প্রধান শিক্ষক
১৭ অক্টোবর, ২০২১ ০৯:৪২ অপরাহ্ণ
মায়া কানন
মায়া কানন
আয়েশা আফসার একজন দাপুটে মানুষ। চাকুরী ও সংসার দুটো ক্ষেত্রেই তিনি সমান দক্ষতার সাথে সামলাচ্ছেন। এবং বলা যায় তিনি সফলও বটে।এই ধরনের মানুষগুলো সাধারনত অন্যের বিরাগভাজন হয়ে থাকেন কিন্ত তাঁর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ।তিনি সবার ভালবাসা ও শ্রদ্ধার পাত্রি। কিছু ব্যতিক্রমধর্মী বৈশিষ্ট্য ,আর প্রচন্ড ব্যক্তিত্ব তাঁকে সবার কাছে এক অনন্য মর্যাদার আসনে বসিয়েছে।
দিনের শুরুতেই কর্মস্থলে পৌঁছুতে না পৌছুতেই আয়েশাকে বিচারকের আসনে বসতে হয়।কত বিচিত্র সে সব নালিশ! এই সমস্ত অভিযোগের সঠিক বিচার করতে হলে সুষ্ঠু তদন্ত প্রয়জন।আর তদন্ত শুরু হলে দেখা যায় একটা ঘটনার সাথে কত জন যে জড়িত থাকে! না এটা কোনো আদালত নয় আর আয়েশাও কোনো বিচারক নন তিনি পলাশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
আজ স্কুলের ফটকে রিক্সা থেকে নামতেই ক্ষুদে শিক্ষার্থিরা যখন তার উপর উপর্যুপুরি সালাম বর্ষন শুরু করেছে আর তিনি শিক্ষার্থীদের শুভকামনায় ভাসছেন তখন ছুটতে ছুটতে এসে প্রাক প্রাথমিকের মেহেজাবীন সবাইকে সরিয়ে ম্যডামের হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলতে লাগল –“ ম্যাডাম ও ম্যাডাম ,কাল রাতে না আমার মায়ের বিয়ে হয়েছে। আমার নতুন বাবারও একটা ছেলে আছে । সবাই বলেছে আমাদের দুই ভাইবোনকে খুব মানিয়েছে”।
এতগুলো কথা এক নিঃশ্বাসে বলে সে হাফাতে শুরু করলেও মুখে আনন্দ উপচে পড়ছে। আয়েশা ব্যাপারটি পুরোপুরি বুঝতে কিছুটা সময় নিলেন,হাসিমুখে ওর মুখে একটু আদর করে দিলেন,মনে মনে প্রার্থনা করলেন আল্লাহতায়ালা যেন ছোট মেয়েটিকে এমনি আনন্দে রাখেন। মেয়েটি এবার আয়েশার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আবার বলল,ম্যডাম আমি আর এই স্কুলে পড়বনা, আমি মায়ের সাথে নতুন বাবার বাসায় থাকব আর আমার ভাইয়ের স্কুলে পড়ব।
– তোমার ভাইটি কী তোমার চেয়েও বড়? - বেশি না ম্যাডাম , দেড় বছর।
আয়েশা স্কুলের প্রতিটা শিক্ষার্থীর পরিবারের খোঁজ রাখার চেষ্টা করেন আর এর জন্য তিনি নিজেই সব শিক্ষকের সাথে শিশু জরীপ এ অংশ নেন,হোম ভিজিট এ যান এবং প্রতি মাসের শেষ বৃহস্পতি বার শ্রেনী অনুযায়ী মা সমাবেশের ব্যাবস্থ্য করেছেন এবং প্রায় সব গুলোতেই উপস্থীত হয়ে মায়েদের সাথে মতবিনিময় করেন।
তাঁর ল্যাপটপে সেইসব শিক্ষার্থীদের প্রোফাইল আছে যারা কোন না কোনো ভাবে সুবিধা বঞ্ছিত। আর তাদের কে প্রয়োজন অনুযায়ী সহায়তা করে থাকেন। এই কাজে তিনি বিদ্যালয়ের শিক্ষক ,অভিভাবক, কমিটির সদস্যবর্গ , এলাকাবাসী সবাইকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছেন।
যেমনঃ প্রোফাইল নং ২৩. মো.রাকিবুল ইসলাম ,৩য় শ্রেনি।ইংরেজি পঠন দুর্বলতা আছে এই বিষয়ে বিশেষ যত্ন প্রয়োজন। বাবা মারা গিয়েছে ,মায়ের অন্যত্র বিয়ে হয়েছে,দাদার কাছে থাকে।তিনি একজন রিক্সাচালক। ‘বন্ধু সহায়তা’ তহবিল থেকে নাস্তা র ব্যবস্থ্যা এবং খাতা কলম এর বরাদ্দ আছে।
মেহেজা বিন এর প্রোফাইল সিরিয়াল নং ৪৯.বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়েছে, নানা , নানির বাড়ীতে থাকলেও উপার্জনক্ষম মামা তাদের সহজ ভাবে নেয়নি , প্রায়ই সকালে না খেয়ে আসে। মায়ের প্রতি বাবার নৃশংশ তার স্মৃতি ভুলতে পারেনি , অতিরিক্ত কথা বলে, ম্যাডামদের কাছাকাছি থাকতে খুবই পছন্দ করে , মেয়েটি স্নেহের বড় কাঙ্গাল।
এমনি ১২৩ জনের প্রোফাইল আছে আয়েশার পর্যবেক্ষণ ফাইলে। যা তিনি প্রতি বৎসরে শুরুতেই আপগ্রেড করেন।
আয়েশা শিক্ষকতা পেশাটিকে বড়ই উপভোগ করেন ! তিনি মনে করেন ,বাল্যকালের প্রতিটি পর্যায় ই উপভোগ্য আর শিক্ষক রা তাদের সেইসব সুন্দর মুহূর্তের স্বাক্ষি হয়ে থাকেন আজীবন। আয়েশা তার নিত্য নতুন ভাবনা ও উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে স্বপ্নের স্কুল গড়েছেন। তিনি মনে করেন - সব প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলো যদি সু নাগরিক তৈরির কারখানা হত আর প্রাথমিক শিক্ষকেরা যদি সবাইকে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখাতে সফল হত, তবে একদিন অবশ্যই সোনার বাংলাদেশ গঠণ সম্ভব।
তাই আয়েশার পুরো স্টাফ , মনে করেন –তারা শুধু শিক্ষকই নন ,তারা যেন শিক্ষার্থীদের আপনজন। দায়িত্ববোধ ও ভালবাসার এক অপার মিলনে এই স্কুলের কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় এই বিদ্যালয়ে যেন এক স্বর্গীয় পরিবেশ বিরাজ করে।
মেহেজাবিন এর চলে যাবার ঘটনাটায় সব শিক্ষকের মনে মিশ্র অনুভূতির জন্ম দিল। কারন নতুন বাবার ঘরে তার গ্রহনযোগ্যতা কেমন হবে এটা নিয়ে সবার মনে দ্বিধা রয়েই গেল। মিষ্টি চেহারার অতিরিক্ত কথা বলা মেয়েটি শিক্ষকদের আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসতে লাগল।
কিন্ত কিছুদিনের মধ্যে দৈনন্দিন কাজের ব্যস্ততায় তার প্রসংগ আর তেমন কারো হয়ত মনে রইলনা। প্রতিনিয়ত দেখতে থাকা শত শত কচিমুখের ভীড়ে অদেখা মুখটি ক্রমেই বিলীন হয়ে গেল।
একজন মানুষ কেবল ভুলতে পারলেননা,অবিরাম একটি হাসি মুখ তার চোখের সামনে কেবলি ভাসতেই লাগল। শুধু যে ভালবাসা তা নয়,তার দায়িত্ববোধ তাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফিরল। যে ছোট্ট মানুষটী সকাল নটার সময়ও প্রায় দিনই অভুক্ত অবস্থায় স্কুলে এসেও হাসি মুখে সব ম্যাডামদের কুশল জিজ্ঞাসা করে , পরিবারের সামর্থ্য থাকা স্বত্তেও অনাদর আর অবহেলায় অতটুকু বাচ্চার খাওয়া ঠিকমত জোটেনা সে মায়ের নতুন সংসারে কেমন আছে তা জানাটা আয়েশার জন্য অবশ্যই জরুরী হয়ে দেখা দিল।
এবং তিনি তা জেনেছিলেন ও।
মেহেজাবীন এই স্কুল থেকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। সে পার্শ্ববর্তী স্কুলে ৬ষ্ট শ্রেনীতে পড়ছে। কিন্ত কীভাবে সেটা সম্ভব হল?
আয়েশার সে দিনের সন্দেহ অমূলক ছিলনা মোটেও। কিছুদিনের মধ্যেই মেহেজাবিনের মায়ের নতুন স্বামীর ঘরে তাকে নিয়ে অশান্তি শুরু হলে সে এখানে ওখানে জলে ভাসা পদ্মর মত ভেসে বেড়ানোর এক পর্যায়ে তাকে এতিমখানায় পাঠানোর তোড়জোড় শুরু হুওয়ার মুহূর্তেই আয়েশা আফসার তার শিক্ষক সুলভ দায়িত্ব আর মাতৃসুলভ ভালবাসা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। মেহেজাবিন এর মত ছোট্ট পাখির দায়িত্ব গ্রহণ করা এমন কী কঠিন ব্যাপার! শুধু একটু সদিচ্ছা থাকাটাই যথেষ্ট।
মোছাঃ তহমিনা বেগম
প্রধান শিক্ষক
শিমুলতলী সপ্রাবি,বিরামপুর,দিনাজপুর।