Loading..

প্রকাশনা

১৯ জুলাই, ২০২১ ০২:৪০ অপরাহ্ণ

শিশুকে স্বপ্ন দেখতে শেখান সে দেখবেন ঠিকই এগিয়ে যাবে

  আমাদের বিদ্যালয়ের ছাত্রী নাম তার সায়বা।সায়বা চতুর্থ শ্রেনীতে পড়ে।সে অন্য সবার চেয়ে একটু আলাদা।যে কেউ ক্লাসে কিছুক্ষন অবস্থান করলেই  সবার নজরে পড়ার এক অসম্ভব ক্ষমতা আছে তার।সেই প্রাক প্রাথমিক ক্লাস থেকেই এ বিষয়টি আমি খেয়াল করছি।সব সময় চুপচাপ থাকে।অপ্রয়োজনে কোন কথা বলেনা।এত বছরে তার নামে কোন অভিযোগ শুনিনি। কম কথা বলে, হয়ত তাই তার কন্ঠটা এত মিষ্টি। আমার ছোট মেয়ের নামও সায়বা। দুজনের মধ্যে অদ্ভুত মিল।আমার মেয়টার মত সেও আমাকে অনেক ভালবাসে। ওর বাবা মা স্কুলে আসলেই বলবে সায়বা বাড়িতে সারাক্ষন আপনার কথা বলে।কোন কিছু করতে নাচাইলে আপনার কথা বল্লেই সে খুশি মনে সোই কাজ করে ফেলে।

     বিশ্বব্যাপী Covid 19 এর ভয়াল থাবায় সারা বিশ্বের আকাশ বাতাস যখন ভারী হয়ে উঠেছ  মৃত্যু আর লাসের গন্ধে ঠিক সেই সময়ই আগাম সতর্কতার জন্য সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষনা করা হয়। তারিখটা ছিল এ বছরের ১৬ ই মার্চ। আমরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে সেদিন  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জন্ম শত বার্ষীকী উৎযাপনের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।খবরটা তাই আমাদের কারও কাছেই ভাল লাগেনি। ততক্ষনে আমরা বিদ্যালয় সাজানোর জন্য রঙ্গীন কাগজ কেটে নানা রকম নকশা তৈরী করে, রং বেরঙ্গের বেলুন ফুলিয়ে শ্রেনীকক্ষ সজ্জিত করনের শেষ পর্যায় তাই হয়ত সবার মন একটু বেশিই খারাপ।

    কেউ একজন এসে আমাকে খবর দিল সায়বা খুব কান্না করছে। আমি শোনেই দৌড়ে গেলাম শ্রনীকক্ষে। গিয়ে দেখি সায়বা কান্না করে চোখমুখ লাল করে ফেলেছে তাকে এত জিজ্ঞাসা করি কি হয়েছে,কেউ মেরেছে কিনা,সে কান্নার জন্য কোন কথাই বলতে পারছেনা। তাকে অফিস কক্ষে নিয়ে গেলাম  সকল শিক্ষকরা  জিজ্ঞাসা করছে কি হয়েছে? তার মুখে কোন কথা নেই সে সুধু কেঁদেই চলেছে। আমিযে তার কান্নার কারন কিছু বোঝতে পারিনি ঠিক তা নয়।তারপরও তার মাকে ফোন দেওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেেই সে আসার পর সবাই জানতে পাড়ল তার কান্নার রহস্য।ঠিক আমি যেমনটা ভেবেছিলাম তাই।তাকে ফাইভে পড়ুয়া তার চাচাত ভাই বলেছে কাল থেকে স্কুল বন্ধ,কবে খুলবে তার কোন ঠিক নাই।এটা শোনার পর থেকে সেইযে

কান্না আর থামার নাম নেই।অথচ প্রাক প্রাথমিকে যখন ভর্তি হয়েছিল,  সে বিদ্যালয়ে আসার সময় হলেই কান্নাকাটি করত। তারপর আমি চিন্তা করলাম কিভাবে বিদ্যালয়ের প্রতি তার আগ্রহ বৃদ্ধ করা যায়।তারমত যারা প্রথম বিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় পা দিয়েছে তাদের জন্য খেলতে -খেলতে,  ছড়ায়-ছড়ায়, গানে- গানে, আনন্দ- বিনোদনের মাধ্যমে পড়ানো শুরু করলাম।ফলও পাওয়া গেল কয়েক দিনের মধ্যেই। সকল শিক্ষার্থীর মত সায়েবারও বিদ্যালয়ের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি । সপ্তাহে দুই দিন করে বিভিন্ন ক্লাসে রুটিন মত মাল্টিমিডিয়া ক্লাস   করি।যেদিন প্রাক প্রাথমিকে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস থাকে দেখলাম শিশু শ্রেণির শিক্ষার্থীদের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি।যাইহোক শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনা দিয়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত তা অবশ্যই সময় উপযোগী। সবার কাছে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম বাড়িতে। 

কয়েকদিন অতিবাহিত গওয়ার পর বাড়িতে থাকতে থাকতে এখন আর ভাল লাগছিলনা।মনে হচ্ছে স্কুল কবে খোলবে। চারদিকে ভয়ংকর অবস্থা কেউ অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের হয়না।বিদ্যালয় বন্ধ, অফিস আদালত বন্ধ। সবাই অনেকটা ঘরবন্ধী অবস্থা। কেউ এর আগে এমনটি আর দেখেছে কখনো! মাথায় সব এলোমেলো চিন্তারা ঘোরপাক খাচ্ছে, কি হচ্ছে কি হবে, ঠিক সেসময় সায়বার আম্মুর ফোন। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে সায়বার মিষ্টি কন্ঠ,স্যার কেমন আছেন? স্কুল কবে খুলবে? আমাদের কি অনলাইনে ক্লাস হবে? আমি ভাল আছি কিন্তু তোমার এতগুলো প্রশ্নের উত্তর একসাথে কিভাবে দিব। ওর আম্মু আমাকে বল্ল মোবাইল হাতের কাছে পেলেই সে আমাকে ফোন করতে চায়। সারাক্ষন জিজ্ঞাসা করে বিদ্যালয় কবে  খুলবে।

কথাগুলো শুনে আমার খুব ভাল লাগল। মনে হল আমার শিক্ষকতা জীবনটা মনে হয় স্বার্থক হয়েছে।কিছুদিন পর নির্দেশনা আসল অনলাইনে ক্লাস করতে হবে। শিক্ষার্থীদের শ্রেনী ভত্তিক মেসেন্জার গ্রুপ খুলতে হবে।জুম এ্যপে তাদের ক্লাস নিতে হবে। ফোন করে শিক্ষার্থীদের সাথে পড়া দিতে হবে আবার পড়া নিতে হবে। কথামত কাজ শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ করে ফেসবুক, মেসেন্জারে গ্রুপ করা হল। কয়েক দিন পরে আমি অবাক হয়ে গেলাম তৃতীয় শ্রেনীর একজন শিক্ষার্থী মেসেন্জার রুম ব্যবহার করে আমাকে ভিডিও কলে যুক্ত করেছে।হ্যা আমি সেই সায়বার কথাই বলছি। সে তার বাবার আইডি ব্যবহার করে নিজেই আমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করছে।জিজ্ঞাসা করলাম তুমি এতকিছু কোথা থেকে শিখলে?  জবাবে সে আমাকে বল্ল সে ইউটিউবে  টিউটরিয়াল দেখে দেখে শিখেছে। তার বাবা আমার কাছে নালিস করল সায়বা সারাক্ষন মোবাইল নিয়ে ব্যাস্ত।সে লেপটপ নিয়ে কাজ করতে চায় আপনি একটু নিষেধ করে দিবেন। ও আপনার কথা শোনবে।

আমি তার বাবাকে বল্লাম না আপনি তাকে লেপটপ ধরতে নিষেধ করবেন না। আপনি তাকে আরও উৎসাহিত করবেন আপনি এটাকে পজিটিভলি দেখেন।তাকে টাইপিং করতে দেন,বিভিন্ন শিক্ষামুলক এ্যপ আছে সে সম্পর্কে ধারনা দিন।বর্তমান যুগ আইসিরিটর যুগ। ডিজিটাল বাংলাদেশতো এদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যই। ছোটবেলা থেকে আইসিটিতে দক্ষ হতে পারলে,ভবিষ্যতে এর সুফল পাওয়া যাবে। সয়বার বাবা আমার কথায় অনুপ্রানীত হয়ে ধন্যবাদ জানালেন। সেদিন থেকে শুরু হল সায়বার আইসিটির হাতেখড়ি।

আমাকে ফোন করে, মেসেন্জারে কল করে বিভিন্ন তথ্য জানতে চায়। একদিন বল্ল স্যার জুম মিটিংয়ে হোস্ট হতে হলে কি করতে হয়।প্রথমে ভাবলাম বলব এটা তোমার দরকার নাই।তারপর চিন্তা করলাম সে যেহেতু হোস্ট হতে চায় সমস্যা কি।আমি তাকে জুম এ্যপ সম্পর্কে  বুঝিয়ে দিলাম। এবং তাকে ইউটিউব থেকে একটা লিংক দিয়ে দিলাম।  কয়েকদিন পরের কথা সেদিন ছিল মে মাসের ১ তারিখ। আামার মেসেন্জারে সন্ধা ৭ টায়  একটা জুম মিটংয়ে জয়েন করার জন্য সায়বা লিংক পাঠিয়েছে। আমি জয়েন করব লিখে তাকে রিপ্লাই দিলাম। সন্ধ্যার পর মেয়েদের নিয়ে একটু ঘুরনত বের হব, তারাও রেডি হচ্ছে আমার আর মিটং এর কথা মনে ছিলনা। ৭ টা ১৫ মিনিটে সায়বার আম্মু ফোন করে বল্ল স্যার একটু সায়বার সাথে কথা বলেন ও আপনার সাথে অভিমান করে আছে আপনার নাকি জুম মিটিং এ আসার কথা সেই সারাদিন অপেক্ষা করছে কখন ৭টা বাজবে।  কখন আপনার সাথে মিটিং করবে।আমার মনে পরে গেল মিটিং এর কথা।তাকে বল্লাম আচ্ছা আমি জয়েন করেই কথা বলছি।মেয়েদের রেডি হতে হতে একটু জয়েন করে লিভ নিয়ে নিব ভেবে লেপটপ নিয়ে বসলাম। জুম মিটিং এখন প্রতি দিনের কাজ।মিটিং না থাকলেও ক্লাসত নিতেই হয় তবে এই প্রথম আমার কোন ছাত্রী হোস্ট আর আমি তার জন্য জুমের ওয়েটিং রুমে অপেক্ষমান।৫ মিনিট হয়ে গেল আমাকে মিটিংয়ে একসেপ্ট করছেনা। এদিকে মেয়েরা রেডি হয়ে বসে আছে ঘুরতে যাবে।প্রতি বছর এই দনে আমি মেয়েদের নিয়ে একটু ঘুরতে বের হই।  লিভ নিয়ে নিব  ঠিক সে সময় দেখি আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একসাথে আমাকে উইস করে গেয়ে উঠল Happy birthday to you dear sir. আমি কি করব বুঝতে পারছিলামনা, আমি কি হাসব না কাদব,অবস্য আনন্দে আমার চোখেরএক কোনে পানি চলে এসেছিল। সায়বা ফসবুক থেকে জেনেছে আজ আমার জন্মদিন তার পর তার পরিচিত বিভিন্ন শ্রেনির শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ করে জুম মিটিংয়ের সিডিউল করে সবাইকে লিংক পাঠিয়েছে। তার বাবাকে দিয়ে স্যারের জন্মদিন পালন করবে বলে কেক আনিয়েছে।

আমি এতটুকু মেয়ের  এ কাজে এতটাই মুগ্ধ হয়েছি যে আমার মনে হচ্ছিল এটাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ জন্ম দিন।আমি সামান্য একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আমার অনেক বড় কিছু উদ্ভাবনের আর ক্ষমতা কি!তবে আমি এটুকু বলতে পারি প্রত্যেকটা শিক্ষক ইচ্ছা করলে সায়বার মত শত শত শিক্ষার্থীর ভেতরে লুকিয়ে থাকা যে সুপ্ত প্রতিভাটা ঠিকই জাগিয়ে তুলতে পারবে।তাহলে এটা কম বড় উদ্ভাবন হবেনা। বছরের শেষ ভাগে এসে সায়বা এখন MS word, Ms Excel, Power point,এর কাজ, Mail Id creat,  Mail আদান প্রদান Zoom, google meet এ ক্লাস করতে পারে। আমি তাকে সাহায্য করেছি Zoom Screen share করে কমান্ড গুলো দেখিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তার আগ্রহ ছিল বলেই পেরেছে। আমি যদি সেদিন তার বাবার কথায় তাকে মোবাইল লেপটপ ধরতে নিষেধ করতাম তাহলে তার আগ্রহটা ওখানেই শেষ হয়ে যেত।সে এখন সপ্ন দেখে আইটিতে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করবে। আমি তার এই সপ্নটাকেই উদ্ভাবন করেছি।সে যে তার ভবিষ্যতের সপ্ন দেখে আইসিটি নিয়ে তার  সপ্নটাই আমার উদ্ভাবন। মেয়ের আগ্রহ দেখে তার বাবা মাও খুশি।ওর বাবা সেদিন বলছে আমরা শিশুদের খারপের মাঝখান থেকে ভালটা গ্রহন করতে শেখালেই তারা ভাল মন্দ বুঝতে শিখবে।আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ আমার মেয়েটাকে যেভাবে আইটিতে দক্ষ করে তুলেছেন। আসলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমি যে কাজটা করি সব সময় তাদের উন্নত জীবনের সপ্ন দর্শনে তাদের উদ্ভূদ্ধ করি।তাই হয়ত সায়বার সপ্নটা উদ্ভাবন করতে পেরেছি। ওর এই সপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব এখন আপনাদের।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি