ঈদ মানেই আমার কাছে ছেলেবেলার স্মৃতি। আমার ঈদের দিন মানেই ছিল ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পরে গোসল করা আর নতুন জামা গায়ে দিয়ে ঈদগাঁহে যাওয়া।
আমাদের গ্রামে রাস্তায় সেদিন আইসক্রিমওয়ালাদের দেখা মিলিত। ওই একদিন আট আনা দামের নারকেলি বরফ বা শক্ত কোন আইসক্রিম না হয় আমরা ১টাকা দামের পোলারের চকোবার খেতাম। তা ছাড়াও ঈদগায় যাওয়ার রাস্তায় ছোট ছোট ছেলেরা বুট বিরানী,আলু সিদ্ধ নিয়ে বসা থাকত।
বেলুনওয়ালারা রং-বেরং এর বেলুন সাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। ছেলে-মেয়েরা ভিড় করে তাদের কাছ থেকে এক টাকা দামের বাঁশি আর রঙিন চশমা কিনত। আরও পাওয়া যেত এক টাকায় প্লাস্টিকের হাতঘড়ি। ছেলে-মেয়েরা নতুন জামার সঙ্গে রঙিন চশমা আর হাতঘড়ি পরে বাঁশি ফুঁকে ফুঁকে রাস্তার এমাথা থেকে ওমাথা চক্কর দিত।
চারদিকে পোঁ পোঁ বাঁশির আওয়াজে আমার মাথা ব্যথা হত। কিন্তু বিকেল গড়াতে গড়াতে যখন বাঁশির আওয়াজ থেমে যেত, মনটা উদাস হয়ে যেত, ঈদ শেষ!
ঈদের দিন নতুন কাপড় সাট/ পেন্ট পেতাম আক্তার ভাই,পাঞ্জাবী হেলাল ভাই। টাকা পেতাম দানা ভাই ও দুলাল ভাইয়ের নিকট থেকে।মাঝে মাঝে ভাবীদের নিকট থেকে ও পেয়েছি। আর আমার আম্মা ছিল আমার জন্য টাকার গাছ। আম্মার নিকট থেকে কত টাকা নিয়েছি তা আল্লাহ ই ভালো যানেন।
মহল্লায় সব ছেলেরা দলবেঁধে বেড়াতে বের হতো, সবার বাহারি জামা কাপড় বেশ ভালই দেখাত। আমার ছোট্র বেলার বন্ধুদের মাঝে
অন্যতম ছিল আব্দুল আওয়াল,সফিক (বড় ভাই) নাজমুল,ওবায়দুল ও রফিক ,ক্লাস ৫ম শ্রেণীর পর আরও এক নতুন বন্ধু পেলাম ফজলুল হক(পছন)কে আবর ক্লাস ৮ম শ্রেণীতে আরও একজন নতুন বন্ধু আমাদের সাথে যুক্ত হলো শাহ আলম । ঈদের দিন সবাই মিলে যখন হাটতে যেতাম তখন আওয়াল , পছনকে বলত তোমাকে আমরা ফজলুল হক ডাকব যদি আমাদের কে খাওয়াও । তখন সব বন্ধুরা এক কথা খাওয়াতেই হবে। একবার যখন খাওয়ায় ই ফেলল এই সুযোগ প্রায়ই আমরা গ্রহন করতাম।
এরপর শুরু হতো মহল্লার বাড়ি বাড়ি ঘুরতে যাওয়া। প্রতি বাড়িতেই আমাদের বন্ধু ছিল বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ানো কারু বাসায় আমাদের পছন্দের খাবার থাকলে খেতে মিস করতাম না। আমাদের সময় গ্রামের ( নবীপুর,লাপাং ও দড়িলাপাং) তিনটি গ্রামের প্রত্যে পাড়ার ছেলেদের সাথে সু-সম্পর্ক ছিল ।
আমাদের সবার মাঝে সেলিম কাকা (বিমা কম্পানীতে চাকুরীরত) ছিল আমার মনে হয় তিনি পকেটে টাকা নিয়ে ভেড় হতো আমাদেরকে খাওয়ানোর জন্য তিনাকে না বললে খাওয়াতনা বললে আর মিস করত না।আমার ও একই অবস্থা এমনিতে খাওয়াতাম না আমি অপেক্ষায় থাকতাম কখন ওরা বলে খাওয়ানোর কথা। আমাদের বন্ধুদের মাঝে দুটি ভাগ ছিল শাহ আলম ও পছন ওরা ছিল একটি গ্রূপে আমি আর আওয়াল ছিলাম একটি গ্রূপে নাজমুল ছিল কখনো আমাদের সাথে আবার কখনো পছনদের সাথে নাজমুল ছিল কিছুটা রসিক প্রকৃতির একবার নাজমুল ফিটকারী খাওয়াছিল তাল মিছরির পরিবর্তে পছনকে সে টা আমরা খুব মজা করতাম। আমরা কোলা বা স্প্রাইট কিনতাম। কাচের বোতলের কোলা, সে বোতল বাড়ি আনা যেত না। আমরা দোকানে বসে বসে স্ট্র দিয়ে কোলা টানতাম। সে কি ঝাঁজ! একা একটা ছোট বোতল কোলা টানা অসম্ভব হয়ে যেত। মন খারাপ করে তলানিতে অনেকটা কোলা ফেলে রেখেই বাড়ি ফিরতাম।
ঈদের স্মৃতি বলতে আমার এটুকুই। বড়বেলায় ঈদ আর আলাদা কোন আবেদন তৈরি করতে পারেনি। আমার কাছে ঈদের দিন মানে চারদিকে বাঁশির পোঁ পোঁ শব্দ। বাঁশির শব্দ যত কমে এসেছে, আমার কাছে ঈদের আবেদনও তত কমে এসেছে।
মহানবী (সা) এর বিদায় হজের ভাষণ থেকে শিক্ষানিয়ে সমতা প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়েছি। বর্তমানে আমাদের বাসার সাহায্যকারী মেয়ে ও আমাদের মেয়েদেরকে একই মূল্যের একইরকম জামা ঈদে কিনে দিয়ে সমতা প্রতিষ্ঠা করেছি। সংসারে সবক্ষেত্রে আমার সন্তানের মতই লালন পালন করছি। তাছাড়াও ঈদে বাসার ছোট বাচ্চাদেরকে সালামি দিতে ভুলিনি। আমাদের বন্ধুদের সেই ছেলে বেলার সু-সম্পর্ক টুকু অটুট থাকুক অমলিন। আমাদের মতো সু-সম্পর্কে ভরে থাকুক বর্তমান প্রজম্মের ছেলেদের মাঝে।
এবারের ঈদের তেমন কোন আবেদন নেই আমার কাছে। ঈদের দুই আনন্দ, ভালো খাবার আর নতুন কাপড়। এবার হাজার হাজার মানুষ দুইবেলার ভাত জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে। রাস্তায় নামলেই অনাহারী মানুষের আর শিশুদের ভিক্ষার জন্য পাতা হাত দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত।
মহান রাব্বুল আলামিনের নিকট প্রার্থনা করোনা নামক মহামারী থেকে দেশ ,জাতী ও বিশ্বর্কে মুক্ত করুন।