Loading..

প্রকাশনা

২৩ আগস্ট, ২০২১ ০৬:৫৯ অপরাহ্ণ

গল্প দেনমোহর
আজ আমাদের বাড়ীতে আয়োজন চলছে। তবে তা অনেকটা অপারগতা বশত! আজ আপুকে বরপক্ষ দেখতে আসবে। আপু সেই দুপুর থেকেই গুটিসুটি মেরে বসে আছে। কোন কথাবার্তা বলছে না কারো সাথে।
আমি আর মা ঘরদোর পরিষ্কার আর সাজানোতে ব্যস্ত আছি। মা চরম বিরক্ত। মার আচরণেই বিরক্তির প্রখরতা ফুটে উঠছে। মা কাজ করছে আর গজগজ করে কি যেন বলছে। মা বসার ঘর থেকে বিকট শব্দে হাঁক ছেড়ে আমাদের ডাক দিলেন। মার এই হাঁক ছেড়ে ডাকা আমাদের খুব পরিচিত। এটা একটা বিপদ সংকেত। বিশেষ করে আপুর জন্য। মায়ের হাঁক শুনে আপু আর বসে থাকতে পারলো না। কাঁপতে কাঁপতে বসার ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো। আমিও আপুর পাশেই। আমাদের অবাক করে দিয়ে মা তার মুখটা বন্ধ করে রেখেছেন! মুখে কোন শব্দই নেই! অথচ এতক্ষণে আপুর গালে মুখে পিঠে চর থাপ্পরের সাথে সাথে মায়ের মুখ দিয়ে সাতমিশালী শব্দগুচ্ছ বের হবার কথা! আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। আপু খানিক কাঁপছে। বুঝতে পারছে না কি করতে হবে। সোফার কুশনের একটা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে মা জাস্ট সেটা ছুড়ে মারলো। বুঝতে পারলাম মা কঠিন সাধনা করে আপুকে চরপেটা করা থেকে বিরত থাকলেন। আর বুঝিয়ে দিলেন কুশনের কাভারটা ময়লা হয়েছে পাল্টাতে হবে। আপু দৌঁড়ে গিয়ে আলমিরা থেকে কুশন কাভার নিয়ে এসে পাল্টাতে লেগে গেল। খেয়াল করলাম আপু কুশন পাল্টাতে পাল্টাতে আনমনা হয়ে গেল। এটা আপুর আরেক ব্যারাম। সুযোগ পেলেই আপু আনমনা হয়। আমি জানি আপু এখন তার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের রাতটার কথা ভাবছে।
রাহেলা আমার আপু। পড়ালেখা মাঝারি গোছের। তবে পড়াশোনা চালাতে পারেনি। কারণ সে স্কুল কলেজে বেশি পড়ালেখা করলে আমাদের বাসার কাজকর্মের খুব সমস্যা হয়। তাই মেট্রিক পাস করে আর পড়া হয়নি। এটা মার সীদ্ধান্ত আপু আর পড়বে না। আর মার সীদ্ধান্তই আমাদের বাসায় শেষ কথা। আপুর একটা ময়না আছে পোষা ময়না। বজ্জাত পাখিটা আপুর সাথেই বেশী মেশে। আমাকে অবশ্য অপছন্দ করে না। তবে বাবাকে দেখলেই এই পাখি চিৎকার চেঁচামেচিতে পুরো ঘর মাথায় তোলে। কেন এমন করে এই রহস্য আমরা কেউই বুঝিনা। হয়তো একমাত্র আপুই জানে। অথচ আমার বাবাটা শতভাগ গোবেচারা টাইপের অতি ভদ্র মানুষ। শেষবার কখন মায়ের সাথে বাবার কথাবার্তা হয়েছে তা আমার মনে নেই। তবে মা বাবাকে প্রতিনিয়ত ঝাড়ির উপরে রাখে। মা এটা বেশ উপভোগ করে। তবে পরিবারের বাইরে বাবা বেশ সফল একজন মানুষ। সফল ব্যবসায়ী। সামাজিকভাবেও বেশ সফল।
বিকাল হতে হতে আমাদের বাসাটা পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেল। আমরা বরপক্ষকে বরণ করতে প্রস্তুত। হবু দুলাভাইকে দেখার আগ্রহে আমি মশগুল আছি। আসরের নামাযের পরপরই তারা আসলো। তারা তিনজন। দুজন পুরুষ আর একজন মহিলা। পুরুষ দুজনের কে বয়সে বড় আর কে ছোট বোঝা মুশকিল! বাবা মা দুজনে তাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে বাসার ভেতরে এনে বসার ঘরে বসালেন। পুরুষ দুজনের একজন পাত্র আরেকজন পাত্রের বন্ধু। মহিলাটা পাত্রের খালা।
পাত্রের নাম জলিল। জলিল মির্জা। পাত্রের বন্ধু পরিচয় করিয়ে দিলো। জলিল নাম শুনে আমার পেট ফেটে হাসি পাচ্ছিলো। অনন্ত জলিলের ডায়লগটা মনে পড়ে গেল। পাত্রের গায়ের রং শ্যামা। লম্বায় মাঝারি সাইজের। ওজনটা হাইটের তুলনায় কমই মনে হচ্ছে। একটি বেসরকারী কোম্পানীতে অফিস সহকারী পদে চাকরি করে। পুরুষ মানুষের গোফ আমি কখনোই পছন্দ করতে পারিনি। কিন্তু জলিল সাহেবের গোফটা কেন যেন ভাল লাগলো। গোলগাল চেহারায় গোফটা বেশ মানিয়েছে। জলিল সাহেব আইএ পাশ। মা-বাবা তাদের সাথে টুকটাক কথা বলছেন। তবে জলিল সাহেবের বন্ধুই বেশি কথা বলে চলেছেন। মনে হচ্ছে তাকে আনাই হয়েছে বকবক করার জন্য।
মায়ের চোখের সরু ইশারা পেয়ে আমি ভেতরে চলে গেলাম। আপুর রুমে ঢুকে দেখি আপু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নেভি ব্লু জর্জেটের শাড়ির সাথে সাদা ব্লাউজ ততটা ম্যাচ না হলেও কেন জানি আপুকে পরির মত সুন্দর দেখাচ্ছে! আপুর ফর্সা চেহারাটা হালকা সাঝে অপরুপ লাগছে। আপুকে বললাম - চল তোর জলিল সাহেব পথ চেয়ে আছে। আপু এখনো চুপ। চুপচাপ আমার সাথে হেঁটে বসার ঘরে আসলো। সবাইকে সালাম করে সোফার পাশে রাখা কাঠের চেয়ারটায় আপু বসলো। আপু আর জলিল সাহেব কিছুটা আঁড়াআঁড়ি পজিশনে! জলিল সাহেবকে দেখলাম আপুর দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না! আর আপু একটি বারও জলিল সাহেবের দিকে চেয়ে দেখলো না।
মা তাদের বললো আপুকে কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে করতে পারে। পাত্রের বন্ধু আর মা একযোগে জলিল সাহেবের দিকে তাকালেন। জলিল সাহেব সাথে সাথে যেন লজ্জায় কুঁকড়ে গেলেন। বন্ধু সাহেব বলে উঠলেন - না না তেমন কিছু নেই প্রশ্ন করার মত। থাক থাক লাগবে না। জলিল সাহেবের খালা বললেন মা কি নাম তোমার? আপুকে বলতে সুযোগ না দিয়ে মা জবাব দিলো- ওর নাম রাহেলা। জলিল সাহেবের খালা আপুর হাতে কিছু একটা গুজে দিয়ে বললেন - মা তুমি ভেতরে যেতে পার। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আপু উঠছে না! মাথা নিচু করে বসে আছে! উনি আবারো বললেন - মা আমরা তোমাকে কোন প্রশ্ন করবো না। তুমি ভেতরে যেতে পার। অনেকক্ষণ কষ্ট করে বসে আছ চুপচাপ। এবার আপু ঝট করে এক পলক জলিল সাহেবের দিকে তাকালো। সবার নজর এড়িয়ে গেলেও আমি বুঝতে পেরেছি আপুর চোখে জোয়াড় লেগেছে। বহু কষ্টে চোখের পানি আটকে রেখেছে। তবুও খুব শান্তভাবে সবাইকে সালাম করে আপু ভেতরে চলে গেল।
এবার মা তাদের চা নাস্তা তুলে দিতে দিতে বিভিন্ন আলাপ করতে লাগলেন। নাস্তাপানি শেষে জলিল সাহেবের খালা বললেন- এবার আমরা উঠি। বাসায় গিয়ে একটু আলোচনা করে কাল জানাই? একথা শুনে মার চেহারায় হতাশা স্পষ্ট ভেসে উঠলো। তিনি পারছেন না এখনি তাদের সম্মতি আদায় করে নিতে। অগত্যা মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে তাদের বিদায় দিলেন।
আমরা সবাই জানি এবার মায়ের গজগজানি শুরু হবে। ঝড়টা যাবে বাবা আর আপুর উপরে। আল্লাহই জানেন জলিল সাহেব আগামীকাল কি খবরটা পাঠান! এও জানি আপুটা আজ আর না পারবে খেতে না পারবে ঘুমাতে না পারবে স্থির হতে। কিন্তু জলিল সাহেবকে আপুর পছন্দ হল কিনা বুঝতে পারছি না। অবশ্য এটা কোন জরুরী কিছু না। মা রাজি তো বাকি সবাই রাজি।
পরদিন রাত নাগাদ জলিল সাহেবের জবাব আসলো। জবাব দিতে এলো জলিল সাহেবের সেই বন্ধুটি। রাত ৮টায় তিনি আমাদের বাসায় ঢুকলেন। আরো আগেই নাকি আসার ইচ্ছা ছিল কিন্তু কি একটা কাজে দেরি হয়ে গেল। উনাকে চা-নাস্তা দেয়া হল। উনি আসলেই কোন কাজে ছিলেন। বেশ ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত। বেশ করে নাস্তা খেলেন চুপচাপ। আমরা সবাই অধীর আগ্রহে তার নাস্তা খাওয়া শেষ হবার অপেক্ষায় আছি। চায়ের শেষ চুমুকটা দিয়ে তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে মিস্টি করে হেসে বললেন- ক্ষিধাটা একটু বেশি পেয়েছিল। বাবা হেসে উত্তর দিলেন- কোন সমস্যা নেই বাবা।
উনি শুরু করলেন- জলিলের আপনাদের মেয়েকে পছন্দ হয়েছে। সে আপনাদের মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি। শুনেই মা বলে উঠলেন- আলহামদুলিল্লাহ্‌। উনি তারপর বললেন- আপনাদের জলিলকে পছন্দ হয়েছে কিনা যদি জানাতেন। বিশেষ করে আপনাদের মেয়ের মতামতটা। মা বললেন- পাত্র আমাদের পছন্দ হয়েছে। আর আমাদের পছন্দই মেয়ের পছন্দ। ওর পছন্দ অপছন্দে কোন সমস্যা নাই। এছাড়াও বিয়ের বিভিন্ন বিষয় কথাবার্তা হল।
বাবা এবার বললেন- আচ্ছা সব কথা হল বিয়ের দেনমোহর কত হবে তা তো ঠিক করা হল না। জলিল সাহেবের বন্ধু বললেন- এ ব্যাপারে তারা আমাকে বলেছে দেনমোহর ২ লক্ষ টাকা হতে পারে। বাবা আপত্তি জানিয়ে বললেন এত কম দেনমোহরে কীভাবে হবে! বর্তমান সময়ে যেখানে কমপক্ষে ১০ লক্ষ টাকা দেনমোহর ধার্য হয়। মা অনেকটা ধমকের মতই বাবাকে থামিয়ে দিলেন। মা বললেন ২লক্ষ টাকা কাবিনই যথেষ্ট। কি হবে অত দেনমোহর ধরে? জলিল সাহেবের বন্ধুকে মা চুড়ান্ত সীদ্ধান্ত দিয়ে দিলেন। আমাদের পক্ষ থেকে কোন আপত্তি নাই। এমনকি তেমন কোন দাবি দাওয়াও নাই। ঐ মুহুর্তে বাবা চট করে উঠে চলে গেলেন। আমি জানি বাবা এখন তার বারান্দায় গিয়ে তার চেয়ারটায় চুপচাপ বসে থাকবেন। ওটা বাবার পরাজয় পরবর্তী আসন। ঠিক হল পরের শুক্রবার বাদ আসর আপুর বিয়ে।
না বিয়ে নিয়ে তেমন একটা হৈ হুল্লোর নেই বাসায়। রহমান মামা এসেছেন তার পরিবার নিয়ে। আর মদন কাকু। আসলে তার নাম মনির। বাবার কাছে তাকে নাকি বোকাসোকা মনে হয়। তাই বাবা তাকে মদন নামে ডাকেন। বাবার দেয়া নামটাই এখন উনার পরিচিত নাম। বাবা কাকু মামারা সবাই জুমার নামায পড়ে এসে একসাথে খেতে বসলেন। তখন মদন কাকুই কথা তুললেন পাত্র সম্পর্কে। একরাশ বিরক্ত নিয়ে মাই পাত্র সম্পর্কে যা বলার বললেন। রহমান মামা কাবিন কত জানতে চাইলেন। মা আগের চেয়ে চারগুন বিরক্তি নিয়ে কাবিনের অংকটাও বললেন সাথে সাথে কথার তোড়ে রহমান মামাকে চুপ করে দিলেন। কেউ আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শেষ করে যার যার রুমে চলে গেল।
আসরের এখনো বেশ দেরি আছে। এসময় জলিল সাহেবের বন্ধু এসে হাজির। হাতে একটা সুটকেস। আমি দরজা খুলে দিলে বসার ঘরে এসে সোফায় বসলেন। মাও আসলেন বসার ঘরে। জলিল সাহেবের বন্ধু সুটকেসটা মাকে দিয়ে বললেন জলিলের মা পাঠিয়েছেন। নববধুকে সাজানোর জিনিসপাতি আছে সুটকেসে। মায়ের ইশারায় সুটকেসটা আমি আপুর রুমে নিয়ে গেলাম।
লাল খয়েরী বেনারসিতে আপুকে অপরূপ লাগছে। সুটকেসে থাকা গয়নাগুলোও বেশ সুন্দর মানিয়েছে। নতুন এসবের সাথে আপুর জন্য তুলে রাখা পুরনো গলার হার আর হাতের বালা দুটোতে সাজগোছের সৌন্দর্যের মাত্রা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। আপুর কপালে লাল টিপটা পরিয়ে দিয়ে আমি সম্মোহিতের মত তার দিকে চেয়ে আছি। এই মেয়ে এত সুন্দর আগে খেয়াল করিনি! আর আপুর অতিরিক্ত গম্ভীর হয়ে থাকাটা যেন তার সৌন্দর্যকে থমকে রেখেছে।
আসরের নামাযটা আমাদের এলাকার মসজিদেই আদায় করলেন জলিল সাহেবেরা। নামাযের আগেই তাদের সাথে থাকা মহিলারা আমাদের বাসায় চলে এসেছেন। আসরের নামাযের পরপরই আপুর বিয়েটা হয়ে গেল। এশার নামাযের পর খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ করেই আপুকে আমরা বিদায় দিলাম। যাবার আগে আপু একটুও কাঁদেনি। তবে ভেতরে ভেতরে আপু হয়তো ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে। আপুর প্রিয় ময়নাটা নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমি ময়নাটাকে আপুর কাছে চেয়ে নিয়েছি। শর্ত ছিল যেদিন আমিও এভাবে বিদায় নেব সেদিন ময়নাটাকে আপুর কাছে ফেরত দিতে হবে।
বিয়ের পর আপুর খুব একটা আমাদের বাড়িতে আসা হয় না। বিশেষ আচার অনুষ্ঠানে যখন একেবারে না আসলেই নয় তখন কেবল আপু আমাদের বাড়িতে আসে। প্রথম প্রথম ময়নাটা খুব চেঁচাতো। বাবাকে দেখলে খুব বেশি। মাকে দেখলে ভয়ে কুঁকড়ে যায়। আমার সাথে মোটামুটি একটা ভাব তার হয়ে গেছে।
আপুর বিয়ের সতেরো মাসের মাথায় তার কোল জুড়ে একটা ছেলে বাবু আসলো। আমরা সবাই আপু আর বাবুকে দেখতে এসেছি। শুধু মা ছাড়া। আমি ময়নাটাকেও নিয়ে এসেছি সাথে। বাবুটা অনেকটা তার বাবার মত হয়েছে। মায়াভরা চোখ। আমার হাতে ময়নার খাঁচাটা থাকাতে হয়তো আমার দিকে এক পলকে তাকিয়ে আছে। আমার কেন জানি খুব মন চাইছে আপুর সাথে কটা দিন থাকি। খুব ইচ্ছে করছে। আপুকে কানে কানে বলতেই আপু মায়ের কথা বললো। মা আমাকে বকতে পারে তার জন্য আপত্তি করলো। আমি পাত্তা না দিয়ে সবার সামনে বলে ফেললাম।
আজ দুদিন হল আপুর বাসায় আছি। আপুকে দুলাভাই অনেক অনেক ভালবাসে। অনেক যত্ন করে। শুনেছি কাবিনের ২ লাখ টাকা বিয়ের পরের রবিবারেই বুবুর নামে ফিক্স ডিপোজিট করেছেন দুলাভাই। শরীয়ত মোতাবেক কাবিনটা নগদে পরিশোধ করার জন্যই নাকি কাবিনের টাকা কম ধরতে হয়েছিল। বেশি ধরলে পরিশোধ করতে পারতেন না। আপুর সংসারটা খুবই গোছানো। তার সংসারে সেই রানী। যদিও আপু শাশুড়িকে খুব মেনে চলে তবে শাশুড়ি বউয়ের কথার বাইরে এক কদম পা দেন না। আপুর সুখ দেখে খুব ভাল লাগলো। এটা তার পাওনা ছিল।
আজ পাত্র পক্ষ আমাকে দেখে গেছে। পাত্র ইঞ্জিনিয়ার। বিদেশী কম্পানীতে বড় চাকরি করে নাকি। পাত্র দেখতে বেশ ভালই। খারাপ লাগেনি আমার। আমাকেও পছন্দ করেছে।কিন্তু বিপত্তি লাগলো দেনমোহর নিয়ে। তারা ১০ লক্ষ বলছে কিন্তু মা ১৫ লক্ষ ছাড়া নাকি আমাকে বিয়ে দেবে না। আমার ভবিষ্যতের জন্য নাকি এটা খুব দরকার। শেষ পর্যন্ত এই প্রস্তাবটা বাতিল হয়ে গেল। মা বললো এটা বাদ সামনের সপ্তাহে আরেকটা প্রস্তাব আসছে। পাত্র ব্যবসা করে। খান্দানি পয়সা ওয়ালা।
পরের প্রস্তাবটাই ফাইনাল হয়ে গেল। সব ঠিকঠাক। ১৫ লাখ দেনমোহরে তাদের কোন আপত্তি নেই। পাত্র আগেরটার মত অত পারফেক্ট না হলেও মন্দও না। পরের মাসের ১০ তারিখ শুক্রবার আমার বিয়ে। আমার বিয়ে নিয়ে মায়ের উচ্ছাসের শেষ নেই। কোনকিছু কমতি রাখতে চান না। মহাধুমধামে সম্পন্ন হল আমার বিয়ে। সমস্ত আত্মীয় স্বজনেরা এসেছিলেন। আপুরাও এসেছিল। আপুর বাবুটার বয়স এখন ৯মাস। নাম রাখা হয়েছিল সায়ান। সায়ানের সাথে আমার বেশ ভাব হয়েছে। মিষ্টি ভাগিনা আমার। আমার বিদায়ের আগে আপুর ময়নাটা আপুকে বুঝিয়ে দিলাম।
আমার বিয়ে হয়েছে আজ ২১ মাস চলছে। আমার বর বড়লোকের সন্তান। তেমন কাজকর্ম করতে হয় না। বাপের ব্যবসা পাতি দেখাশুনা করে। আমার শশুড়ের আয় ইনকাম বেশ ভাল। বিয়ের প্রায় ২ বছর হতে চললো আমার এখনো সন্তান হচ্ছে না। এটা নিয়ে ইদানিং বেশ অসান্তি হচ্ছে সংসারে। যদিও কেউই শুধু আমাকেই দোষারোপ করছে না এখনো। তবুও অশান্তি মানেই তো শান্তি হারিয়ে যাওয়া। ভয়ংকর বিষয় হল অশান্তির মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। আর অশান্তির মুল কেন্দ্র আমার বর। সন্তান না হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে ইদানিং তার সাথে আমার ঝামেলা লেগেই আছে।
গত কয়েক মাসে আমার সংসারটা আর সংসার নেই। চরম অরাজকতা চলছে যেন। ইদানিং শাশুড়ির সুরও পাল্টেছে। তিনিও ছেলের সুরে সুর মিলিয়ে অশান্তির মাত্রা বাড়িয়ে চলেছেন। আর সেইসাথে শুরু হয়েছে আমার বরের শারীরিক নির্যাতন।
চোখ খুলে দেখি আমি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। নড়াছড়া করতে গিয়ে সারা শরীরের ব্যাথায় কুঁকড়ে গেলাম। পুরোনো একটা কাঠের টুকরা দিয়ে পেটানো হচ্ছিল আমাকে। মারের চোটে জ্ঞান হারিয়েছিলাম। আপু আমার হাত চেপে ধরে বসে আছে। বাবা হতবাক। মা একটু দুরে দাঁড়িয়ে আছ। মুখ দেখে বোঝা দায় মায়ের ভেতর আসলে কি চলছে। বাবার পাশে দুলাভাই সায়ানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পিচ্চিটার দিকে নজর পড়তেই আমার মুখে হাসি চলে এল। এত আদুরে ভাইগনাটা আমার। ১৬দিন হাসপাতালে থেকে বাবার বাসায় ফিরলাম। শরীরে এখনো যন্ত্রনা জমে আছে। আর মনে জমেছে রাজ্যের সমস্ত কষ্টের বোঝা। বুঝতে পারছি না এমন কেন হয়ে গেল আমার জীবনটা। ঐ স্বামীর ঘর করা তো আর সম্ভব হবে না কখনোই। সব স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল।
পারিবারিকভাবে সীদ্ধান্ত হল মামলা ও ডিভোর্সের। যথারীতি মামল হল। মামলার জল অনেকদূর গড়িয়ে আজো তার গন্তব্য খুঁজে পেল না। আজ আড়াইটা বছর ধরে মামলা চলমান। কিছুই হচ্ছে না। তারিখের পর তারিখ পড়ছে হাজিরা চলছে। সে কয়েক মাস জেলও খেটেছে।
আমার ১৫ লক্ষ টাকার দেনমোহর না পেরেছে আমায় সুখ দিতে না পেরেছে আমার সংসার টিকিয়ে রাখতে। দেনমোহরটা এখন পর্যন্ত বিরাট অংকেই রয়ে গেল। বিয়ের পরপর অল্প দেনমোহরের টাকা পুরোটাই পরিশোধ পেয়েও আপু আমার সুখের সংসার করছে। আর বিরাট অংকের দেনমোহর ধার্য হয়েও সুখ তো দুরের কথা আমার সংসারটাই রইলো না।
আমার মা তার সৎমেয়ে রাহেলা আপুর ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে ২ লক্ষ টাকার দেনমোহরে কোনমতে বিয়ে দিয়ে বিদায় করেছিলেন। আর আমি তার নিজ মেয়ে তাই আমার ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য ১৫ লক্ষ টাকা দেনমোহরে উচ্চ শ্রেণির পাত্রের কাছে মহাসমারোহে কন্যাদান করেছিলেন।
নিয়তি আজ তার হিসাব চুকে দিয়েছে। আপুর ময়নাটা এখন আবার আমার কাছে। সে এখন আর বাবাকে দেখলে চেঁচায় না। এখন বুঝতে পারছি আপুর কষ্টে বাবার নিরবতার জন্যই ময়নাটা বাবাকে দুচোখে দেখতে পারতো না। ময়নাটা এখন মাকে দুচোখে দেখতে পারে না। মাকে দেখলেই ময়নাটা চেঁচায়। মাকে আগের মত ভয়ও পায় না। মাও দেখি ময়নাটার দিকে কটমট করে তাকায় না। মা আগে কখনই আপুর দিকে মায়া নিয়ে তাকায়নি, আর মা এখন আমরা দুবোনের দিকেই তাকাতে পারে না। কখনই আমরা দুবোনের চোখাচোখি হয় না। আপুটাও এখন হঠাৎ আনমনা হয়ে মা মারা যাবার রাতটার কথা ভাবে না।
নিয়তি আমাদের সবার জীবনের গতিপথ পাল্টে দিয়েছে। দেনমোহর আর স্বার্থপরতার সুরক্ষার মিথ্যা দেয়াল নিয়তির আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি