লাহোর,বর্তমান পাকিস্তান
এক ভাগ্য বিড়ম্বিত জীবন পেরিয়ে ক্ষমতার শীর্ষতম স্থানে অধিষ্ঠানের এমন কুশলী কৃতিত্ব নূরজাহান ছাড়া খুব কম নারীই বিশ্ব ইতিহাসে দেখাতে পেরেছেন। তার জন্ম হয়েছিল ১৫৭৭ সালে কান্দাহারের কাছে, বর্তমান আফগানিস্তানে। তার পরিবার ছিল ইরানের এক অভিজাত বংশের উত্তরাধিকার। কিন্ত পারস্যের সাফাভিদ রাজবংশের অসহিষ্ণুতার কারণে তাদের সেখান থেকে পালিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যে এসে আশ্রয় নিতে হয়।
পিতা-মাতার জন্ম স্থানের ঐতিহ্য আর মুঘল রীতি-নীতি, এই দুটির আবহে বেড়ে উঠেন তিনি। তার প্রথম বিয়ে হয় এক মুঘল রাজকর্মচারীর সঙ্গে। তার স্বামী ছিলেন এক সেনা কর্মকর্তা। স্বামীর সঙ্গে তিনি পূর্ব ভারতের বাংলায় চলে আসেন। সেখানেই তার একমাত্র ছেলের ও কন্যার জন্ম হয়। তবে এক বিদ্রোহে জড়িত থাকার অভিযোগে নূরজাহানের স্বামীর চাকুরি যায় ও তিনি নিহত হন।
বিধবা নূরজাহানকে পাঠানো হয় রাজধানী আগ্রার মুঘল হারেমে। সেখানে তিনি অন্য মুঘল নারীদের আস্থা এবং বিশ্বাসের পাত্র হয়ে উঠেন। ১৬১১ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর তাকে বিয়ে করেন। তিনি ছিলেন জাহাঙ্গীরের বিশতম পত্নী। জাহাঙ্গীর যুবরাজ সেলিম নামেও পরিচিত এবং তিনি আনারকলির সঙ্গে বিয়োগান্ত প্রেমে জড়িত ছিলেন।
আরও পড়ুন: আনারকলির সেলিম, নূরজাহানের জাহাঙ্গীর
নূরজাহান সম্রাট জাহাঙ্গীরের দেওয়া নাম। মূল নাম মেহেরুননেসা পাল্টে তার নামকরণ করা হয় নূরজাহান বা জগতের আলো। ইংল্যান্ডে রাণী প্রথম এলিজাবেথের জন্মের কয়েক দশক পরে তার জন্ম। কিন্তু রাণী এলিজাবেথের চেয়ে অনেক বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ এক সাম্রাজ্য শাসন করেছেন তিনি।
ষোড়শ শতকের শুরু হতে পরবর্তী প্রায় তিনশ' বছর ধরে ভারতবর্ষ শাসন করেছে মুঘলরা। তারা ছিল ভারতের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী রাজবংশ। মুঘল সম্রাট এবং মুঘল রাজপরিবারের নারীরা ছিলেন শিল্প, সঙ্গীত এবং স্থাপত্যকলার বিরাট সমঝদার। তারা বিশাল সব নগরী, প্রাসাদোপম দূর্গ, মসজিদ এবং সৌধ তৈরিতে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। যাদের অগ্রগণ্য নূরজাহান।
তিনিই সমগ্র মুঘল রাজবংশের একমাত্র নারী শাসক, যার স্মৃতি ও অবদান ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশে ছড়িয়ে রয়েছে। লাহোরের জাহাঙ্গীরের সমাধিসৌধের নির্মাতা তিনি, একমাত্র এ স্থাপনাকেই তুলনা করা হয় অনন্য তাজমহলের সঙ্গে এবং এটি ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্বঐতিহ্য স্থাপনা রূপে স্বীকৃত। আগ্রার মুঘল হেরেমে তিনি বাংলা-মহল তৈরি করেছিলেন। পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন বাংলার জগদ্বিখ্যাত মসলিনকে। 'আবে রোঁওয়া' ও 'বেগম খাস' নামে মসলিনের দুটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের উদ্গাতা তিনি।
ফলে উত্তর ভারতের আগ্রা এবং উত্তর পাকিস্তানের লাহোর, মুঘল আমলের দুটি বড় নগরীতে নূরজাহানের কীর্তি ও কাহিনী সম্পর্কে শোনা যায় অনেক কিংবদন্তী। আর তিনিই একমাত্র মুঘল রমণী ও সম্রাজ্ঞী, যার শৈশব-কৈশোর ও যৌবনের কিয়দাংশ কেটেছে বাংলায়। বাংলার সঙ্গে নূরজাহান ছাড়া অন্য কোনো মুঘল রমণীর বিশেষ সংযোগ ছিল না।
সাহসী নূরজাহান শিকার করেছেন ও স্বামীর পক্ষে অস্ত্রধারণ করে যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছেন। একটি মানুষ খেকো বাঘকে মেরে রক্ষা করেছেন একটি গ্রামের মানুষকে। তিনিই একমাত্র মুঘল সম্রাজ্ঞী, যিনি 'দেওয়ান-ই-খাস'-এ উপস্থিত হয়ে জনগণের অভাব-অভিযোগ শুনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। কেবলমাত্র তারই ছিল রাজকীয় আদেশ সম্বলিত ফরমান জারির ক্ষমতা।
যোদ্ধা-মুঘলদের পুরুষশাসিত ব্যবস্থায় নূরজাহান ছিলেন এক অসাধারণ ক্ষমতাবান নারী। কোন রাজকীয় পরিবার থেকে তিনি আসেননি। কিন্তু তারপরও সম্রাটের হারেমে তার উত্থান ঘটে এক দূরদর্শী রাজনীতিক হিসেবে। তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীরের সবচেয়ে প্রিয়তম স্ত্রীতে পরিণত হন। বিশাল মুঘল সাম্রাজ্য আসলে তিনি এবং সম্রাট জাহাঙ্গীর মিলে একসঙ্গেই শাসন করতেন। খানিক ভোগপ্রবণ ও রিপু-তাড়িত সম্রাট জাহাঙ্গীরকে নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি।
নূরজাহানের প্রেম, সাহসিকতা ও ক্ষমতার অনেক কাহিনী ছড়িয়ে আছে। মুঘল প্রাসাদের অন্দরমহলে তার রাজনৈতিক ক্ষমতা, প্রতিপত্তি এবং আকাঙ্খার সম্পর্কে রয়েছে বহু উপাখ্যান। তদুপরি তিনি ছিলেন একজন কবি, একজন দক্ষ শিকারি এবং খুবই সৃজনশীল এক স্থপতি। আগ্রায় তার তৈরি করা নকশাতেই নির্মাণ করা হয়েছিল তার বাবা-মার সমাধি সৌধ। পরে এই স্থাপত্য রীতিই নাকি তাজমহলের স্থাপত্য নকশার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। উপমহাদেশে পারস্য স্থাপত্যকলা, শিল্প, সংস্কৃতি, রন্ধন, চিত্রকলার প্রধান স্থপতি রূপে গণ্য করা হয় সম্রাজ্ঞী নূরজাহানকে।
তবে শেষ জীবনে রাজনৈতিক চালে পরাজিত হন তিনি। তার পছন্দের উত্তরাধিকার শাহজাদা খুররম বা সম্রাট শাহজাহান ছিলেন না, ছিলেন অপর পুত্র খসরু। কিন্তু শক্তিবলে শাহজাহান ক্ষমতা দখল করেন এবং প্রতিদ্বন্দ্বী ভাই খসরুকে অন্ধ করে হত্যা করেন। স্বাভাবিকভাবেই সম্রাজ্ঞী নূরজাহান ক্ষমতার বৃত্ত থেকে ছিটকে পড়েন।
ফলে নূরজাহান রাজনীতি ও ক্ষমতার বলয় থেকে নির্বাসিত হন। তিনি চলে আসেন লাহোরে প্রিয় স্বামী জাহাঙ্গীরের সমাধিসৌধে। ধর্ম-কর্ম ও দান-খয়রাত করে কাটে তার অন্তিমকাল। মৃত্যুর পর তাকে স্বামী জাহাঙ্গীরের সমাধিসৌধে শেষশয়নে শায়িত করা হয়।
মতামত দিন