Loading..

প্রকাশনা

২২ আগস্ট, ২০২১ ০৭:০৯ অপরাহ্ণ

যেভাবে লেখা হলো নজরুলের 'পূর্ণ-অভিনন্দন' কবিতাটি

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান 'জয় বাংলা' এসেছে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা থেকে আর 'সোনার বাংলা' এসেছে 'রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান থেকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান 'জয় বাংলা' শব্দবন্ধ যে নজরুলের 'ভাঙ্গার গান' কাব্যের 'পূর্ণ অভিনন্দন' কবিতা থেকে আহরণ করেছেন, সেই তথ্য পাওয়া যায় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, ফোকলোরবিদ অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানের 'বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব ও জয় বাংলা' (দৈনিক কালের কণ্ঠ, ঢাকা, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৩) শীর্ষক লেখায়। কবিতাটির রচনার নেপথ্য কথা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। নজরুল কবিতাটি লিখেছিলেন বহরমপুর জেলে বসে, পাঠিয়েছেন পাউরুটির ভেতরে ভরে, আর পঠিত হয়েছিল মাদারীপুরে বিপ্লবী পূর্ণচন্দ্র দাসের অভ্যর্থনাসভায়।

১৯২২ সালে গয়া কংগ্রেস অধিবেশনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর তিনি দিল্লিতে কংগ্রেসের এক বিশেষ অধিবেশন ডাকেন। এই অধিবেশনে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ সভাপতি হন। ফরিদপুরের কংগ্রেস প্রতিনিধিদের সঙ্গে মাদারীপুরের কালিপদ রায়চৌধুরী, পঞ্চানন চক্রবর্তী, টেনু (প্রফুল্ল), বিজয়, সুরেন প্রমুখের সঙ্গে দিল্লি অধিবেশনে যোগ দেন। অধিবেশন শেষে মাদারীপুর ফেরার পথে মুর্শিদাবাদ যান কালিপদ রায়চৌধুরী ও টেনু। মুর্শিদাবাদে তখন পড়ালেখা করতেন মাদারীপুরের অমলেন্দু দাশগুপ্ত। একদিন বিকেলে তিন বন্ধু ঘুরতে বেরিয়ে পুলিশের নজরে পড়েন এবং গ্রেপ্তার হন। বিপ্লবী পূর্ণচন্দ্র দাস, কাজী নজরুল ইসলাম, আফতাবুল ইসলাম ও নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তখন বহরমপুর জেলে অন্তরীণ ছিলেন। অমলেন্দু আর টেনু জামিনে খালাস পেলেও কালিপদকে আটকে রাখা হয়। জেলখানার কোনো এক অনুষ্ঠানে কাজী নজরুল ইসলাম ও পূর্ণচন্দ্র দাসের সঙ্গে তাঁর সারা দিন কাটানোর সুযোগ ঘটে। একসময় পূর্ণচন্দ্র দাস মুক্তি পেলেন। তাঁকে মাদারীপুরে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। তখন কালিপদ রায়চৌধুরী অনুরোধ করেছিলেন একটি কবিতা লিখে দেওয়ার জন্য। এদিকে কালিপদর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলা খারিজ হলে মুক্তির অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকেন। এমন এক সকালে নাশতার চা-পাউরুটি খেতে গিয়ে দেখেন যে ভেতর থেকে ভাঁজ করা একটি কাগজ বেরিয়ে আসছে। কাগজ খুলে দেখা গেল নজরুলের হস্তাক্ষরে লেখা একটি কবিতা।

কবিতাটি হাতে পেয়ে তিনি আনন্দিত। এদিকে কালিপদ রায়চৌধুরী জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গেছেন। এই কবিতা নিয়ে তিনি জেল থেকে বেরোবেন কী করে! ধরা পড়ে গেলে কবিতা তো রেখে দেবেই, নতুন মামলাও হতে পারে। মামলার ভয় বিপ্লবীরা করে না। কিন্তু কবিতাটি তো রক্ষা করতে হবে। এই কবিতা পাঠ করা হবে পূর্ণচন্দ্রের অভ্যর্থনাসভায়।

স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন, 'কবি আমার অনুরোধ রেখেছেন! মন আনন্দে ভরে উঠল। জেল থেকে বেরোবার সময় পাছে জেল কর্তৃপক্ষ গেট তল্লাশি করে সেটা রেখে দেয়, সেই ভয়ে বারবার পড়ে কবিতাটি মুখস্থ করে ফেললাম। ঠিক মনে আছে কি না পরীক্ষার জন্য বারবার তা মনে মনে আবৃত্তি করি। অবশেষে কবিতাটি বারবার স্মরণ করতে করতেই একদিন জেল থেকে বের হলাম।' (স্বাধীনতাযুদ্ধে মাদারীপুর : এক স্মৃতিচিত্রণ, গ্রন্থতীর্থ, কলকাতা, ২০০০)। জেল থেকে বের হয়ে প্রথমে বহরমপুর কংগ্রেস অফিসে গিয়ে কবিতাটি লিখে ফেলেন স্মৃতি থেকে। এক কপি মাদারীপুরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ডাকে। আরেক কপি সঙ্গে নিয়ে কালিপদ মাদারীপুরে রওনা হন। পূর্ণচন্দ্র দাস জেল থেকে ছাড়া পাওয়ায় মাদারীপুরে যে অভ্যর্থনাসভার আয়োজন করা হয়, সেখানে এই কবিতাটি পাঠ করা হয়।

ওগো অতীতের আজো-ধূমায়িত আগ্নেয়গিরি ধূম্রশিখ!

না-আসা-দিনের অতিথি তরুণ তব পানে চেয়ে নিনিমিখ।

জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি-অন্তরীণ!

জয় যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি, জয় প্রাণ আদি-অন্তহীন!

স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারীপুরের মর্দবীর,

বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!

'জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র' থেকেই বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা স্লোগানটি গ্রহণ করা হয়েছে। এই কবিতা ১৯২২ সালেরই নজরুলের 'ভাঙ্গার গান' কাব্যে প্রকাশিত হয়। তবে কবি একে গান হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। গান হোক আর কবিতাই হোক, এই রচনা থেকেই আহরিত হয়েছে আমাদের জাতীয় স্লোগান 'জয় বাংলা', আর এর রচনার প্রেরণা ছিল মাদারীপুর বিপ্লবী কালিপদ রায়চৌধুরীর অনুরোধ। এসবই এখন ইতিহাসের অংশ।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি