Loading..

উদ্ভাবনের গল্প

২৩ আগস্ট, ২০২০ ০৩:১৬ অপরাহ্ণ

সুখ কি? আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি.... ?

সুখ! ঠিকানা? - বৈকুন্ঠপুর?!!


"একজন প্রশ্নকারীর প্রশ্ন ছিলো- যে জিনিসগুলোকে ভেবেছিলাম যে সুখ এনে দেবে, ছয় বছর পর সেই জিনিসগুলো পেয়েও এখনো আমি সেই আগের অবস্থায় আছি একা। কী করব, আবার নতুন করে শুরু করতেও ইচ্ছা করছে না। একই বৃত্তের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছি। কীভাবে সুখী হবো—জীবনের অর্থই বুঝতে পারছি না।"


~আসলে অশান্তির আপাত উল্লেখযোগ্য কারণগুলোর পেছনের কারণকে আমরা যদি দেখি, আমরা দেখব একটা সহজ সত্য। সহজ সত্য হচ্ছে—স্রষ্টা আমাদেরকে কিছু মানবীয় গুণাবলি দিয়ে পাঠিয়েছেন। দিয়েছেন কল্যাণকর গুণাবলি, সৃজনশীল শক্তি এবং মমতার অনুভূতি। যাতে আমরা মানুষের কল্যাণ করতে পারি, নতুন নতুন সৃষ্টি করতে পারি। অর্থাৎ মানুষ হিসেবে আমাদের কর্মের যে স্বাধীনতা, সৃজনশীল মানুষের কর্মের যে স্বাধীনতা—এই স্বাধীনতা প্রতিটি মানুষের মধ্যে জন্মগতভাবে দেয়া আছে।


সেই মানুষকে যখন রোবট বানিয়ে ফেলতে চান, পণ্য বানিয়ে ফেলতে চান, কনজুমার বানিয়ে ফেলতে চান সে কখনো শান্তিতে থাকতে পারবে না। এখনকার প্রজন্মের কিছু জনপ্রিয় সিনেমার নাম কী? ‘অ্যাভাটার’, ‘মেট্রিক্স’, কিংবা আরো কিছুদিন আগেকার মুভি ছিল ‘সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান’, ‘ইনক্রেডিবল হাল্ক’ বা ‘রোবোকপ’। এ সিনেমাগুলোতে কী করা হয়েছে?


এ সিনেমাগুলোতে মানুষ, মৃতপ্রায় মানুষ বা মরে গেছে এমন মানুষের স্নায়ুতে কিছু ইলেক্ট্রিক ডিভাইস দিয়ে তার ব্রেনের মধ্যে নতুন প্রোগ্রাম দিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে সে আর নতুন কিছু করতে পারছে না। অর্থাৎ একটা সেনসিবল মানুষ, স্পর্শকাতর মানুষ, অনুভূতিপরায়ণ মানুষ হয়ে গেল ইনসেনসিবল একটা ক্রিয়েচার, একটা প্রাণী। নির্দিষ্ট কাজের বাইরে যার কোনো সেন্স নেই, তার মায়া নেই, মমতা নেই, কিছু নেই। আমরা কিন্তু প্রকারান্তরে এখন তা-ই হচ্ছি।


যেমন, আমাদের দেশে আগেকার দিনে অধিকাংশ মানুষ বাড়িতে বাগান করত। বাগানে ফল হচ্ছে—আম হচ্ছে, পেয়ারা হচ্ছে। কিছু নিজে খাচ্ছে, কিছু পাড়া-প্রতিবেশীকে দিচ্ছে, আত্মীয়-স্বজনের কাছে পাঠাচ্ছে, পাশের গরিবকে দিচ্ছে। এখন আম গাছের আম কোনো আত্মীয়ের বাসায় যায় না, পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে যায় না, গরিবের কাছে যায় না। আমগাছ থেকে আম আমরা নিজেরাও খাই না। এখন আম গাছসহ বিক্রি হয়ে যায়, পাইকারের কাছে নয়তো বহুজাতিক ড্রিংকস কোম্পানির কাছে। আপনি খেতে চাইলে আপনাকে পাইকারের কাছ থেকে কিনে খেতে হবে।


অর্থাৎ সবকিছুই এখন পণ্য হয়ে গেছে। পণ্যের প্রয়োজন আছে। কিন্তু সবকিছুকেই যদি পণ্য বানিয়ে ফেলি, অর্থাৎ যদি ব্যালেন্স করতে না পারি, যদি জীবনে পরিমিতি না থাকে, তাহলে সীমালঙ্ঘনের শাস্তি তো হবেই। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘খাও, পান কর, কিন্তু অতিরিক্ত করো না’। আমরা খাই, পান করি এবং অতিরিক্ত করি। আজকে ইউরোপ আমেরিকার এক তৃতীয়াংশ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত। প্রতি তিনজনে একজনের ক্যান্সার। মানুষকে যদি আপনি পণ্যে রূপান্তরিত করেন, মানুষ যদি কনজুমার হয়ে যায়, শুধু ভোক্তা হয়ে যায়, মানুষ যদি ইনসেনসিবল, অনুভূতিহীন, মায়ামমতাহীন প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়, তাহলে এ পরিণতিই হবে।


অনেক আগে এইচ জি ওয়েলসের উপন্যাস ‘টাইম মেশিন’ অবলম্বনে তৈরি মুভি দেখছিলাম। কাহিনীতে নায়ক টাইম মেশিন বানিয়ে অতীতে এমন একটি জায়গায় চলে যায় যেখানে পরমাণুযুদ্ধ করে একটা সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেছে। দেশজয়ী পক্ষ খাবারের খোঁজে শেষমেশ বিজিত পক্ষের মানুষদেরই খেতে শুরু করল। তারা দেখল—সব যদি একসাথে খেয়ে ফেলে তাহলে এরপরে খাবে কী? অতএব তারা মানুষের ফার্ম করল।


সেখানে যারা থাকে তাদের খাওয়া-দাওয়া এবং বংশবৃদ্ধি ছাড়া আর কোনো সেন্স নাই। ওখানে একটা দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে—তারা একটা ঝর্নার ধারে—খরস্রোতা ঝর্নার ধারে রয়েছে। একটি মেয়ে পড়ে গেছে, ভেসে চলে যাচ্ছে। চিৎকার করছে কিন্তু কেউ বাঁচানোর জন্যে এগিয়ে আসছে না। যেমন একটা মুরগিকে ধরে নিয়ে গেলে আরেকটা মুরগি ভ্রূক্ষেপ করে না, অনেকটা সেরকম। তখন নায়ক লাফ দিয়ে পড়ে তাকে বাঁচিয়ে নিয়ে এলো এবং অন্য পুরুষদের ধিক্কার দিতে লাগল। তারপরও কেউ কোনো কথাই বলছে না।


এর মধ্যে সাইরেন বাজল। মানুষগুলো তখন কাজটাজ ফেলে লাইনে গিয়ে দাঁড়ালো। এক এক করে ঢোকানো হচ্ছে একটা ঘের দেয়া জায়গার ভেতর। একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষ ঢোকার পর গেট বন্ধ করে দেয়া হবে এবং এরাই হবে আগামী কিছুদিনের জন্যে ওদের খাবার। বাকিরা ঐ যাত্রায় বেঁচে গেল। তারা ফিরে এসে খাওয়া-দাওয়া করবে। যারা গেল তাদের নিয়ে একবারও ভাববে না।


আমরা যদি আমাদের এখনকার লাইফস্টাইলের দিকে তাকাই তাহলে দেখব আমরাও কিন্তু ধীরে ধীরে আমাদের মানবীয় গুণাবলিকে ত্যাগ করে পণ্যদাসে পরিণত হচ্ছি, কনজুমারে পরিণত হচ্ছি। যেমন, অতীতে আমরা যখন বাসায় যেতাম, আমরা বাসার লোকদের সাথে কথা বলতাম। বাসার লোকদের সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিল।


আমরা এখন বাসায় যাই, কিন্তু বাসার লোকজনের সাথে কি আমরা কথা বলি? অধিকাংশ সময়ই আমরা কী করি? হয় টিভি, মোবাইল নয়তো কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকি। এমনও হয়, একই বাসায় আছি, অথচ দিনের পর দিন দেখা নেই বা কথা নেই। কারণ আমাদেরকে সেইরকম প্রোগ্রাম দেয়া হয়েছে। আমার জীবন আমার। তোমার জীবন তোমার।


স্বামী-স্ত্রী হয়ে গেলে ‘হাম দো, হামারা দো’-এর বাইরে কোনো জীবন নেই। এই স্বামী-স্ত্রীর যখন সন্তান হয়, সে-ও তখন বড় হয়ে বলে, ‘হাম দো, হামারা দো’। আগের যারা আছে সব বাদ হয়ে যায়। অর্থাৎ আপনি যখন কমাতে থাকবেন, ‘হাম দো’ আর থাকবেন না। ‘হাম-হাম’ ‘তুম-তুম’ হয়ে যাবেন। অর্থাৎ আমরা না, ‘আমি আমি’, ‘তুমি তুমি’ হয়ে যাবেন।


আজকে ইউরোপ-আমেরিকাতে কী হচ্ছে? এখন সিঙ্গেল প্যারেন্ট সিস্টেম শুরু হয়েছে। এখন মা হলে বাবা নেই, বাবা হলে মা নেই। এর কারণ হয় বিয়ে বিচ্ছেদ, নয়তো বিয়েহীন বাবা-মায়ের সন্তান হওয়া।


এই যে মানবীয় অবস্থান থেকে আমাদের বিচ্যুতি, অনুভূতিহীন প্রাণীতে পরিণত হওয়া—এটা তো আমাদের অন্তর্গত সত্তার বিপরীত। যে সত্তা ভালবাসতে চায়, অনুভব করতে চায়, মমতা পেতে চায় বা দিতে চায়। কিন্তু আমরা কী করছি? বাইরের ব্যস্ততা দিয়ে, বাইরের মুখোশ দিয়ে আমরা সেই মানবীয় গুণাবলিটাকে ধামাচাপা দিয়ে রাখতে চাচ্ছি এবং এটা করছি আমাদের চারপাশের প্রভাবের কারণে।


আমাদের মিডিয়াগুলো এখন নিয়ন্ত্রণ করছে কারা? টিভি বলেন, সংবাদপত্র বলেন—সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে বহুজাতিক ব্যবসায়ীরা। তারা বিজ্ঞাপন দিলে টিভি চলবে, তারা যে ধরনের প্রোগ্রাম চায় সে ধরনের প্রোগ্রামেই আপনাকে ব্যস্ত রাখবে। সিলেটে বন্যা হচ্ছে—এটা নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু জার্মানিতে খেলায় কে জিতেছে—এটা নিয়ে রাতে ঘুম নেই।


এই যে খেলা নিয়ে এত ক্রেজ কেন? ইউরোপে এত ক্রেজ কেন? কারণ ইউরোপে খেলাটা হচ্ছে জুয়া, ওখানে এগুলোকে বলে বুকার। ইংল্যান্ডে মহল্লায় মহল্লায়, প্রত্যেক অলিতে গলিতে বুকারস ক্লাব, যেখানে কে জিতবে এর ওপর আপনি বাজি ধরবেন। যদি আপনার দল জিতে যায় তো আপনি কিছু পাবেন। আর হেরে গেলে আপনাকে দিতে হবে। কিন্তু আসলে লাভবান হবে এসব বাজির উদ্যোক্তারা। যেমন, লটারিতে সবচেয়ে লাভবান কারা হয়? উদ্যোক্তারা। আর এসব বাজি তত জমবে যত খেলা নিয়ে উন্মাদনা সৃষ্টি করা যাবে। আর তার মাধ্যম হলো মিডিয়া। এখন তো আমাদের উপমহাদেশেও এসব শুরু হয়ে গেছে। এই যে আইপিএল নিয়ে এত শোরগোল, এর পেছনেও রয়েছে এই জুয়াবাজির খেলা।


কিন্তু একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে আপনি কী করছেন? মিডিয়ার উন্মাদনায় মেতে উঠে নিজের অজান্তেই স্বার্থান্বেষী চক্রের ফাঁদে পা দিচ্ছেন, অশান্তিকে নিজেই ডেকে আনছেন।


এটা শুধু আমাদের দেশে না, সারা পৃথিবীতেই সাধারণ মানুষ পরিণত হয়েছে মাল্টিন্যাশনাল চক্রের ক্রীড়নকে। বড় বড় মাল্টিন্যাশনালগুলো সব মার্জ করছে। অর্থাৎ এদের সংখ্যা কমছে। কিন্তু আয়তন বাড়ছে। কারণ তারা দেখছে যে, তারা যদি সঙ্ঘবদ্ধ থাকে তাহলে পৃথিবীজুড়ে তারা একচেটিয়া ব্যবসা করতে পারবে। কাজেই প্রতিযোগিতা করে অন্যকে লাভ দেয়ার দরকারটা কী? ভাগ-যোগ করে বরং নিজেরাই খাওয়া যাবে।


ফলে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে তারা সৃষ্টি করেছে তাদের পণ্য কেনার প্রতিযোগিতা, যাদেরকে তারা আইডল হিসেবে উপস্থাপন করছে, তাদের অনুসরণ করার প্রতিযোগিতা। আর নিজের মানবীয় সত্তাকে বিকশিত না করে কেনা বা অনুকরণের যে প্রতিযোগিতা, এ প্রতিযোগিতাই হচ্ছে সমস্ত অশান্তির মূল কারণ। আমরা সত্যিকার অর্থে এই অশান্তি থেকে তখনই মুক্তি পাবো, যখন আমরা নিজের ভেতরে তাকাব, যখন আমরা আমাদের ভেতরে যে মানবীয় সত্তা, যে সৃজনশীল সত্তা রয়েছে—এই সত্তাকে বিকশিত করব।


কারণ, এই যে পাংকু বলেন, হিপ্পি বলেন, ডিজুস বলেন—এই জেনারেশন কি মানুষকে কিছু দিতে পারছে? তাদের গান কি মানুষকে প্রশান্তি দেয়? গান তো হবে এরকম, সেটা যে উদ্দেশ্যে রচিত সেটা দেবে। হয় গান প্রশান্তি দেবে, না হয় গান উদ্বুদ্ধ করবে। যেমন, মুক্তিযুদ্ধের সময় গান আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। কিন্তু এখন? গানও গাইলাম, কতক্ষণ লাফালামও, কিন্তু শান্তি পেলাম না, উদ্বুদ্ধও হলাম না, আরো অশান্ত হয়ে গেলাম। তাহলে লাভ কী হলো? মজার ব্যাপার হলো, যাদেরকে আমরা আইডল মনে করছি, তারা কি শান্তি পেয়েছে যে, আপনাকে শান্তি দেবে? তারা যেহেতু শান্তি পায় নি, তাদের যদি আইডল মনে করেন—আপনিও কখনো শান্তি পাবেন না।


যেমন-এই যে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে যারা চাকরি করছে, বড় বড় সব চাকরি করছে, তারা কি শান্তিতে আছে? আমাদের দেশের কথা বাদ দিন। সাইকোলজি টুডে পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, আমেরিকান মাল্টিন্যাশনালগুলোর ৮০% সিইও ডিপ্রেশনে ভোগেন। তার মানেটা কী? তিনি যে কাজ করছেন সেই কাজ তার অন্তরে প্রশান্তি সৃষ্টি করতে পারছে না।


শান্তির জন্যে তাই অন্তরের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আসলে যার প্রতি আপনি মনোযোগ দেবেন, তা-ই আপনার দিকে আকৃষ্ট হবে। আপনি ফুটবলের প্রতি মনোযোগ দিন, আপনি স্বপ্নের মধ্যেও ফুটবল দেখবেন। আপনি ক্রিকেটে মনোযোগ দিন, স্বপ্নেও ক্রিকেট দেখবেন। আপনি অন্তরের দিকে মনোযোগ দিন, স্বপ্নেও আপনি অন্তরই দেখবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি আপনার অন্তরের দিকে না তাকাচ্ছেন, দৃষ্টিটা অন্তরের দিকে না দিচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি প্রশান্তি পাবেন না।