Loading..

প্রকাশনা

০৯ মার্চ, ২০২০ ০৯:০৬ অপরাহ্ণ

ছোটগল্প

                                                                   ভোরের আলো

                                                                  মুহাম্মদ মিজানুর রহমান


ভোর হলে আর বিছানায় থাকতে মন চায় মাহিনের। সারাদিন অনেক কাজ। বিশেষ করে, সকাল বেলা তার কাছে অন্য সময়ের থেকে একটু বেশি দামি। কারণ, এ সময়টার উপর নির্ভর করে দিনের মূল্যবান হিসাবটা। দিনের ব্যস্ততা তার রাতের ঘুমকে আরো নিবিড় করে তোলে। কখনো কখনো তার নাক বাঁশির বিরক্তিকর শব্দ সংসারের অন্যদের ঘুম কেড়ে নেয়। তবু তাকে কিছু বলে না। কারণ তারা তার সুস্থতা আর স্বাভাবিকতার উপর টিকে আছে। নিষ্প্রাণ মানুষের মতো এ পরিবারের অন্য দুটি সদস্য। একজন দুনিয়ার আলো দেখে, মানুষ দেখে, মানুষের সুখ দেখে, কিন্তু নিজেদের দুরবস্থা দেখে দারুন হতাশ হয়। অন্যজন এই ভেবে আশার আলো খুঁজে নেয়, একজন মানুষকে তো সৃষ্টিকর্ত ভালো রেখেছেন তাদের জন্য। হয়তো তাকে দিয়ে বাঁচিয়ে রাখবেন। একদিন তাদের এ অসহায় দিনগুলো কেটে যাবে। তারাও সুখের দিন গুনবে।  
মাহিনের মা সুবর্ণা। দু-বছর আগে একটা দুর্ঘটনায় দুটো চোখ হারিয়েছেন। এখন দিন আর রাত দুটোই তার কাছে সমান। বাবা মনজুর আলম। চাকরি করতেন একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে। মাইনে যা পেতেন এ দিয়ে সংসারটা কোনোমতে চলে যেত। দু-পয়সা জমানোর সুযোগ হয়নি কখনো। একদিন শিকার হলেন আকস্মিক দুর্ঘটনার।  
মনজুর আলমের সেই দুর্ঘটনার সাথি ছিলেন তার স্ত্রী সুবর্ণা। মটর সাইকেল করে স্বামী-স্ত্রী দুজনে খুলনায় সুবর্ণার বোনের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। মাহিন ছিল বাড়িতে।  দিনটা ছিল রবিবার। মাহিনের স্কুল খোলা। মাহিনও যেতে রাজি হলো না। তাছাড়া মাহিন এমনিতেই একটু স্কুল পাগল। আর যা-ই করুক স্কুল কামাই করবে না সে। এ কারণে তাকে আর সঙ্গে নেয়া সম্ভব হয়নি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুদূর যেতেই হঠাৎ একটা প্রাইভেট কারের সাথে হাই-ওয়ের উপর ধাক্কা লাগল তাদের মটর সাইকেলের সাথে। মনজুর আলম ছিটকে পড়ল হাতের ডানে। দ্রুতগামী একটি চলন্ত ড্রাক তার দুটো পা নিমিষেই পিষে দিলো। সুবর্ণা ছিটকে পড়ে বাঁ দিকে রাস্তার পাশে একটা কাঁটাতারের বেড়ার উপর। দুটো চোখে প্রচ- আঘাত লাগে। প্রথমে একটি চোখ হারালেও কিছুদিন পর অন্য চোখটিও নষ্ট হয়ে গেল। টাকার অভাবে উন্নত চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হলো না। চরম দুর্দিন নেমে আসে তাদের সংসারে। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পৈত্রিক সম্পত্তি বলতে সুবর্ণা ও মনজুর আলমের তেমন কিছু ছিল না। দুজনেই দারিদ্রের সাথে সংগ্রাম করে বেড়ে উঠা দুজন সাধারণ মানুষ। ভালোই ছিলেন তারা।
সংসারের হাল ধরতে হয় মাহিনকে। যখন অন্য দশটি শিশু কাঁধে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে ছুটে চলে, তখন তাকে বেরোতে হয় রুটি-রুজির সন্ধানে। মায়ের কথা ভেবে চোখে জল আসে। বাবার অসহায়ত্ব দেখতে পারে না। সে চায় বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে। বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে লেখাপড়া ছেড়েছে। রাস্তায় রাস্তায় পত্রিকা বিক্রি করছে সে। এ থেকে যা আয় হয় এ দিয়ে চলে তার সংসার। ভোর হলেই চোখে-মুখে পানি দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। শহরে এসে এক কাপ চা আর একটা বিস্কুট দিয়ে সকালের নাস্তা সেরে নেয়। চায়ের দোকানে বসে অপেক্ষায় থাকে কখন পত্রিকা আসবে। আর দিনের কাজ শেষ করে দুপুর হবার আগেই কখন বাড়িতে ফিরবে। বাড়িতেও যে অনেক কাজ পড়ে আছে। মা অন্ধ মানুষ, কী করছে কে জানে!  
কিছুতেই মন ভরে না তার। সে জানে, এভাবে জীবন চালালেও ভবিষ্যতে পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সে যে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে। গায়ে খেটে-খুটে অনেক কষ্টে সে সম্পদশালীও হয়ে যেতে পারে, এ পথ হয়তো তার সামনে আসবে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে মানুষ হবার পথটা তার শেষ হয়ে যাবে। তাই সে নিজের স্বপ্নটাকে বদল করেছে। দিনটা বেছে নিয়েছে কাজের জন্য। আর রাতটা তার লেখাপড়ায় ব্যয় হবে। ভর্তি হয়েছে একটি নৈশ বিদ্যালয়ে। তাকে যে বড় মানুষ হতে হবে। একটা সোনালি ভোরের আলোর ঝলমলে রোদে এ পৃথিবীকে সুন্দর করে দেখবে সে।

 



আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি