Loading..

প্রকাশনা

৩০ জুলাই, ২০২১ ০৮:২৯ অপরাহ্ণ

শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি নয় মানেও দৃষ্টি দিতে হবে

শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি নয় মানেও দৃষ্টি দিতে হবে

দেশে উচ্চশিক্ষাদানকারী প্রথম প্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজ। ১৮৪১ সালে এটি স্থাপিত হয়। এর ১৬ বছর পর ১৮৫৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয় কলকাতায়। ইংরেজ আমলে কলকাতা, বোম্বে ও মাদ্রাজ- উপমহাদেশের এ তিনটি প্রসিদ্ধ শহর প্রেসিডেন্সি টাউনের মর্যাদা পায়। একই সময় (১৮৫৭) কলকাতার মতোই মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই) ও বোম্বেতেও (মুম্বাই) আরও দুটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়।

তবে গোটা ইংরেজ আমলে পূর্ববঙ্গ তথা ব্রিটিশ-বঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থা; বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার স্তরটি আবর্তিত হয় প্রধানত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে। ৬৪ বছর পর আমাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার খানিকটা অবসান হয় ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে।

ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে পূর্ববঙ্গবাসীর সে কী আনন্দ আর উল্লাস, একইসঙ্গে স্বস্তিও; এখন থেকে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা করতে আর কলকাতায় যেতে হবে না। ঢাকায়ই তা সম্ভব এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণায় ঢাকা হবে এ অঞ্চলের সমৃদ্ধ এবং মর্যাদাসম্পন্ন জনপদ। কিন্তু হলে কী হবে; নানা সীমাবদ্ধতা ও বাস্তব কারণে (কিছুটা সংকীর্ণতাও থাকতে পারে) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু থেকেই অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।

আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে গড়ে উঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফিলিয়েটিং ক্ষমতা ছিল না। ফলে ঢাকা শহর ও আশপাশ এলাকার মাত্র সাতটি কলেজ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্তিয়ারভুক্ত। সারা দেশের বাকি সব কলেজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন এনে আবাসিকের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এফিলিয়েটিং মর্যাদা দেওয়া হয়। ফলে এতদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা দেশের অন্তত ৫২টি কলেজ নতুন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনা হয়।

শুধু কলেজ নয়, ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্তির আগ পর্যন্ত সারা পূর্ববঙ্গের মাধ্যমিক পর্যায়ের ম্যাট্রিক পরীক্ষাটি (এসএসসি) পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থী ভর্তি, রেজিস্ট্রেশন, ফরম পূরণ, পরীক্ষা অনুষ্ঠান ও ফল প্রকাশ সবকিছু।

ঢাকা কলেজ স্থাপনের অন্তত ২৮ বছর পর ১৮৬৯ সালে স্থাপিত হয় চট্টগ্রাম কলেজ। চট্টগ্রামের ৪ বছর পর ১৮৭৩ সালে রাজশাহী কলেজ। প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানেরই সূচনা হয় উচ্চমাধ্যমিক স্তর (আইএ) দিয়ে। পরবর্তী সময়ে ৫ কিংবা ১৫-২০ বছর পর খোলা হয় আইকম, আইএসসি, বিএ, বিকম, বিএসসি। দীর্ঘদিন পর ক্রমান্বয়ে খোলা হয় অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স। ১৯৪৭ সালে পার্টিশনের সময় আমাদের ভাগে ও ভাগ্যে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পড়ে আনুমানিক ৫৫টি। কলেজগুলোর মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এমনসব শহরে অবস্থিত আটটি সরকারি, বাকিগুলো বেসরকারি।

স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে পকিস্তানের যাত্রা শুরু এবং নতুন করে ঔপনিবেশিক শাসন-শৃঙ্খলে আবদ্ধ হলেও প্রধানত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে আমাদের পূর্বাঞ্চলের স্থানে স্থানে উৎসাহ-উদ্দীপনা সহকারে একটি-দুটি করে কলেজ গড়ে উঠতে থাকে। পাকিস্তান আমলে প্রথম ১৯৫৩ সালে স্থাপিত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। আরও পরে, ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। আগে ডিগ্রি স্তরের সব কলেজ ছিল একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে।

রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে সার্বিক সুবিধার কথা বিবেচনায় রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনতা থেকে বের করে কিছু কলেজকে আঞ্চলিক ভিত্তিতে এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাজশাহী ও চট্টগ্রাম) অধীনে ন্যস্ত করা হয়। অবশ্য সাধারণ শিক্ষার বাইরে ময়মনসিংহে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) এবং ঢাকায় একটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েট) স্থাপিত হয় যথাক্রমে ১৯৬১ ও ১৯৬২ সালে।

আইয়ুব খানের জমানায় ষাটের দশকে ঐতিহ্যবাহী বেশকটি কলেজকে সরকারি করা হয়। আব্দুল মোনেম খান তখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর (১৯৬২-১৯৬৯)। ১৯৬৩ সালে রংপুরের কারমাইকেল কলেজ, ১৯৬৪ সালে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজ এবং ১৯৬৫ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ সরকারি প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পায়। এভাবে বাড়তে থাকে সরকারি কলেজের সংখ্যা।

১৯৬৮ সাল শিক্ষাক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। একদিকে পূর্ববঙ্গব্যাপী ছয় দফা তথা স্বাধিকার আন্দোলন ও তা নিরসনে সরকারি দমননীতি; অন্যদিকে অল্পদিনের ব্যবধানে একে একে বিখ্যাত অনেক কলেজকেই সরকারি করা হয় এ সময়ে। ঢাকার জগন্নাথ কলেজ, কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ, ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ, বগুড়ার আজিজুল হক কলেজ, দিনাজপুর কলেজ, পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ, যশোরের মাইকেল মধুসূদন কলেজ এমনসব বিখ্যাত কলেজ সরকারিকরণ হয় ১৯৬৮ সালে।

এক তথ্য থেকে জানা যায়, পাকিস্তান আমলে ১৯৭০ সালে আমাদের পূর্ব পাকিস্তানে ইন্টারমিডিয়েটসহ সরকারি-বেসরকারি কলেজ ছিল ২৪টি। এ সময় সদ্য ঘোষিত টাঙ্গাইলসহ (১৯৭০) দেশে মোট জেলা ছিল ১৮টি আর সরকারি কলেজ ছিল ২৪টি। তবে এমনও জেলা ছিল, যেখানে সরকারি কলেজের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। আমাদের স্বাধীনতার বয়স ৫০। ২০২১ সাল সুবর্ণজয়ন্তীর বছর।

একদিক থেকে বিবেচনা করলে এ সময়ে আমাদের অর্জন নেহায়েত কম নয়। পাবলিক-প্রাইভেট মিলে ১৫০টি বিশ্ববিদ্যালয় (বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং কৃষিসহ)। একইভাবে ১১০টি মেডিকেল কলেজ। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে পাঁচটি। রয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। ৬৫০টি সরকারি কলেজ। ডিগ্রি স্তরে ২ হাজার ২০০-র বেশি কলেজের মধ্যে ৮৫৭টি রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স পড়ার বন্দোবস্ত। আর ১৪৬টি কলেজে আছে মাস্টার্স কোর্স।

এ তো গেল উচ্চশিক্ষার মোটামুটি বিবরণ। এতকিছু থাকার পরও কী যেন নেই আমাদের! শিক্ষার মান নিয়ে একটি প্রশ্ন মাঝে মাঝেই বড় পরিসরে আলোচনায় চলে আসে। অতএব শুধু প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি নয়, এখন থেকে শিক্ষার মানের দিকে আমাদের বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার। মান ঠিক না রাখতে পারলে শুধু প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়িয়ে প্রকৃত অর্থে কোনো লাভ নেই।

 

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি