Loading..

শিক্ষায় অগ্রযাত্রা

২৫ অক্টোবর, ২০২০ ১২:৩৬ অপরাহ্ণ

শিক্ষায় চতুর্থ শিল্প বিপ্লব

‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় ট্যাক্সি কোম্পানি উবারের নিজের কোনো ট্যাক্সি নেই, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিডিয়া ফেসবুক নিজে কোনো কনটেন্ট তৈরি করে না, পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাইকার আলিবাবার কোনো গুদাম নেই এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় Housing প্রোভাইডার AIRBNB নিজেদের কোনো রিয়েল এস্টেট নেই।’ কথাগুলো টম গুডউইনের।

বিশ্বব্যাপী চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বোঝানোর জন্য টম গুডউইনের এই বাক্যগুচ্ছের ব্যবহার হয় সবচেয়ে বেশি। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এমন কিছু, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। অপরিচিত মোটরসাইকেল চালকের পেছনে বসে আমাদের যাত্রীরা যাতায়াত করেন, কেনাকাটায় রকেট-বিকাশ এখন অনেকের সঙ্গী, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ‘বাস্তব’ নির্বাচনে সবচেয়ে প্রভাব ফেলেছে ‘ভার্চ্যুয়াল ফেসবুক’। এসবই সম্ভব হচ্ছে কারণ বাস্তব আর ভার্চ্যুয়াল জগৎ একাকার হয়ে যাচ্ছে।

২০১৬ সাল থেকে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের কর্তাব্যক্তি ক্লাউস শোয়াইব প্রথম চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বিপ্লবের কথা বলতে শুরু করেন। প্রথম শিল্প বিপ্লব হয় ১৭৬০ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে যা উৎপাদন শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটায়। দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবটি হয়েছে ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের মাধ্যমে যা উৎপাদন শিল্পে আমূল পরিবর্তন আনে।

১৯৬০ সালে ইন্টারনেটের আবির্ভাবে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের সময় তথ্যপ্রযুক্তির সহজ ও দ্রুত বিনিময় শুরু হলে সারা বিশ্বের গতি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ম্যানুয়াল জগৎ ছেড়ে যাত্রা শুরু হয় ভার্চুয়াল জগতের। আমরা এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে দাঁড়িয়ে আছি। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ধারণাটি প্রথম এপ্রিল, ২০১৩ সালে জার্মানিতে আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপিত হয়েছিল। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবটি মূলত তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বিপ্লব। তাই কল কারখানাগুলোতে ব্যাপক হারে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে।

শুধু কলকারখানাই নয়, যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও আসছে আমূল পরিবর্তন। আগের শিল্প বিপ্লব গুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে মানুষ যন্ত্রকে পরিচালনা করেছে। কিন্তু ৪র্থ বিপ্লবে যন্ত্রকে উন্নত করা হয়েছে। যার ফলে যন্ত্র নিজেই নিজেকে পরিচালনা করতে পারবে।

এমনিতেই মানুষের থেকে যন্ত্রের ধারণ ক্ষমতা অনেক বেশি এবং যন্ত্র অনেক নিখুঁত ও দ্রুত কাজ করতে পারে। ইতোমধ্যে ইন্টারনেট প্রযুক্তি, রোবোটিক্স ও অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন রোবট, ন্যানো প্রযুক্তি, মেশিন লার্নিং ইন্টারনেট অব থিংস, ব্লক চেইন প্রযুক্তি, থ্রি-ডি প্রিন্টিং, কোয়ান্টাম কম্পিউন্টিং, উন্নত মানের জিন প্রযুক্তি, নতুন ধরনের শক্তি যে অভাবনীয় পরিবর্তনের সূচনা করেছে, তাতে এই বিপ্লবের ব্যাপ্তি ও প্রভাব আগাম জানান দিচ্ছে মানব সভ্যতার সমৃদ্ধ গন্তব্য ।

পরিবর্তন আবশ্যক , এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে দেশের সরকারী, বেসরকারী, একাডেমিসহ সব খাত এবং নাগরিকদের সম্মিলিতভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। পাঁচ কোটি লোকের কাছে রেডিওর পৌঁছাতে সময় লেগেছে ৩৮ বছর, টেলিভিশনের ১৩ বছর। অথচ ইন্টারনেটের লেগেছে ৪ বছর। আইপডের জন্য সময়টা মাত্র ৩ বছর আর ফেসবুকের ২৪ মাস।


ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বেশ কিছুদিন ধরে চলমান ও আগামীর জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার একটি তালিকা করে চলেছে। গুরুত্ব অনুসারে এমন ১০টি দক্ষতা হলোঃ জটিল সমস্যা সমাধান, দুত চিন্তা, সৃজনশীলতা, জন-ব্যবস্থাপনা, অন্যদের সঙ্গে কাজের সমন্বয়, আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা, বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সেবা প্রদানের মানসিকতা, বার্গেনীয় পাওয়ার এবং চিন্তায় স্বচ্ছতা। বলা বাহুল্য, এগুলো বিষয় বা জ্ঞানভিত্তিক দক্ষতাকে স্বীকার করে এটিকে জোরদার করে। মূল কথা হলো, আগামী দিনের পেশাজীবীকে নিজ দক্ষতার পাশাপাশি সেটিকে প্রকাশযোগ্য করে তোলা, তার কাজের ফলে সামাজিক সমস্যার সমাধান এবং সর্বজনীন মঙ্গলের ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হবে।

পরিবর্তিত পরিস্থিতে একমাত্র তথ্যপ্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তিরাই টিকে থাকবে। আমাদের দেশে কারিগরি দক্ষ জনবল মাত্র ১৪%। কিন্তু উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই সেখানে কারিগরি ভাবে দক্ষ জনগোষ্ঠী প্রায় ৬০%। তাই আমদের এখন থেকেই একটি সুপরিকল্পনার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে। দেশে কারিগরি দিক থেকে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে হবে।

তাই শুধু শিক্ষিত নয়, দেশে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার দিকে মনযোগ দিতে হবে। শুধুমাত্র দেশেই নয়, যারা বিদেশে কাজ করছে তাদেরকেও যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে পাঠাতে হবে। বিদেশে আমাদের ১ কোটি শ্রমিক আয় করেন ১৫ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ভারতের ১ কোটি ৩০ লাখ শ্রমিক আয় করেন ৬৮ বিলিয়ন ডলার। কর্মক্ষেত্রে আমাদের শ্রমিকদের অদক্ষতাই তাদের আয়ের ক্ষেত্রে এই বিরাট ব্যবধানের কারণ। সঙ্গত কারণেই আমাদের উচিত কারিগরি দক্ষতার উপর জোর দেয়া। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনাটাও জরুরি।

দুই দশক আগেও কোনো কোনো সমস্যার সমাধানে তথ্যের প্রাপ্যতা এবং তার প্রয়োগ ছিল সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখন হাতের মুঠোয় তথ্যের প্রাপ্যতা সমাধানকারীকে ‘তথ্য মুখস্থ’ রাখা থেকে মুক্তি দিয়েছে। ফলে, সমাজ এখন আর তার কাছে উগান্ডার রাজধানীর নাম মুখস্থ রাখার যোগ্যতা আশা করে না। বরং উগান্ডায় ‘পুকুর কাটার জ্ঞান কীভাবে আমাদের দেশের পুকুর কাটাতে কাজে লাগানো যাবে’, সে বিষয়ে প্রযুক্তিগত কলা-কৌশল আশা করে।

আগামী দিনের সৃজনশীল, দ্রুত চিন্তার অধিকারী, সমস্যা সমাধানে পটু জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার উপায় হলো শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজানো, যাতে এ দক্ষতাগুলো শিক্ষার্থীর মধ্যে সঞ্চারিত হয় এবং কাজটি করতে হবে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি