Loading..

উদ্ভাবনের গল্প

১২ এপ্রিল, ২০২১ ১১:৩৩ অপরাহ্ণ

করোনাকালে শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেটের অপব্যবহার ও আমাদের করণীয়

করোনাকালে শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেটের অপব্যবহার ও আমাদের করণীয়




১৭ মার্চ ২০২০ থেকে করোনা মহামারিজনিত কারণে সারা দেশের স্কুল-কলেজগুলোর সরাসরি শ্রেণিপাঠদান বন্ধ রয়েছে। পড়াশোনা চালিয়ে নিতে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার শুরু হয় এপ্রিল মাস থেকেই। দেশের অগ্রগণ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষকদের দ্রুত এই নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইনভিত্তিক পাঠদান কর্মসূচি শুরু করে। করোনার বিস্তারের কারণে হোম কোয়ারেন্টিন, লকডাউন, জুম, গুগল মিট ইত্যাদির সঙ্গে আমাদের ছাত্রসমাজের দ্রুত পরিচয় ঘটে। করোনা ছড়িয়ে পড়ার আগে শিক্ষার্থীরা সীমিত পর্যায়ে শুধু বন্ধু বা পারিবারিক যোগাযোগ আর গেমস খেলার জন্য বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করত। অনলাইনে পড়াশোনা শুরু হওয়ায় তাদের সেসব যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে গিয়েছে। পড়াশোনার স্বার্থেই অনেক অভিভাবক সন্তানের হাতে ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, ট্যাব বা স্মার্ট মোবাইল তুলে দিয়েছেন।

সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা ও শিক্ষার্থীদের বাসায় অবস্থানের কারণে ইন্টারনেট ও ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর ব্যবহার কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অনলাইনে সংযুক্ত হওয়ার ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের বন্ধু এবং সহপাঠীদের সঙ্গে একসঙ্গে শিখতে পারছে। ইন্টারনেট ব্যবহারের ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় শিক্ষার্থীদের জন্য বিনোদনমূলক কার্যক্রম, সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধির অনুশীলন, তথ্য আদান-প্রদানসহ অনেক মূল্যবান ক্ষেত্রের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহারের সময়কে ‘স্ক্রিন টাইম’ বলা হয়। ইন্টারনেটের সুদূরপ্রসারী ব্যবহার থাকা সত্ত্বেও অতিরিক্ত ‘স্ক্রিন টাইম’ শিক্ষার্থীদের জন্য ক্ষতিকর। এর ব্যবহার যখন মাত্রা ছড়িয়ে যায় তখন এটা ‘আসক্তি’র পর্যায়ে পড়ে। এখানে সপ্তাহে ৩৮ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ইন্টারনেট ব্যবহার ও ইন্টারনেট ব্যবহার করতে না পারার কারণে বিষণ্নতা, আবেগ ধরে রাখতে ব্যর্থ হওয়াকে ‘আসক্তি’ হিসেবে পশ্চিমা গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।

ইন্টারনেট ও ডিজিটাল সামগ্রী হাতের কাছে পেয়ে তার অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে আমাদের ছাত্রসমাজ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডিজিটাল ডিভাইসের স্ক্রিন বা মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকায় চোখের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। ফলে অল্প বয়সী বাচ্চাদের আজকাল ভারী চশমা ব্যবহার করতে দেখা যায়। একটি উদাহরণ দিলে তা পরিষ্কার হবে—আমার কলেজের আবাসিক ছাত্ররা যারা সীমিত ইন্টারনেট ব্যবহার করে, তাদের তুলনায় অনাবাসিক ছাত্ররা, যারা মা-বাবার সঙ্গে বাসা থেকে কলেজে অধ্যয়ন করে তাদের চশমা ব্যবহারের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। ইন্টারনেট আসক্তির কারণে শিক্ষার্থীদের অনিদ্রা, ক্ষুধামান্দ্য, হজমে সমস্যা, ঘাড় ও কোমর ব্যথা, মোটা হয়ে যাওয়াসহ নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এই আসক্তি তাদের খিটখিটে মেজাজ, অল্পতেই ধৈর্যচ্যুতি, টেনশন বোধ, বিষণ্নতা, পারিবারিক সৌজন্যবোধের অভাবজনিত বিভিন্ন মানসিক সমস্যা তৈরি করছে।

আমাদের কোমলমতি সন্তানরা অনেক সময় না বুঝেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে নানাভাবে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। অনেক সময় শিক্ষার্থীরা সাইবার বুলিংয়ের শিকার হতে পারে। যার কারণে তারা মানসিক চাপ বোধ করে থাকে এবং নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আবার অনেক শিক্ষার্থী নিজেই অনলাইনে বুলিংয়ে জড়িত হতে পারে। ছাত্ররা অনেক সময় অপ্রীতিকর কোনো ছবি বা ভিডিও শেয়ার করতে পারে। অন্যের অনুমতি ছাড়াই তাদের ছবি শেয়ার করা, প্রতিশোধপরায়ণ আচরণ করা, অন্যকে হয়রানি করা, অপমান করাসহ বিভিন্ন অনৈতিক আচরণ করতে পারে। ফলে সাইবার অপরাধে জড়িয়ে বিভিন্ন ধরনের আইনের জটিলতায় পড়ে যেতে পারে। এ ছাড়া ছাত্রীরা অনেক সময় অনলাইনে যৌন হয়রানির শিকার হতে পারে।

ইন্টারনেটের অপব্যবহার রোধ এবং এর আসক্তি থেকে পরিত্রাণের জন্য শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ আমাদের শিক্ষকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। প্রথমত, শিক্ষার্থীদের বুঝতে হবে নিজের ভালোর জন্য এই ‘আসক্তি’ থেকে তাদের দ্রুত মুক্তি পেতে হবে। মন ভালো করার জন্য ডিজিটাল ডিভাইসের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনো। ইন্টারনেট আসক্তি দূর করতে ধীরে ধীরে কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের সময়সীমা নির্ধারণ করো। তোমাকে বুঝতে হবে যে ইন্টারনেট আসক্তি তোমার পরিবার এবং বন্ধুদের সান্নিধ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। নিজের সমস্যাগুলো নিজের মধ্যে গুটিয়ে না রেখে আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আলোচনা করো। পরিবার ও বন্ধুকে কাছে টেনে নাও। তাদের সঙ্গে টিভি দেখো, গল্প করো, খেলাধুলা করো। তোমার ডিজিটাল ডিভাইস ভাই-বোনদের ব্যবহার করতে দাও, এতে ধীরে ধীরে তোমার আসক্তির মাত্রা কমে যাবে। তোমার দৈনন্দিন রুটিনে পরিবর্তন আনো। প্রতিটি সকাল শুরু করো স্রষ্টার আরাধনা, ব্যায়াম বা প্রকৃতির সান্নিধ্যে। কম্পিউটার ব্যবহার করে বিনোদিত হওয়ার ছেলেমানুষি আবেগ পরিহার করার চেষ্টা করো। ইন্টারনেট আসক্তি দূর করতে প্রচেষ্টা শুরু করার পর ক্ষণে ক্ষণে নিজেকে স্মরণ করিয়ে দাও যে তুমি ইন্টারনেট আসক্তি দূর করতে চেষ্টা করছ।

এবার আসছি অভিভাবকদের করণীয় সম্পর্কে। সন্তানের লালন-পালনের পাশাপাশি তাকে সঠিক শিক্ষা দিয়ে সামনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ানো প্রত্যেক অভিভাবকের একমাত্র চাওয়া। শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট ও ডিজিটাল ডিভাইস আসক্তি কমাতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পরিবারের সহযোগিতা। তাকে পত্রিকা পড়ানো, বই পড়ানো, টিভিতে খবর দেখানো, গল্প করার মাধ্যমে বাস্তবজগতে নিয়ে আসতে হবে। ইন্টারনেটের কুফল থেকে সন্তানদের বাঁচাতে খেলাধুলা ও পরিবারের সদস্যদের সময় দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। সন্তান কখন কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে চলছে সে বিষয়ে খোঁজ নিতে হবে। সপ্তাহে অন্তত একদিন তাকে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যান। সন্তানকে গুণগত সময় দিন। সন্তানকে বিশ্বাস করুন। আপনি তার সবচেয়ে কাছের মানুষ, সঠিক পরামর্শদাতা; সেটা ওকে বুঝতে দিন। সন্তান যাতে আপনার সামনে মুঠোফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ ইত্যাদি ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, সেদিকে গুরুত্ব দিন। সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তাদের মানসিক বিকাশে সহায়তা করুন।

শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এটা গবেষণায় প্রমাণিত যে শিশুরা তাদের শিক্ষকদের আদেশ-নিষেধ পালনে অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ত। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট আসক্তি কাটাতে তাই শিক্ষকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। অনলাইনভিত্তিক পড়াশোনায় শুধু বিষয়ের ওপর লেকচার না দিয়ে ছাত্রদের মানবিক বিকাশে সহায়তা করাও শিক্ষকদের জন্য অপরিহার্য। ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে ছাত্রটি যদি কোনো জটিলতায় জড়িয়ে পড়ে, তাহলে কোথায় সহায়তা চাইতে হবে সেটা তাকে জানাতে হবে। ইন্টারনেটে কোনো অপ্রীতিকর ছবি বা ভিডিও দ্বারা যদি কেউ তাকে উত্ত্যক্ত করে, তাহলে কিভাবে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে সে সম্পর্কে তাকে পরামর্শ দিতে হবে। করোনাকালে পারিবারিক বন্ধন ও যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য অফলাইনে থেকেও বিভিন্ন রকমের ঘরোয়া খেলাধুলা, ব্যায়াম, মানসিক প্রশান্তির জন্য চর্চা করা, শখের কোনো কাজ অনুশীলন করা, গল্পের বই পড়তে উৎসাহিত করতে হবে। ইন্টারনেট আসক্তি থেকে রেহাই দিতে তরুণদের সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। ছাত্রদের ইন্টারনেটের অপব্যবহারজনিত কারণে কী ধরনের অপরাধ ঘটতে পারে এবং এসংক্রান্ত আইনগুলো; যেমন—ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১২ ইত্যাদি শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে।

আমাদের প্রিয় শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুরক্ষিত আছে কি না সেটা বুঝতে হবে। তারা ইন্টারনেট ব্যবহারে নিরাপত্তাবোধ করছে কি না, বয়সোপযোগী প্ল্যাটফর্ম বা ওয়েবসাইটগুলো তারা ব্যবহার করছে কি না এবং সামাজিক মিডিয়ায় তারা কতটুকু নিরাপদ থাকছে; সে বিষয়ে সবার খেয়াল রাখা দরকার। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করার সময় তাদের মতামত প্রকাশকে উৎসাহিত করতে হবে। আলোচনা করার পরিবেশটা যেন সব সময় উন্মুক্ত থাকে। ইন্টারনেটে সে কোন বিষয়গুলোতে আগ্রহী তা জানা এবং বোঝার চেষ্টা করতে হবে। ইন্টারনেটে এমন সব গেমস বা application নির্বাচন করতে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে হবে, যেগুলো তাদের সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করবে। ইতিবাচক সামাজিক মূল্যবোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহানুভূতি, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, বিশ্বস্ততা ইত্যাদি একজন শিক্ষার্থীকে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিরাপদ রাখতে সহায়তা করবে বলে আমি মনে করি।

আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিকভাবে তৈরি করার জন্য এই মহামারি পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিবারের ও শিক্ষকদের সহনশীল আচরণ করা প্রয়োজন। ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে শিক্ষার্থীরা যেমন প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করতে পারছে, তেমনি পর্যাপ্ত ইন্টারনেট ব্যবহারে সে যেন যত্নশীল থাকতে পারে সে ব্যাপারে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। আশা করি ডিজিটাল বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকরা ইন্টারনেটের কুপ্রভাব থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে পরিবারের ও সমাজের মধ্যে মুখ উজ্জ্বল করে সামনে এগিয়ে যাবে।