Loading..

ম্যাগাজিন

২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রসঙ্গ: ফলপ্রসূ শিক্ষাদান কৌশল ----মো. হুমায়ুন কবীর জেহাদী সহকারি শিক্ষক, রংপুর জিলা স্কুল, রংপুর

 

প্রসঙ্গ: ফলপ্রসূ শিক্ষাদান কৌশল

    ---মো. হুমায়ুন কবীর জেহাদী

       সহকারি শিক্ষক,

রংপুর জিলা স্কুল, রংপুর

 

ফলপ্রসূ শিক্ষাদানের ফল সবাই প্রত্যাশা করে। ভাল সনদ কিংবা সমৃদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী হলেই ভাল শিক্ষক হওয়া যায় না। যিনি কম জেনেও সে জানাটুকু সফলভাবে উপস্থাপন কিংবা অপরের চাহিদামত বোঝাতে পারেন, তিনিই মূলত সফলকাম। আমাদের দেশে একটি শ্রেণিতে বিচিত্র শিক্ষার্থীর অবস্থান। ফলে শিক্ষাদান কৌশল বেশিরভাগ সময়েই ফলপ্রসূ না হবারই কথা। এখানে মেধা ও সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে বিস্তর অসামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয় তাদের মাঝে। র্পূব থেকে স্থিরকৃত ট্রেনিংয়ের কলা কৌশল ক্লাসে নিয়ে সবসময় লাভবান হওয়া যায় না। তজ্জন্য শ্রেণির পরিবেশ পরিস্থিতির চাহিদা মাফিক তাৎক্ষণিকভাবে কৌশল নির্মাণ করতে হয়। এক্ষেত্রে একজন শিক্ষককে চৌকস হতে হয়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের ওপর শিক্ষাদান আমাদের শ্রেণিগুলোতে সম্ভব না হলেও মোটামোটিভাবে শিক্ষার্থীর মেধায় পৌঁছতে না পারলে শিক্ষক হিসেবে আমার গৌরবের কিছুই নেই। একজন শিক্ষক যেভাবে বুঝেন, একজন শিক্ষার্থী কিন্তু সেভাবে বুঝে না। আবার understanding power এর তারতম্য অনুযায়ী তাদের catching powerএরও তারতম্য হয়ে থাকে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক মাধ্যমিক শিক্ষার্থীর মেধায় নাও পৌঁছতে পারেন। এটা অস্বাভাবিক নয়। তাহলে শিক্ষার্থীরা যেভাবে বোঝতে চায়, সেই চাওয়াটা বোঝা কিংবা তাদের মেধায় শিক্ষকে নেমে আসা অতীব জরুরি। আর এ ক্ষেত্রে শ্রেণির প্রতিটি শিক্ষার্থীকে উত্তমরূপে জানা কিংবা বোঝার প্রয়োজনীয়তা কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আপনি যদি আপনার মেধা ও কৌশল বিচিত্ররূপে প্রয়োগ করে তাদের মেধায় নেমে আসতে পারেন, তাহলে দেখবেন শ্রেণি হবে প্রাণবন্ত, জ্ঞানাহরণের জন্য শিক্ষার্থীরা হবে উন্মুখ। পড়ায় আনন্দ পাবে, হাঁটাচলা শুরু হবে তাদের সৃজনশীলতার পথে। পাশাপাশি আপনার ব্যক্তিত্বকে তারা নিজেদের চরিত্রে রূপায়নের জন্য হবে সচেষ্ট। আমি বলতে চাচ্ছি, সফল পাঠদানের জন্য শিক্ষার্থীর মেধায় নেমে এসে তাদের বোঝার উপযোগী করে পাঠদান করাটা শিক্ষাদানের একটি বড় কৌশল।

একজন আদর্শ শিক্ষককে চৌকস হওয়া বাঞ্ছনীয়। Teaching is art. A Teacher must be an artist. একথা কারো অজানা নয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে তা যেন একেবারে কৃত্রিম না হয়। বিষয়টিকে মজ্জাগত বানাতে হবে। শ্রেণিতে শিক্ষকের অবস্থান হবে উদার। তাঁর দাঁড়ানো, হাঁটা-চলা, তাকানো, কথা বলা সব শিক্ষার্থীদের জন্য যেন সমভাবে হয়। আকাশের চাঁদকে হাজার লোক তাকালে প্রত্যেকই কিন্তু মনে করে চাঁদ শুধু তাকেই দেখছে। ঠিক প্রত্যেক শিক্ষার্থী যেন মনে করে স্যার তাকেই দেখছেন, তার সাথে কথা বলছেন, তার দিকে হাঁটাচলা করছেন। শিক্ষাবিজ্ঞানীরা মনে করেন: বোকারাই গালমন্দ আর বেতের শাসন করতে অভ্যস্থ। ঐ যে বলেছি শিক্ষককে চে্ৗকস হতে হবে। তিনি যদি ইচ্ছে করেন, শুধু চোখের শাসন দিয়ে গোটা ক্লাসকে পাঠে মনোযোগী করে তুলতে পারেন। বন্ধুরা! তাহলে আপনারাই বলুন, শিক্ষার্থী মনোযোগী করতে হলে শিক্ষককেই  শ্রেণিকক্ষে সর্বাগ্রে মনোযোগী ও সচেতন হতে হবে। মজার ব্যাপার হলো, আপনি যতই প্রস্তুতি নিন না কেন এ মনেোযোগের জন্য আবার শারীরিক সুস্থতা পূর্বশর্ত। সেজন্য শিক্ষক মাত্রেই উন্নত মনের অধিকারী হওয়ার পাশাপাশি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে। আপনি একটূ Recollect করে দেখুন তো, যেদিন আপনি অসুস্থ অবস্থায় পাঠ দিয়েছেন তা সুস্থ অবস্থার পাঠদানের সাথে সমমানসম্পন্ন কিনা। অবশ্যই না। তাই না? শিক্ষার্থীকে মনোযোগী করে তুলতে পারলে তারা উদগ্রীব হয়ে থাকবে আপনার পানে। এখন আপনাকে আরেকটু কাজ করতে হবে-তাহলো সহজতা সৃষ্টি। আপাতত: সহজ হতে হবে। এতে আপনি কিছু বললেই দেখবেন তারাও প্রশ্ন করছে আপনাকে। খেয়াল রাখবেন আপনার ক্লাশে যদি বিদ্যার্থীরা আপনাকে বেশি করে প্রশ্ন করছে-কখনো মেজাজ খারাপ করবেন না-মনে করবেন এটাই সূবর্ণ সুযোগ-তাদের বোঝাতে আপনি পারঙ্গম। তাদের বৌদ্ধিক বিকাশ হচ্ছে-আর তার মহানায়ক হলেন আপনি। তবে উত্তর দেয়ার সময় আপনাকে সহজ ভাষা অবলম্বন এবং সঠিক উত্তরটিই দিতে হবে। গোজামিল দিয়ে বোঝাতে যাবেন না। না পারলে পরে উত্তর দিবেন বলে জানাবেন। এরূপ অবস্থায় আপনি আসতে পারলে নি:সন্দেহে বুঝে নিবেন পাঠদান কাজে আপনি তাদের সম্পৃক্ত করে আগ্রহ সৃষ্টি করতে পেরেছেন। খেয়াল রাখবেন Education is a two-ways road. অর্থাৎ “শিক্ষা একটি দ্বিমুখী রাস্তা।” একটি রাস্তা হলো--আপনার থেকে শিক্ষার্থীর কাছে জ্ঞান যায়, অপরটি হলো: শিক্ষার্থীর নিকট থেকে আপনার কাছে জ্ঞান আসে। কথাটা একটু গভীর মনোযোগ দিয়ে  বুঝতে হবে-আপনি মানেন আর না মানেন-এটাই স্বত:সিদ্ধ কথা। অনেক উঁচুমানের এমন শিক্ষার্থী আমি আমার শিক্ষকতা জীবনে  পেয়েছি-যাদের নিকট থেকে পাঠদানের সময় তাৎক্ষণিকভাবে জ্ঞান পেয়ে সেটি অবলম্বন করে পাঠদানকে সমৃদ্ধ করেছি-তারাও আনন্দ পেয়েছে আর মাঝখানথেকে আমার চিন্তা অযাচিতভাবে অজান্তে একটা প্রাপ্তি পেয়েছে। আমি বলতে চাচ্ছি--সফল পাঠদানে চোখের শাসন অবলম্বন করে পরিবেশ উপযোগীকরণ, সবকিছুতেই শ্রেণিকক্ষে উদার হওয়া এবং পাঠদানে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্তকরণ, সহজতা সৃষ্টি করে আগ্রহ সৃষ্টির মাধ্যমে পাঠের বিষয়ে প্রশ্নকরণের জন্য আন্দোলিতকরণ কৌশল রপ্ত করা একজন শিক্ষকের অপরিহার্য  করণীয় কর্তব্য।

কথার আদান-প্রদান ও কুশল বিনিময়ের মাধ্যমে অন্যের একদম কাছাকাছি হওয়া যায় এবং অন্যকেও নিজের দিকে আকৃষ্ট করা যায়। আর এ দুটি শতভাগ দরকার শ্রেণিকক্ষে। সৃতরাং বুঝতেই পারছেন শিক্ষার্থীর সাথে কুশল বিনিময় আমাদের কাজে কতটা জরুরি? “তোমরা ভাল আছো তো”-আপনার মুখ থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই দেখবেন শিক্ষার্থীরা সমস্বরে বলবে: ভাল আছি স্যার। এতে দুটি জিনিস লক্ষ্যণীয়। এক: তারা আপনার কাছাকাছি চলে এলো, আপনিও তাদের কাছাকাছি চলে গেলেন। দুই: ইতিপূর্বে  তাদের মানসলোক হয়ত ভিন্নভিন্ন ক্ষেত্রে বিস্তৃত ছিল-এখন কিন্তু সবারই সচেতনতা একটা লক্ষ্যকে কেন্দ্রবিন্দু ভেবে। আর তা হলেন আপনি-আপনার পাঠদান। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, কুশল বিনিময়ের পরও যদি শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ভিন্নদিকে থাকে, থাকতেও পারে, তাহলেও আপনার করণীয় আছে-আর সেটি পরিস্থিতি অনুযায়ী আপনাকেই নির্বাচন করতে হবে। যেমন: অঙ্গ সঞ্চালনের জন্য তাদেরকে স্ট্যান্ড আপ ও সীট ডাউন বলা। এভাবে কয়েকবার আপনার কমান্ডে উঠাবসার মধ্য দিয়ে তাদের ভিন্নক্ষেত্র থেকে একটি লক্ষ্যের দিকে নিতে পারেন। তারপর এ সুযোগে পাঠ ঘোষণার কাজটি সেরে নিতে পারেন। কী পাঠ আজকে হবে তা কিন্তু তাদের মুখ দিয়েই বের করে নেয়া আপনার কর্তব্য। এতে যেটি পাঠদান করা হবে-তার সাথে তাদের একটি যোগসূত্রও ইতিমধ্যে স্থাপিত হয়ে যাবে। দু/তিনটি প্রশ্নের মাধ্যমে পাঠ ঘোষণার কাজটি সেরে ফেলতে আপনাকে প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হবে। পাঠদানের বিষয়টি তাদের মুখ থেকে বের করে নেবার পর তাদেরই দ্বারা পালাক্রমে বোর্ডে পাঠের শিরোনামটি লিখে নিবেন প্রতিদিন। এইতো শুরু হলো শিক্ষার্থীর সহযোগিতা। শেষ পর্যন্ত শ্রেণির কাজ ও তাদের সহযোগিতায় আপনার কাজ দেখবেন সুচারুরূপে এগিয়ে যাবে। মজার ব্যাপার হলো, এভাবে একটি লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী বাহ্যিকভাবে এগিয়ে আসার সময় অন্তরালে কিন্ত উভয়ের চিন্তন শক্তিও এগিয়ে আসে এবং তাতে জ্ঞান-ফুলের কলি ফোঁটে। এটির পাঁপড়ি মেলাবেন ঠিক একইভাবে। বন্ধুরা! শিক্ষা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীর যত বেশি ইন্দ্রিয়কে শ্রেণিকক্ষে কাজে লাগাতে পারবেন-তাঁর পাঠদান ততবেশি সাকসেফুল হবে। ধরুন, তারা যখন পাঠগ্রহণে মশগুল-ঠিক এ পরিস্থিতে যদি আপনি তাদের কোন অডিও শোনান তাহলে একরকম ফল, আবার যদি ভিডিও তথ্যসহ ভিডিও দেখান-তাহলে দেখা ও শোনা একই সাথে হবার কারণে পূর্বের চেয়ে ভাল ফল পাবেন। কিন্তু যদি ভিডিও দেখানোর পর একটু আধটু ব্যাখ্যাও করে দিচেছন সাথে সাথে তারাও নির্দেশিত হয়ে খাতায় লিখে নিচ্ছে-এক্ষেত্রে পূর্ব ফলদ্বয়ের চেয়েও উন্নততর ফল আপনি স্বচক্ষে পরিলক্ষণ করবেন। আজকের বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের দিনে এ জন্যই শ্রেণিকক্ষে multimedia’র ব্যবহারকে বিশ্বজুড়ে পাঠদানের পরম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করছে। আমাদের ‘শিক্ষক বাতায়ন’ ও এর কন্টেন্ট প্রতিযোগিতা মূলত; শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের সর্বাধিক সংখ্যক ইন্দ্রিয় ব্যবহারের কৌশল রপ্ত করার মিলনী ও প্রচ্ষ্টোর প্রতিযোগিতার নামান্তর। তাই নয় কি? তাহলে শ্রেণিকক্ষে ফলপ্রসু পাঠদানের জন্য শিক্ষার্থীর সাথে কুশল বিনিময়, তাদের সহযোগিতায় পাঠদান কার্য এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং তাতে সর্বাধিকসংখ্যক ইন্দ্রিয়কে কাজে লাগানের কৌশল আমার আপনার এবং সকল শিক্ষকের রপ্ত করতে হবে।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি