Loading..

ম্যাগাজিন

১৩ অক্টোবর, ২০২০ ১২:৪৫ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গবন্ধুর সংস্কৃতি ভাবনা

বঙ্গবন্ধুর সংস্কৃতি-ভাবনা

 

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন নেতা হয়ে ওঠেন তখন এই ভূখণ্ডে অনেক বড় বড় নেতা ছিলেন। এমনকী তারও আগে বঙ্গদেশে আরো অনেক গুণী নেতা এসেছেন। কিন্তু বাঙালি জাতির জন্য স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা কেউ করে যেতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুই একমাত্র সফল হয়েছেন। এর অনেকগুলো কারণের অন্যতম প্রধান কারণ বঙ্গবন্ধু কেবল রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন না, তিনি ছিলেন সংস্কৃতিকর্মীও। তিনি তৎকালীন পূর্ববাংলার জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে এক করতে পেরেছিলেন। তিনি বাংলার মানুষকে ধর্মীয় পরিচয়ের উপর নয়, সাংস্কৃতিক পরিচয়ের উপর এক কাতারে দাড় করিয়েছেন। তাঁর কারণে বাঙালি জাতীয়তাবাদ হয়ে উঠেছে বাঙালি সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদ।

আমরা জানি বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় ও নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা রাখেন। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বাংলা ভাষা ছাড়া বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতি রক্ষা করা যাবে না। বাংলা সংস্কৃতি রক্ষা করা না গেলে পূর্ব-পাকিস্তানের গণমানুষের অস্তিত্ব টিকে থাকবে না। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ তিনি বাংলা ভাষার দাবি নিয়ে পালিত ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিয়ে কারাগারে যান। স্বাধীন পাকিস্তানে রাজনৈতিক জীবনে এটাই তাঁর প্রথম কারাবাস। তিনি কেবল স্বভূমেই নয়, বিদেশেও বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছেন। পঞ্চাশের দশকে সেই চীনসফরে তিনি বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেন। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন: ‘...আমিও বক্তৃতা করলাম বাংলা ভাষায়। ভারতবর্ষ থেকে বক্তৃতা করলেন মনোজ বসু বাংলা ভাষায়। বাংলা আমার মাতৃভাষা, মাতৃভাষায় বক্তৃতা করাই উচিত। কারণ, পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের কথা দুনিয়ার সকল দেশের লোকই কিছু কিছু জানে।...দুনিয়ার সকল দেশের লোকই যার যার মাতৃভাষায় বক্তৃতা করে। শুধু আমরাই ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা করে নিজেদের গর্বিত মনে করি।’ অনুরূপভাবে আমরা দেখি তিনি ১৯৭৪ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথমবারের মতো অংশ নিয়ে বাংলায় ভাষণ দেন। জাতিসংঘের মতো বিশ্ব আসরে প্রথম বাংলা ভাষা উচ্চারিত হয় বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে।

বঙ্গবন্ধু তাঁর সম্পূর্ণ রাজনৈতিক জীবনে সবসময় লেখক ও শিল্পীদের সঙ্গে নিয়ে হেঁটেছেন। তিনি যতই পরিণত হয়েছেন তত লেখকশিল্পীদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। নিজে যখন লেখক তখন সেসব মুহূর্তের কথা স্মরণও করছেন উদারচিত্তে। বাংলা ভাষার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সংস্কৃতি, বিশেষ করে লোকায়ত সংস্কৃতিকে বুকে ধারণ করেছেন। কারুশিল্পী, চারুশিল্পী কোনো শিল্পমাধ্যমই বাদ যায় নি। তাঁর আন্দোলনে শক্তি যুগিয়েছে আমাদের দেশীয় গ্রামীণ সাংস্কৃতিক ধারা। বঙ্গবন্ধু সিলেট-সুনামগঞ্জে রাজনৈতিক সফরে গেলে তাঁর সামনে তিনি গানগুলো গেয়ে শোনান। বঙ্গবন্ধু বলেন, করিম ভাই যেখানে, শেখ মুজিব সেখানে। বিখ্যাত লোকসংগীতশিল্পী আব্বাসউদ্দীনের গান শুনে তিনি জানাচ্ছেন: ‘বাংলার গ্রামে গ্রামে আব্বাসউদ্দীন সাহেব জনপ্রিয় ছিলেন। জনসাধারণ তাঁর গান শোনার জন্য পাগল হয়ে যেত। তার গান ছিল বাংলার জনগণের প্রাণের গান। বাংলার মাটির সঙ্গে ছিল তার নাড়ির সম্পর্ক।’ লোকায়ত সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের মূলধারার শিল্পসাহিত্যের সঙ্গেও সম্পর্ক রেখেছেন। খোঁজখবর রেখেছেন নিয়মিত। অন্তরে ধারণ করতেন বাংলা সংস্কৃতির দুই প্রাণ: রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে। দুজনের অনেক গান ও কবিতা তাঁর মুখস্থ ছিল। সুযোগ পেলেই তাঁদের রচনা থেকে উদ্ধৃতি টানতেন। একদিকে যেমন নজরুলের কবিতা থেকে তিনি ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান নেন, যে শ্লোগান আমাদের লক্ষ কোটি প্রাণকে স্বাধীনতার পথে উজ্জীবিত করেছে; অন্যদিকে আবার স্বাধীন রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত নির্বাচন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান থেকে, যে গান আমাদের অসাম্প্রদায়িক বাংলা সংস্কৃতির আধার হয়ে উঠেছে।

রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ছাড়াও বঙ্গবন্ধু আরো অনেকের লেখা পছন্দ করতেন। শরৎচন্দ্রের ‘আঁধারের রূপ’ প্রবন্ধটির কথা এসেছে কারাগারের রোজনামচায়। শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ উপন্যাসটি ১৯৬৬ সালে কারাগারে বসে বঙ্গবন্ধু লিখছেন: ‘বন্ধু শহীদুল্লাহ কায়সারের সংশপ্তক বইটি পড়তে শুরু করেছি। লাগছে ভালই...।’

শুধু পঠনপাঠন নয়, তিনি লেখকদের সম্মান করতেন হৃদয় থেকে। স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রনায়ক হয়েও লেখকের সামনে তাঁর বিনয় অটুট ছিল। ১৯৭৪ সালে দেশের প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে প্রধান অতিথির পদ অলঙ্কৃত করার আমন্ত্রণ জানানো হলে তিনি তাঁর স্থলে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ও পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের নাম বলেছিলেন।

রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভেতর দিয়ে সদ্য-স্বাধীন দেশের সাহিত্যের স্বরূপ ও সাংস্কৃতিক চেতনা কেমন হতে পারে সে বিষয়েও তিনি দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। যে জাতি সংগ্রাম করে স্বাধীন হয়েছে সে জাতির শিল্প-সাহিত্য জনবিচ্ছিন্ন হতে পারে না। ১৯৭১ সালের ২৪ জানুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে ‘পূর্ব পাকিস্তান সংগীত শিল্পী সমাজ’ থেকে বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা দেওয়ার অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন :

‘দেশের গণমুখী সংস্কৃতিকে বিকশিত করার উদ্দেশ্যে সাহিত্য-সঙ্গীতে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা, সুখ-দুঃখকে প্রতিফলিত করতে হবে। সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। তাই মাটি ও মানুষকে কেন্দ্র করে গণমানুষের সুপ্ত শক্তি ও স্বপ্ন এবং আশা-আকাক্সক্ষাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠবে বাংলার নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি।’

শুধু লেখকশিল্পীদের জন্য না, চলচ্চিত্র নির্মাদের জন্যও তিনি উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন। স্বাধীন বাংলায় নাট্যান্দোলনেও তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

 

 

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি