Loading..

খবর-দার

০১ এপ্রিল, ২০২২ ১০:৫৫ অপরাহ্ণ

গল্পটা আমাদের

#নদীমাতৃক বাংলাদেশে লঞ্চ ভ্রমণ খুবই আরামদায়ক ও উপভোগ্য। লঞ্চে দক্ষিণ অঞ্চলের জেলাগুলোতে ঘুরতে অনেক শান্তি। একঘেয়েমি জীবন থেকে বের হয়ে ঘুরতে গিয়ে নতুন নতুন জিনিস দেখার, অনেক কিছু নতুন শেখার অভিজ্ঞতাও হয় আমাদের। ভ্রমণ চিন্তাশীল হতে শেখায় আর গাদা গাদা লেখার রসদ দেয়। তাই তো সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন, "পড় আর ঘুরো"। ব্যস্ত জীবন থেকে ছুটি নিয়ে প্রকৃতির বুকে মাঝে মাঝে ছুটে যেতে হয়।


আমি সবসময় ঘোরাঘুরির জন্য কবি-সাহিত্যিকদের বেছে নিই। সবার মন-মানসিকতা একইরকম। সপরিবারে খুব ইচ্ছা থাকা সত্তেও হয়ে ওঠে না। নানা ধরনের ফ্যাকড়া, প্যারা, আর্থিক অস্বচ্ছলতা, মানসিক অবস্থা, হরেক রকম পরিস্থিতি সামনে এসে দাঁড়ায়।


সৈয়দ শামসুল হকের 'কেরানিও দৌড়ে ছিল' পড়ার পর থেকেই খুব ইচ্ছে হতো সদরঘাটে আসার। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আমরা সদরঘাটে পৌঁছলাম। ঘাটের টিকিট ১০টাকা করে কিনে আমরা প্রবেশ করলাম জেটিতে। দেখলাম প্রকাণ্ড সব লঞ্চ জেটির সঙ্গে বাঁধা। প্রত্যেক অঞ্চলের লঞ্চ আলাদা আলাদা করে রাখা। জেটিতে প্রচুর মানুষ। যার যার গন্তব্য মতো লঞ্চ খুঁজে নিচ্ছে। বরিশাল ও পটুয়াখালীর কবিরা সাথে আছেন। শুনলাম এটা বুড়িগঙ্গা নদী। প্রত্যেকটি লঞ্চই উজ্জ্বল আলোয় সজ্জিত। বেশ কৌতূহল নিয়ে কয়েকটি লঞ্চ ঘুরে ঘুরে দেখলাম। দোতলা ও তিনতলায় বিলাসবহুল কক্ষ। নিচতলার পুরোটাই ডেক। নিচতলার ডেকের মেঝেতে যাত্রীরা চাদর, বিছানা বিছিয়ে শোয়ার ব্যবস্থা করেছে, কেউ কেউ শুয়ে পড়েছে, কেউ পান খাচ্ছে আর গল্প করছে। যাদের বিছানোর মত কিছু নেই, ২০০ টাকায় তোষক পাওয়া যায়। লঞ্চের পিছন দিকে ইঞ্চিনরুম, রেস্তারাঁ ও চায়ের দোকান। জানা গেল জরুরি চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। রাত ৯টার দিকে এম. ভি. সুন্দরবনে আমাদের যাত্রা শুরু। আমরা সেমি ভি. আই. পি কেবিন নিই ৪০০০ টাকার মধ্যে। ক্যবিনে এসি, সিসি টিভি ক্যামেরা থেকে শুরু করে ফ্যান দেওয়া, ফোন চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। পানির বোতল, একজোড়া জুতো, ময়লা ফেলার ঝুড়িও রয়েছে। আনসার সদস্য মোতায়েন করা আছে। এমনকি এই আনসার সদস্যদের খাওয়ার মুড়ি, বিস্কুটের কৌটাও রাখা থাকে। লঞ্চে লিফট, নামাজের স্থান রয়েছে, নদীর সৌন্দর্য উপভোগের জন্য করিডোরে দেওয়া রয়েছে চেয়ার।


একসময় লঞ্চ ছেড়ে দিল। ধীরে ধীরে জেটির মানুষগুলো ছোট হতে হতে ঝাপসা হয়ে গেল। আমরা ঘাট থেকে অনেক দূরে চলে এলাম। ছাদে গিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে যতদূর চোখ যায় ছোট বড় আলোকবিন্দু চোখে পড়ে আর  যাত্রাপথ জুড়ে বিভিন্ন রুটের যাত্রীবাহী নৌযান ও মালবাহী কার্গো। কিছুক্ষণ পর পর লঞ্চ বা ইঞ্জিন চালিত নৌকা চলে যাচ্ছে বা সেগুলোকে পিছনে ফেলে আমাদের লঞ্চ চলে যাচ্ছে। আকাশের তারকারাজি আর নদীর পানিতে জ্বল জ্বল করে জ্বলা আলোগুলো অপরূপ দৃশ্য তৈরি করেছে। মাছ ধরার দৃশ্য এক অন্যরকম রোমাঞ্চকর। রাতের নদীর সৌন্দর্য অসাধারণ। নদীতটের মিটিমিটি আলো মনের ভালোলাগার অনুভূতি বাড়িয়ে দেয়।


একসময় রাতের খাবার খাইলাম। আমরা খাওয়ার প্যাকেট কিনে নিয়ে উঠেছিলাম। তবে ওখানে হোটেলে খাওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। তবে দাম একটু বেশি। খাওয়া শেষ করে আবার ছাদে। ছাদে যাত্রীদের কেউ কেউ আড্ডা দিচ্ছে, আমেরিকা থেকে আসা কয়েকজন ট্যুরিস্ট আমাদের সাথে গল্প করলেন। আরো কয়েকটি লঞ্চ যেতে দেখলাম। সারেং মাঝে মাঝে সাইরেন বাজাচ্ছে। একটু পরপরই সার্চলাইট ফেলে পথ দেখে নিচ্ছে। সারেং এর কক্ষে  গিয়ে দেখলাম কত রকমের প্রযুক্তি ব্যবহার করছে-রাডার, কম্পাস, জিপিএস ইত্যাদি। সারেং আমার একটা বই খুব করে চাইলেন কিন্তু সাথে কোনো বই ছিল না।


হয়তো প্রথমবার লঞ্চে উঠেছি বলেই উত্তেজনায় ঘুম আসছিল না। তবুও একসময় শুয়ে পড়লাম। ভোরের দিকে একজন গার্ড এসে ডাকলেন, এই আপনারা উঠুন, বরিশাল পৌঁছে গেছি। হুড়মুড় করে সবাই উঠে যে যার মতো দাঁত ব্রাশ, মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। দেখলাম ঘাটে আরো কয়েকটি লঞ্চ বাঁধা। যাত্রীরা নেমে যাচ্ছে। আমরাও ব্যাগ নিয়ে নেমে পড়লাম। লঞ্চের  রাতটি আমার জীবনের একটি স্মরণীয় রাত। অসাধারণ একটি ভ্রমণের ভালো লাগা নিয়ে আমরা পা ফেললাম জীবনানন্দের শহরে।


জীবন থেকে রসদ নিয়ে তৈরি হয় গল্প ও চরিত্র। সাহিত্যের বীজ থাকে জীবনের সাথে জড়িত প্রকৃতিতে। একবার চাঁদনী রাতে লঞ্চ ভ্রমণের সৌভাগ্য হলে বেশ জমবে। জ্যোৎস্নামাখা নদীপথ মুগ্ধতার এক আবেশে ভরে দেবে। সকালবেলা ঘুম থেকে জেগে বরিশালের কীর্তনখোলা/পটুয়াখালীর লোহালিয়া নদীর সৌন্দর্যে দিনের সূচনাটা হবে দারুণ। ভ্রমণে ভিন্নধর্মী এক ভ্রমণের স্বাদ আস্বাদনের জন্য লঞ্চ যাত্রা সত্যিই উপভোগ্য।

মেহেনাজ পারভীন