Loading..

খবর-দার

০৫ জুলাই, ২০২০ ০৪:১৭ অপরাহ্ণ

“The Bengali Refugees: A Surfeit of woe

ভৌতিক কলেরা মিথ
একাত্তরে ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোতে কলেরা মহামারী রূপ নিয়েছিল। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও মেঘালয়ের শরণার্থী শিবিরগুলোতে বিপুল সংখ্যক লোক কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ২২ জুন ১৯৭১ ওয়াশিংটন ডেইলি নিউজে James Foster এর একটি রির্পোট প্রকাশ হয়।

রির্পোটটির শিরোনামই ছিল ‘60,000 of 5 million Refugees have died’। ডিসেম্বরে নিউ ইয়র্ক টাইমস এর একটি প্রতিবেদনে উঠে আসে কলেরায় ভয়াবহ মৃত্যুর বর্ণনা, টাইম ম্যাগাজিনের সাংবাদিক জন সার ও ফটোগ্রাফার মার্ক গডফেরি জুন মাসে নদীয়া সফর করে সচিত্র প্রতিবেদন তুলে ধরেছেন- “The Bengali Refugees: A Surfeit of woe” শিরোনামে। একদিকে হাজার হাজার লোকের কলেরায় আক্রান্ত হওয়া, বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে কলেরার প্রতিষেধক প্রদান, সব মিলিয়ে কলেরা শরণার্থী শিবিরগুলোতে ভয়াবহ আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। সেই আতঙ্ক উঠে আসে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। নিউ ইয়র্ক টাইমসে লেখা হয়, শেষপর্যন্ত কতজন বেঁচে থাকবে সেটা বলা যায় না।

গুজবের সেই আতঙ্ক আর অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে শরণার্থী ক্যাম্পে। জন্ম নেয় ভৌতিক কলেরা মিথের। ঝড়ের বেগে এই গুজব ছড়িয়ে পড়ে ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে। সেই গুজবের আতঙ্কে অনেকেই হারাতে থাকে প্রাণ।

বলছি ভারতের সুতানটি শরণার্থী ক্যাম্পের কথা। ক্যাম্পে এক তাঁবুর নিচে গাদাগাদি করে থাকা, মশা, চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে থাকতে শরণার্থীদের মধ্যে তৈরি হলো এক ভৌতিক মিথ। রিলিফে পর্যাপ্ত খাবার পেলেও সে খাবার সহ্য হতো না বেশিরভাগ মানুষের। সমস্যা হতো হজমের। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সব মিলে নানান কারণে দেখা দিতো প্রাণঘাতী কলেরা। আর একবার দেখা দিলে মরতো শয়ে শয়ে। চারপাশে করুণ মৃত্যু দেখতে দেখতে একসময় শরণার্থী শিবিরের মানুষ হঠাৎ করে দেখতো কেউ একজন মানুষ থেকে গরু হয়ে গেছে। আবার কখনও দেখতো মানুষ থেকে ছাগল হয়ে গেল; আবার হঠাৎ উধাও হয়ে গেলো চোখের নিমিষে। এসব যারা দেখতো তারা আক্রান্ত হতো কলেরায়। মূলত সুন্দর-দেখতে ও যুবা বয়সের  ছেলেমেয়েদেরই ভয় দেখিয়ে মারতো বলেই মত শিবিরে দিনকাটানো মানুষের।

সীমান্তঘেঁষা নাটনা সুতানটি শরণার্থী শিবিরে এমন ভৌতিক অবস্থার মুখোমুখি হয়ে প্রাণ হারান অসংখ্য মানুষ। নয় বছর বয়স তখন তার। নাম জুলমত আলী ঝিলা। যুদ্ধের ডামাডোলে নিজগ্রাম বালুঘাট-শালিকা থেকে পাড়ি জমালেন পাশের নাটনা মাঠে। সেখানে সুতানটি শরণার্থী ক্যাম্প। মাঝে ভৈরব নদের ছোট একটি শাখা বালুরখাল। খালপাড়ের পশ্চিমপাশ থেকেই ভারতের নাটনা। নদীয়া জেলার তেহট্টার নবীনগর, ছাটনি, গরিবপুর পশ্চিমের সীমান্তজুড়ে। দিগন্তবিস্তৃত মাঠ পেরিয়ে খাল পেরুলেই নিরাপদ। তাই কয়েক হাজার শরণার্থী যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই নাটনা গিয়ে ঘর-আস্তানা গাড়তে শুরু করে। মেহেরপুর সদর থেকে নাটনার দূরত্ব ১০ কিলোমিটার।

আর শালিকা থেকে নাটনার ৩ কিলোমিটার সড়ক এই ৪৫ বছরে কাদামাটির স্তর বাড়িয়েছে শুধু। জুলমত আলীর সঙ্গে দেখা সেখানেই। তখন গরু চরাতেন। আর এখন সেই মাঠে, সেই খালের পাড়ে করেন কৃষিকাজ। ঝিলার মা ফাতেমাও মারা যান এমন অদ্ভুত কলেরায়। বমিও হতো। তার ভাষ্য, এভাবে আরও মারা যান শালিখার জয় হালসানার বউ জমিরন, মহিউদ্দিনের স্ত্রী আয়েশা। শেষে সবাই বলা শুরু করলো ওই ক্যাম্পে গেলে মরবি সব।

সেই ক্যাম্পে রেশন বণ্টনের দায়িত্বে ছিলেন নূর মিয়া। বলছিলেন, মূলত বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে কলেরায় মারা যাওয়ার খবর আসা শুরু করল। টিকাসহ কোনও ধরনের চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই। সুতারাং কলেরা হলে বাঁচার কোন সম্ভাবনা নেই। এমন অবস্থায় ‘ওলা বিবির’ গুজব ছড়িয়ে পড়ে। সুতানটিসহ আশে পাশের ক্যাম্পে কলেরায় আক্রান্ত হওয়ার চেয়ে কলেরার আতঙ্কে বেশি লোক প্রাণ হারিয়েছে।

সব কষ্ট, সব আতঙ্ক, সব অনিশ্চয়তার মধ্যে এই কলেরা আতঙ্কই বড় হয়ে উঠেছিল সুতানটি শরণার্থী শিবিরে।

একই ভৌতিক কলেরা মিথ ছড়িয়ে পড়েছিল মেঘালয়ের বালাট, মাইলাম শরণার্থী শিবিরে। রাতে স্বপ্ন দেখছে, গরু ছাগলের বেশে ওলা বিবি আসছে, সকালে রক্তবমি। আর শয়ে শয়ে মানুষের মৃত্যু।

রেডিও মিহির
আগরতলার এমবিবি কলেজের শিক্ষক ছিলেন মিহির দেব। পাশাপাশি সাংবাদিকতা করতেন দৈনিক সংবাদে। পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক মিহির বাবুর কাছে একাত্তরে একটি ট্রানজিস্টর ছিল। যেটাতে হয়তো তিনি কিছু সংবাদ শুনতে পেতেন। সেই ট্রানজিস্টর কে সম্বল করে সংবাদে নিত্য নূতন গুজব ছড়িয়ে দিতেন মিহির। বলছিলেন রবীন সেন গুপ্ত, ‘ট্রানজিস্টরের নব ঘুরিয়ে মিহির যে কতো নিত্য নতুন সংবাদ বানিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। মিহির দেব আর বিকচ চৌধুরীর হাতে পড়ে একাত্তরের দৈনিক সংবাদ পরিণত হয়েছিল গুজবের বাক্সে।’ আর একাত্তরের শুরুতে দৈনিক সংবাদের বরাতে বাংলাদেশের সংবাদ ভারতীয় গণমাধ্যম এমনকি বৈশ্বিক গণমাধ্যমে স্থান পেত।

একাত্তর ঢাকা হয়ে পড়েছিল গুজবের নগরী, নানামুখী গুজবের শাখা-প্রশাখা গজাতে শুরু করল ঢাকার আকাশে বাতাসে। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুর থেকে বনগাঁ নানা কল্পকাহিনীতে ভরপুর হয়ে উঠেছিল। এসব গুজবে মানুষ আশ্রয় খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করত। দুর্বিষহ জীবনে আশার বুক বাঁধত। একসময় এসব নানামুখী গুজব, রটনাকে ছাপিয়ে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের’ জন্ম হয়। জন্ম নেয় বীর বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল ঘটনার।

আর/০৮:১৪/১৬ ডিসেম্বর