Loading..

ম্যাগাজিন

২১ অক্টোবর, ২০২১ ১০:৩৪ অপরাহ্ণ

ঘুরে এলাম দ্বীপ কণ্যা কুকরি-মুকরি

বালিয়া দ্বীপে চারদিকে সবুজের সমারোহ। উত্তরে মেঘনা অববাহিকা, দক্ষিণে নারকেলগাছ সুশোভিত সমুদ্র সৈকত। পশ্চিম ও পূর্ব দিগন্তে বিশাল ম্যানগ্রোভ বন, দূর থেকে ভেসে আসা পাখ-পাখালীর গান। বাংলাদেশের একমাত্র দ্বীপ জেলা ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার দক্ষিণে মেঘনা নদীর অববাহিকা ও বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে জেগে উঠা কোলাহলমুক্ত ছোট্ট একটি দ্বীপ কুকরি-মুকরি দ্বীপ। এটি বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য চোখ জুড়ানো দর্শনীয় স্থান।

বর্তমানে কুকরি মুকরি দ্বীপে বনভূমির পরিমাণ ৮৫৬৫ হেক্টর, যার মধ্যে ২১৭ হেক্টর জমি বন্য প্রাণীর অভয়াশ্রম। কুকরি-মুকরি দ্বীপ বাংলাদেশের অন্যতম সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও বৃহৎ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। এই দ্বীপটি জেলা শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে। বঙ্গোপসাগরের উপকন্ঠে মেঘনা ও তেতুলিয়া নদীর মোহনায় কয়েকশ বছর আগে জেগে ওঠা দ্বীপ এটি। জানা যায় পর্তুগিজ ও ওলন্দাজরা দস্যুবৃত্তি লুটতরাজ করে এই চরে আশ্রয় নিত। ঐতিহাসিকভাবে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হয় ১৯১২ সালে তৎকালীন জার্মান যুবরাজ প্রিন্স ব্রাউন জনমানবহীন এই চরে জাহাজ নিয়ে আসেন শিকারের উদ্দেশে। তিনি দেখতে পান এখানে একটি বিড়াল ও কুকুর ছোটাছুটি করছে। সেই দৃশ্যাবলী তাকে মনে করিয়ে দেয় নির্জন এই চরের নামকরণ। পরে জার্মানের অনূদিত রূপ হিসেবে বাংলায় যার নামকরণ হয়ে যায় চর কুকরি-মুকরি। স্থানীয়দের কাছে থেকে জানা যায়, এক সময় এই দ্বীপে শুধু কুকুর আর বিড়াল (স্থানীয়দের কাছে যা মেকুর নামে পরিচিত) ছাড়া আর তেমন কিছুই চোখে পড়তো না, যা বর্তমানেও চোখে পড়ার মত। এজন্য এ দ্বীপের নামকরণ করা হয় কুকরি-মুকরি। বর্তমানে চর কুকরি-মুকরির বনে যেসব প্রাণী দেখা যায় তার মধ্যে রয়েছে চিত্রা হরিণ, বানর, উদবিড়াল, শিয়াল প্রভৃতি। আর পাখি ও সরীসৃপ হিসেবে এই বনে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির বক, বনমোরগ, শঙ্খচিল, মথুরা, কাঠময়ুর, কোয়েল, গুঁইসাপ, বেজি, কচ্ছপ ও নানা ধরনের সাপ। শীতকালে দেখা মিলে হাজার হাজার অতিথি পাখির। কুকরি মুকরি দ্বীপে হরিণ ও পাখি দেখতে হলে আপনাকে খুব ভোরে উঠতে হবে।

এই দ্বীপকে প্রকৃতির রুদ্ররোষ থেকে রক্ষা করতে জেগে ওঠা চরগুলো সংরক্ষণে ১৯৪৭ সাল থেকে এখানে বনায়ন করা হয়। ওই কর্মসূচিই পরবর্তী সময়ে উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী প্রকল্প হিসেবে রূপলাভ করে। বর্তমান কুকরি-মুকরি দ্বীপ চরফ্যাশন উপজেলার অধীনে একটি ইউনিয়ন। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে আবার কুকরি-মুকরি দ্বীপ এলাকায় প্রশাসনিক উদ্যোগে বনায়নের কাজ শুরু হয়। এই সময় মূলত শ্বাসমূলীয় গাছের চারা রোপণ করে বনায়ন শুরু করা হলেও পরে ক্রমে ক্রমে যুক্ত হয় সুন্দরী, গেওয়া, পশুর প্রভৃতি গাছের চারা রোপণ করা। এছাড়া গোটা এলাকায়ই চোখে পড়ে বিপুলসংখ্যক কেওড়া গাছ। মূলত বিশাল এলাকায় গড়ে ওঠা এসব গাছ, আশপাশের নারিকেল গাছ, বাঁশ ও বেত বন মিলেই এখানেই তৈরি হয়েছে আকর্ষণীয় একটি ম্যানগ্রোভ শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল।

কুকরি-মুকরি দ্বীপে প্রধান সড়ক একটি যা দ্বীপের পশ্চিম-দক্ষিণ দিক থেকে পূর্ব-উত্তর দিকে সোজা চলে গেছে এ সড়কটির দৈঘ্য প্রায় ১০ কিলোমিটার। খেয়া ঘাট থেকে ইট বিছানো আরো একটি পথ প্রায় ৫ কিলোমিটার চলে গেছে উত্তর-পূর্ব দিকে। খেয়া ঘাট থেকে ব্রীজ পার হয়ে পূর্ব দিকে আরো একটি পথ প্রায় ৫ কিলোমিটার চলে গেছে নারকেল বাগানের দিকে। বাজার আছে তিনটি, কুকরি -মুকরি দ্বীপের প্রধান বাজারের নাম হলো পুরাণ বাজার। কুকরি-মুকরি দ্বীপে বিদুৎ নেই তবে পুরাণ বাজারে রাত দশটা পর্যন্ত জেনারেটরের মাধ্যমে বিদুৎ থাকে। দ্বীপের ভিতরে যাতায়াতের জন্য সল্পতা রয়েছে। দ্বীপে ঘুরার জন্য ইদানিং কিছু মটর সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়।

যেতে পারবেন যেভাবে: রাজধানী ঢাকা থেকে চরফ্যাশন উপজেলার দূরত্ব ২২৫ কিলোমিটার এবং জেলা সদর ভোলা থেকে দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটার। ভোলা জেলাটি একটি দ্বীপাঞ্চল হওয়ায় এখানকার যেকোনো স্থানে আসার জন্য নৌপথ সবচেয়ে সুবিধাজনক পরিবহন ব্যবস্থা। তবে, সড়ক পথেও এখানে আসা সম্ভব; সেক্ষেত্রে ফেরী পারাপার হতে হয়। রেল এবং বিমান পথে এখানে সরাসরি পৌছানোর কোনো সুযোগ এখনও গড়ে ওঠেনি। ঢাকার গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ি মহাসড়কে হয়ে লক্ষ্মীপুর এসে মজুচৌধুরীর ঘাট পার হয়ে ভোলা ইলিশা ঘাট হয়ে চরফ্যাশন যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে মাওয়া ফেরিঘাট হয়ে বরিশাল এসে সেখান থেকে অথবা লঞ্চ অথবা বাস যোগে চরফ্যাশন উপজেলায় যাওয়া যায়। সহজ পথে ঢাকা সদরঘাট থেকে লঞ্চে সরাসরি ভোলা বা চরফ্যাশনের বেতুয়া লঞ্চঘাট আসা যায়; এতে সময় লাগে প্রায় ৮ ঘণ্টা। এরপর চরফ্যাশন থেকে বাসে করে দক্ষিণ আইচা, সেখান থেকে অটোরিকসায় কচ্ছপিয়া ঘাট।  কচ্ছপিয়া ঘাট থেকে ট্রলারে কুকরি-মুকরি দ্বীপে পৌঁছানো য়ায়।

যাত্রা শুরু যেভাবে: কুকরি-মুকরি দ্বীপে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল অনেক দিন থেকে কিন্তু নানা ব্যস্ততার কারণে কয়েক বার পরিকল্পনা নিয়েও যেতে পারিনি। গত ১২ অক্টোবর২১  মঙ্গলবার আসাদ সাহেবের আহবানে সারা দিয়ে রাত দশটায় নবীন বরণ গাড়ীতে বরিশাল লঞ্চ ঘাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। এই চচ্ছেন সেই আসাদ সাহেব; যার সাথে তিন বছর যশোর শহরে একই বাসায় থাকার কারণে অকৃতিম বন্ধু হিসাবে তার সাথে দক্ষিণ বঙ্গের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ১৬ জেলায় বেশ ঘুরে বেড়িয়েছি। পরদিন ভোর সারে চারটায় বরিশাল লঞ্চ ঘাটে পৌঁছে গেলাম। সফর সঙ্গী হিসাবে আরো আরো যাদেরকে পেয়ে গেলাম তাঁরা হলেন যশোরের জনাব মুত্তালিব হোসাইন, জনাব ইমরান হোসেন ও জনাব রবিউল ইসলাম।

লঞ্চে বরিশাল থেকে ভোলা: ১৩ অক্টোবর২০২১ বুধবার ভোর পাঁচটায় আমাদের এমভি রুবেল-৪ লঞ্চ বরিশাল ঘাট থেকে যাত্রা শুরু করল। বরিশাল থেকে ভোলায় পৌঁছানোর কথা সকাল সাত টায়। বরিশাল থেকে ভোলার উদ্দেশ্যে প্রতি ঘন্টায় বিভিন্ন নামের লঞ্চ চলাচল করে। লঞ্চের সিঙ্গেল বেড কেবিনের ভাড়া ২৫০ টাকা, ডবল বেড কেবিনের ভাড়া ৪০০ টাকা, ডেকের ভাড়া ৯০ টাকা। লঞ্চে প্রতিদিন উপকূল অঞ্চলের নানা পেশার মানুষ যাতায়াত করে। লঞ্চের নামাজ ঘরে ফজরের নামাজ আদায় করার পর চার পাশের দৃশ্য অবলোকন করতে ছিলাম। লঞ্চে কথা হলো ভোলা বোরহানুদ্দিন উপজেলার আবদুল মাজেদ নামের এক মুরব্বীর সাথে, পেশায় তিনি একজন ব্যবসায়ী, প্রতি নিয়ত ব্যবসায়িক কাজে তিনি লঞ্চে বরিশালে যাতায়াত করেন। তার কাছ থেকে ধান নদী আর খাল এই তিনে বরিশালনদী পথের বিচিত্র খাল ও ঘাটের কথা শুনতে শুনতে থেকে চরমোনাই ঘাটে এসে পৌঁছে গেলাম।

সকালের কলা ও রুটি দিয়ে হালকা নাস্তা করার পর লঞ্চের ডেকে নীচে গেলাম। এখানে বাজার-দোকান, খাবার হোটেল ও চায়ের দোকান রয়েছে। ভোলার দৌলত খাঁ, হাকিমুদ্দিন, তজিমুদ্দিন, চরফ্যাশন ও মনপুরার প্রায় দের হাজার মানুষ এ লঞ্চে যাতায়াত করে। কথা হলো দৌলত খাঁনের আব্দুল আলিম নামের এক যুবকের সাথে সে যশোর থেকে বাড়ী ফিরছে। কথা হলো তজিমুদ্দিনের সুপারী ব্যবসায়ী রমেশ নামের এক ব্যক্তির সাথে, যারা জীবন-জীবিকার টানে এখানে যাতায়াত করেন। নদী পথে জীবন-জীবিকার কথা শুনতে শুনতে  সকাল সারে সাতটায় বরিশালের ভেদুরিয়া লঞ্চ ঘাটে পৌঁছে গেলাম। ভেদুরিয়া লঞ্চ ঘাট হতে ভোলা বাস টার্মিনালে সি.এস.জি চালিত অটো-রিকসার ভাড়া জনপ্রতি ৪০ টাকা হলেও আমরা এখান থেকে জন প্রতি ১৫ টাকা ভাড়ায় মিনিবাসে করে ভোলা বাস টার্মিনালে পৌঁছে গেলাম।

ভোলা থেকে কুকরি মুকরি দ্বীপ: ভোলা বাস টার্মিনালে আবারও সকালের নাস্তা করে আমরা সকাল সারে আটটায় চরফ্যাশনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। বাইকে ওঠার পর থেকেই শুরু হল ছায়া ¯িœগ্ধ সুশোভিত এক নতুন পথ চলা। ভোলার সদর, বুরহান উদ্দিন ও লালমোহনের সরু পথে রয়েছে সবুজ গাছ-পালা, ফসল আর নারকেল-সুপারীর বাগান। দেখতে দেখতে আমরা প্রায় দেড়ঘন্টা পর সকাল ১০টায় চরফ্যাশনে পৌঁছে গেলাম। চরফ্যাশনের বাজারে মনপুরা দ্বীপের সোহাগ নামের একটি ভাইকে আমরা সফর সঙ্গী হিসাবে পেয়ে গেলাম। চা নাস্তা সেরে চরফ্যাশনের বাজার থেকে ২৫ টাকা বাস ভাড়ার বিনিময়ে আমরা দক্ষিণ আইচায় পৌঁছে গেলাম। দক্ষিণ আইচা থেকে ১৫ টাকা ভাড়ায় অটো-রিকসায় করে কচ্ছপিয়া ঘাটে পৌঁছে গেলাম বেলা সারে বরোটায়। ততক্ষণে আমাদের কাংখিত চর কুকরি মুকরি দ্বীপের ট্রলার ছেড়ে চলে গেছে; তাই বিকার ৪টা পর্যন্ত অপেক্ষা ছাড়া আমাদের কোন উপায় রইল না। অবশেষে কচ্ছপিয়া ঘাটে তিন ঘন্টা অপেক্ষা করে গোসল যহোরের সালাত আদায় করে চিংড়ি মাছ দিয়ে দুপুরের লান্স শেষ করে বিকার ৪টার ট্রলারে সপ্নের দ্বীপ কন্যা কুকরি-মুকরির দিকে রওয়ানা হলাম। দের ঘন্টা পর মাগরিবের আযানের সময় আমরা সপ্নের দ্বীপ কন্যা কুকরি-মুকরিতে পৌঁছৈ গেলাম।

 

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি