূর্বভাবে বেড়েছে এবং একই সঙ্গে বিদ্যালয়ের সংখ্যাও বেড়েছে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষাধারার সঙ্গে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাধারাও প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতি সাধনে এগিয়ে এসেছে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে বলা চলেবাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার পরিমাণগত বিকাশ অনেকখানি হয়েছে। তবে গুণগত তেমন উন্নয়ন ঘটেনি। গবেষণার ফলে প্রতীয়মান হয়েছেবাংলাদেশে পাঁচ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করার পরও ৩৬ শতাংশ মানুষ -সাক্ষর বা প্রাক-সাক্ষর থেকে যাচ্ছে। তাই বাংলাদেশে পাঁচ বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা যথেষ্ট নয় মন্তব্য করে বলা হয়েছে৮০ শতাংশ মানুষের টেকসই সাক্ষরতা দক্ষতা অর্জনে সবার জন্য বর্তমান মানের ছয়-সাত বছরের শিক্ষার প্রয়োজন। বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে প্রাথমিক স্তরে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম চালু করা হয়। পাঁচ বছরের শিক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা ৫৩টি প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন করবে’—এটি ছিল  শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য। ২০০২ সালে এটা পরিমার্জন করে ৫০টি প্রান্তিক যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছেঅধিকাংশ শিক্ষার্থীর এই যোগ্যতা অর্জনের মান অত্যন্ত হতাশাজনক। মাধ্যমিক শিক্ষার অবস্থাও প্রাথমিক শিক্ষার মতো। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমে বাড়লেও মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য  উদ্দেশ্য অর্জনে বাংলাদেশ দারুণভাবে পিছিয়ে রয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। বস্তুতপক্ষে সব স্তরের শিক্ষাতেই তাত্ত্বিক ধারা প্রাধান্য বিস্তার করছে। গুণগত শিক্ষা মূল্যায়নের সর্বজনীন কিছু নির্দেশক রয়েছে। এগুলোর ভিত্তিতে গুগণত শিক্ষা অর্জনে  টেকসইকরণে কিছু সাধারণ পূর্বশর্ত পূরণ প্রয়োজন। এগুলো হচ্ছে বৈষম্যহীন সমন্বিত শিক্ষাআধুনিক  আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাক্রমমানসম্মত  পেশার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ শিক্ষকসমাজপ্রয়োজনীয় সুযোগ দিয়ে মেধাবীদের শিক্ষকতায় এনে ধরে রাখাসন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গনদুর্নীতি নির্মূল  অপচয় রোধ এবং শিক্ষায় অধিক বিনিয়োগ। তবে শিক্ষার মান উন্নয়নে কতগুলো বিশেষ পূর্বশর্ত বিবেচনা অপরিহার্য। শর্তগুলো হচ্ছে শিক্ষকপ্রশিক্ষণব্যবস্থাপনাতত্ত্বাবধাননেতৃত্বশিক্ষাক্রমশিক্ষণ সামগ্রীমূল্য যাচাইশিক্ষানীতি   পরিকল্পনাবহিঃস্থ প্রশাসনঅর্থায়ন ইত্যাদি। এসব পূর্বশর্ত পূরণের ওপর নির্ভর করে গুণগত শিক্ষার মাত্রা।

গুণগত শিক্ষার অনেকগুলো অপরিহার্য পূর্বশর্তের মধ্যে একটি হচ্ছে অধিক বিনিয়োগ। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষা খাতে অর্থ বরাদ্দ অপর্যাপ্ত। একথাও অনস্বীকার্যবিভিন্ন সেক্টরের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ অনেক ক্ষেত্রেই সুষ্ঠু  সুচারুভাবে খরচ করা হয় নাযা অনভিপ্রেত  অনাকাঙ্ক্ষিত। বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে প্রকৃত বিনিয়োগ চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। সার্কভুক্ত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটে সামগ্রিক শিক্ষা খাতে বরাদ্দ মাত্র শূন্য দশমিক ৯২ শতাংশ এবং উচ্চশিক্ষা উপখাতে বরাদ্দ মাত্র শূন্য দশমিক ১২ শতাংশযা সার্কভুক্ত দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। উল্লেখ্যশ্রীলংকাপাকিস্তানভারত  নেপালে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ মোট জিডিপির তুলনায় যথাক্রমে  দশমিক    দশমিক  শতাংশ। উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বর্তমান জাতীয় বরাদ্দ শূন্য দশমিক ৯২ শতাংশ থেকে ক্রমান্বয়ে ২০২৬ সালের মধ্যে  শতাংশ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে  শতাংশে উন্নীত করা আবশ্যক। পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনের লক্ষ্যে শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের বর্তমান বরাদ্দ  শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশে উন্নীত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করাও জরুরি। ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের  শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। শিক্ষা মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রধানতম উপায় হলেও বাংলাদেশে শিক্ষায় অর্থায়ন এখনো হতাশাজনক। ইউনেস্কো গঠিত একবিংশ শতাব্দীর জন্য আন্তর্জাতিক শিক্ষা কমিশন তথা দেলরস কমিশন প্রতিবেদনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রাপ্ত বৈদেশিক সহায়তার ২৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে (১৯৯৭ সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করে বলা হয়েছেজাতীয় উন্নয়নের জন্য প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে মানবসম্পদের সার্বিক উন্নয়ন। জাতীয় উন্নয়ন অর্জন করতে হলে উৎপাদন শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য শিক্ষা  স্বাস্থ্য প্রধান উপাদান। বর্তমানে যে পরিমাণ অর্থ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হয়তা অপ্রতুল। শিক্ষা  স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু বার্ষিক বিনিয়োগের পরিমাণ বাংলাদেশে  ডলারশ্রীলংকায় ১০ ডলারভারতে ১৪ ডলারমালয়েশিয়ায় ১৫০ ডলার  দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৬০ ডলার।

গুণগত শিক্ষা কোনো একটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে অর্জনের আশা করা যায় না। এজন্য প্রয়োজন অনেকগুলো উপাদানের সমন্বিত এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনা  কর্মকাল্ড। গুণগত শিক্ষার জন্য যেসব উপাদানের যথাযথ সমন্বয় সাধন করতে হয়সেগুলো হচ্ছে আধুনিক  যুগোপযোগী শিক্ষাক্রমপর্যাপ্তসংখ্যক যোগ্য  প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকপ্রয়োজনীয় শিক্ষাদান সামগ্রী  ভৌত অবকাঠামোযথার্থ শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতিউপযুক্ত মূল্যায়ন পদ্ধতিধারাবাহিক পরিবীক্ষণ ইত্যাদি। শিক্ষার সব স্তরে গুণগত মান অর্জনের লক্ষ্যে নিম্নবর্ণিত সুপারিশগুলোর আলোকে পরিকল্পনা প্রণয়ন  নীতি নির্ধারণ করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সব স্তরে দক্ষতার মান কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নেই। এর বিপরীতে অপচয়ের হার কমিয়ে দক্ষতার মান বাড়াতে আমাদের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এই দক্ষতা  অপচয় রোধ করতে হবেযাতে মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে বর্তমান  ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সত্যিকারের মানবসম্পদে রূপান্তর করা যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে অভিভাবক  শিক্ষকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত এবং শিক্ষকশিক্ষার্থী  অভিভাবকের মধ্যকার সঠিক সহযোগিতার ক্ষেত্র বিস্তৃত করা আবশ্যক।

মূল্যায়ন  পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার সাধন করতে হবেযাতে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্বের সব দিক অর্থাৎ স্বাস্থ্যআচার-আচরণপ্রকাশভঙ্গিমূল্যবোধসৃজনশীলতা ইত্যাদি বিবেচিত হয় এবং তথ্য সংগ্রহকরণ কৌশল  বিশেষায়িত ফলাফলের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সম্ভব হয়।

সিলেবাসকে অযথা ভারাক্রান্ত না করে তা শিক্ষার্থীর চাহিদাবয়সমেধা  গ্রহণযোগ্যতা অনুযায়ী হওয়া উচিত। দেশের আর্থসামাজিক  রাজনৈতিক অবস্থাদীর্ঘদিনের লালিত ঐতিহ্যকৃষ্টিসংস্কৃতিধর্মীয় চেতনাবিশ্বাস এবং নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটিয়ে শিক্ষার্থীর জ্ঞানদক্ষতা  দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন যাতে হয়সেসব দিক বিবেচনায় রেখে পাঠ্যসূচি তৈরি করতে হবে এবং প্রয়োজনে বর্তমান পাঠ্যসূচি সংকোচন করতে হবে।

দুর্বল বা কম মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা কিংবা স্কুলে আলাদা কোচিংয়ের মাধ্যমে তাদের দুর্বলতা কাটিয়ে তোলার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সব শিক্ষার্থীর জন্য উপবৃত্তির বা বিশেষ বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের বিষয় নির্বাচন সম্পূর্ণভাবে অভিভাবকবিদ্যালয় বা শিক্ষকদের ইচ্ছা  পছন্দ মোতাবেক পরিচালিত  নিয়ন্ত্রিত। কোন শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে কী হতে চায় কিংবা কোন বিষয় নিয়ে পড়তে চায় বিষয়ে শিক্ষার্থীর পছন্দ বা মতামতকে প্রাধান্য দেয়া আবশ্যক। এতে তার পঠিতব্য বিষয় সম্পর্কে শ্রদ্ধা জাগবেফলে সে পাঠে মনোযোগী হবেশিক্ষা গ্রহণ করে পরিতৃপ্ত হবে এবং আশানুরূপ ফলাফল করবে;

গুণগত শিক্ষার জন্য যে উপাদানটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণতা হচ্ছে মানসম্পন্ন শিক্ষক। শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য ভালো শিক্ষাগত যোগ্যতার অধিকারী মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। সব শিক্ষকের জন্য বুনিয়াদি  বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাকর্মরত শিক্ষকদের জন্য কর্মকালীন প্রশিক্ষণ এবং প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সঞ্জীবনী কোর্সের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং একই সঙ্গে শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করতে অবশ্যই যথোপযুক্ত বেতন-ভাতা দিয়ে তাদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা  পেশাগত স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে।

সার্কভুক্ত ভারতশ্রীলংকা এবং উন্নত দেশের মতো শিক্ষকদের সঞ্জীবনী প্রশিক্ষণমেয়াদি/বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। শিক্ষক প্রশিক্ষণে সহপাঠক্রমিক কার্যক্রমের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।  মর্মে একটি নীতিমালা বা পরিপত্র জারি করা প্রয়োজন যে সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সব শিক্ষককে পেশাগত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে।