Loading..

খবর-দার

২১ নভেম্বর, ২০২১ ০৬:৪৬ অপরাহ্ণ

কেমন চলছে এসএসসি পরীক্ষা


করোনার কারণে গত বিশ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছিল নীরব কান্না। পরিস্থিতির উন্নতি হলে ১২ সেপ্টেম্বর সরকার সীমিত আকারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়। প্রাণ ফিরে আসে শিক্ষাঙ্গন এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে। সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এসএসসি পরীক্ষাও শুরু হয়েছে ১৪ নভেম্বর থেকে। দেশে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার আলাদা একটি গুরুত্ব রয়েছে। এটিই ছিল শিক্ষার্থীদের জীবনে প্রথম পাবলিক পরীক্ষা। পরে প্রাথমিক সমাপনী জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষা যুক্ত হলেও এসএসসি পরীক্ষাকেই মূল পাবলিক পরীক্ষা মনে করা হয়। এই পরীক্ষাকে বিবেচনা করা হয় উচ্চশিক্ষার প্রাথমিক সোপান হিসাবে। পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যে একটি আলাদা অনুভূতি কাজ করে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের পদচারণায় পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে থাকে উৎসবমুখর পরিবেশ। এবার পরীক্ষার সময় কিংবা বিষয় সংখ্যা বিবেচনার চেয়ে করোনায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে যে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছিল, তা ভেঙে বের হওয়াই ছিল মূল উদ্দেশ্য।

২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে মোট পরীক্ষার্থী বেড়েছে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৩৩৪ জন। এ বৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ। মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেড়েছে ১৫১টি আর কেন্দ্র বেড়েছে ১৬৭টি। এবার সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে শুধু তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে পরীক্ষা হচ্ছে। পরীক্ষার সময় দেড় ঘণ্টা। দেশে বেশ কয়েক বছর ধরে ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হতো। ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণ শুরুর আগেই এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়। করোনার কারণে দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এবার নয় মাস পিছিয়ে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার ত্রিশ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর অর্থ হচ্ছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই ফল প্রকাশিত হবে।

পরীক্ষার আগে একটি জাতীয় দৈনিকে খবর ছাপা হয়েছে, দেশের ৯ জেলায় করোনাকালের সংকটে সাড়ে সাত হাজার বাল্যবিবাহ সংঘটিত হয়েছে। দেশের ৬৪ জেলা ও নগর-শহরাঞ্চলে বস্তি এলাকায় এসব মিলিয়ে সারা দেশের বাল্যবিবাহ পরিস্থিতি কী ভয়াবহ, তা সহজেই অনুমান করা যায়। ইউনিসেফের তথ্যমতে, চলতি দশকের মধ্যে আরও এক কোটি কিশোরীর বাল্যবিয়ের নিদারুণ ঝুঁকিতে বাংলাদেশ।

ইউনিসেফ তথ্যমতে, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বাল্যবিয়েপীড়িত রাষ্ট্রগুলোর প্রথম ১০টির মধ্যে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে। ১৯৭০ সাল থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ দশকে এ দেশে বাল্যবিয়ে হয়েছে প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ। আগামী এক দশক ধরে চলা বাল্যবিবাহের শিকার হতে পারে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি কিশোরী। করোনাকালে দীর্ঘদিন দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। দেশের প্রান্তিক এলাকার প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

এ বছরের জানুয়ারিতে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) প্রকাশিত এক জরিপে বলা হয়, করোনা পরিস্থিতির আগে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০.৫ শতাংশ। করোনাকালে এই হার বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে অতি দারিদ্র্য। তিনগুণ বেড়ে এটি হয়েছে ২৮.৫ শতাংশ। ২০২০ সালের ২ নভেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত জরিপটি চালানো হয়। দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া আর স্কুলে শিক্ষার্থী না আসার মধ্যে একটি কো-রিলেশন বিদ্যমান। শিক্ষা খাতের সংশ্লিষ্ট নানা গবেষণায় দেখা যায়, স্বাভাবিক সময়েই প্রতি বছর প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগে প্রায় ১৭ শতাংশ ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করার আগে ৩৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। এর পেছনে অন্যতম কারণ দারিদ্র্য ও বাল্যবিয়ে।

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় পৌনে তিন কোটি এবং দেশে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটি। এরই মধ্যে এ বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, মহামারির কারণে বিশ্বে ৯৭ লাখ শিশুর হয়তো আর ক্লাসে ফেরা হবে না, যাদের অনেকে বাল্যবিয়ের শিকার হবে। জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ জুলাইয়ে এক গবেষণায় জানায়, কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বব্যাপী অন্তত চার কোটি শিশু স্কুল শুরুর আগে প্রারম্ভিক শৈশবকালীন শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত পরিবারগুলোয় মেয়েদের দ্রুত বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে লক্ষণীয় হারে। পাশাপাশি পরিবারের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেয়ে শিশুদের দিয়ে কায়িক পরিশ্রম করাতে বাধ্য হচ্ছে অনেক পরিবার। এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঝরে পড়া এবং বিদ্যালয়বিমুখ শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম হাতে নেওয়া উচিত।

শুধু নৈর্বাচনিক তিনটি বিষয়ের পরীক্ষা হচ্ছে; তারপরও পরীক্ষার প্রথম দিনেই ১৮ হাজার ৮২০ জন অনুপস্থিত ছিল। দ্বিতীয় দিন অনুপস্থিত ছিল ২৩ হাজার ৫৫৩ জন। এ ছাড়া অসদুপায় অবলম্বন করায় এদিন তিন পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আনন্দের মধ্যে আমাদের শিক্ষার বেদনাদায়ক দিক হচ্ছে এগুলো। পরীক্ষাগুলো হচ্ছে দেড় ঘণ্টার, কিন্তু প্রশ্নপত্রে লেখা ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট। এ বিষয়ে বোর্ড কর্তৃপক্ষ বলছে, এসব প্রশ্নপত্র ছাপা হয়েছিল আগেই; কিন্তু করোনা সংক্রমণ বিবেচনায় দেড় ঘণ্টা পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। দৃষ্টিহীন, সেরিব্রাল পালসিজনিক প্রতিবন্ধকতা ও হাত না থাকা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা শ্রুতি লেখককে সঙ্গে নিয়ে চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছে। এ ধরনের পরীক্ষার্থীদের ও শ্রবণ প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পরীক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত ১০ মিনিট সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। অটিজম, ডাইন সিনড্রোম, সেরিব্রাল পালসিজনিত প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত পরীক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত ২০ মিনিট সময় বাড়ানোসহ শিক্ষক-অভিভাবক বা সাহায্যকারীর বিশেষ সহায়তায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে মানবিক দিক, যার প্রতিফলন এ পরীক্ষায়ও দেখা যাচ্ছে। এভাবেই শত বাধা-বিপত্তির মধ্যেও মানুষের জীবন থেমে থাকে না। এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। সামনে এগিয়ে যাও স্নেহের পরীক্ষার্থীরা।