Loading..

ম্যাগাজিন

১৪ এপ্রিল, ২০২২ ০৬:১৩ অপরাহ্ণ

পহেলা বৈশাখ আমাদের প্রাণের উৎসব

পহেলা বৈশাখ আমাদের প্রাণের উৎসব

ডক্টর মোহাম্মদ ইদ্রিস

বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখ। চৈত্রের শেষে বৈশাখের আগমনে প্রায় সব বাঙালির মাঝেই নতুন বছর বরণের নানা প্রস্তুতি ও অনুষ্ঠান লক্ষ্য করা যায়। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর সম্রাট আকবর দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে হিমুকে পরাজিত করে সিংহাসন লাভ করেন। তখন থেকেই রাজস্ব আদায়কে সহজ ও তার বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তিনি তারিখ-ই এলাহি সনটির প্রবর্তন করেন। প্রথমে এটি তারিখ-ই এলাহি নামে পরিচিতি লাভ করে এবং পরে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়। সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তার রাজত্বের ঊনত্রিশতম বর্ষে বাংলা বর্ষপুঞ্জি প্রবর্তন করেন। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ নতুন এই সালটি তারিখ-ই এলাহি থেকে বঙ্গাব্দে পরিচিতি পায়।

বাংলা বর্ষপুঞ্জি প্রবর্তনের ফলে বাংলায় এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়। এর আগে মোগল সম্রাটরা রাজস্ব আদায়ের জন্য হিজরী বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করতেন। কিন্তু এতে কৃষকরা বিপাকে পরতেন। আবুল ফজল আকবরনামা গ্রন্থে বলেন, হিজরী বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করা কৃষকদের জন্য খুবই সাংঘর্ষিক ছিল। কারণ চন্দ্র ও সৌর বর্ষের মধ্যে ১১ থেকে ১২ দিনের ব্যবধান ছিল, ফলে দেখা যায় ৩০ সৌরবর্ষ ৩১ চন্দ্র বর্ষের সমান ছিল। তখন কৃষকরা সৌরবর্ষ অনুযায়ী ফসল সংগ্রহ করত কিন্তু চন্দ্রবর্ষ অনুযায়ী তাদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করা হতো। ফলে এটি কৃষকদের জন্য শুধুই বিড়ম্বনার ছিল। তাই আকবর তার রাজত্বের শুরু থেকেই দিন-তারিখ গণনার সুবিধার্থে একটি বিজ্ঞানভিত্তিক, আধুনিক ও যুগোপযোগী বর্ষপঞ্জির প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেন। এজন্য আকবর জ্যোতির্বিদ ও বিজ্ঞানী আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে হিজরী বর্ষপঞ্জি সংস্কার করে তা যুগোপযোগী করে তোলার দায়িত্ব অর্পণ করে। সে সময় বঙ্গে শক বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করা হতো আর চৈত্র ছিল শক বর্ষের প্রথম মাস।

বিজ্ঞানী শিরাজী ৯৬৩ হিজরী সালের শুরু থেকে বাংলা বর্ষ ৯৬৩ অব্দের সূচনা করেন। ৯৬৩ অব্দের পূর্বে বাংলা বর্ষে আর কোনো সন বিদ্যমান ছিল না। আরবি মুহাররম মাসের সাথে বাংলা বৈশাখ মাসের সামঞ্জস্য থাকায় বাংলা অব্দে চৈত্রের পরিবর্তে বৈশাখকে প্রথম মাস করা হয়। তারিখ-ই এলাহির সূচনা থেকে ৪৫৬ বছর পর বাংলা (১৪১৯) ও হিজরী (১৪৩৩) বর্ষপঞ্জিতে প্রায় ১৪ বছরের ব্যবধান পাওয়া যায়। অর্থাৎ হিজরী সাল বাংলা সন থেকে প্রায় ১৪ বছর এগিয়ে। তার কারণ হিজরী বর্ষ হচ্ছে চন্দ্র নির্ভর আর বাংলা বর্ষ হচ্ছে সূর্যনির্ভর। চন্দ্রবর্ষ হয় ৩৫৪ দিনে, আর সৌরবর্ষ হয় ৩৬৫ বা ৩৬৬ দিনে। অর্থাৎ চন্দ্র বর্ষ থেকে সৌরবর্ষ ১১ বা ১২ দিন এগিয়ে। তবে উভয়ই সৌরবর্ষ ভিত্তিক হওয়ায় বাংলা ও গ্রেগরিয়ান বর্ষের মধ্যে পার্থক্য নিতান্তই কম। তারিখ-ই এলাহির সূচনার সময় বাংলা ও গ্রেগরিযান বর্ষের মধ্যে পার্থক্য ছিল ১৫৫৬-৯৬৩ = ৫৯৩ বছর। অর্থাৎ বাংলা সনের সাথে ৫৯৩ যোগ করলে খ্রিষ্টীয় সন পাওয়া যায়।

বঙ্গাব্দের বারো মাসের নামকরণ করা হয়েছে নক্ষত্রমন্ডলের চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। এই নামসমূহ গৃহীত হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ সূর্যসিদ্ধান্ত থেকে। বাংলা মাসের এই নামগুলো হলোঃ- বৈশাখ- বিশাখা নক্ষত্রের নাম অনুসারে, জ্যৈষ্ঠ- জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নাম অনুসারে, আষাঢ়- উত্তর ও পূর্ব আষাঢ়া নক্ষত্রের নাম অনুসারে, শ্রাবণ- শ্রবণা নক্ষত্রের নাম অনুসারে, ভাদ্র- উত্তর ও পূর্ব ভাদ্রপদ নক্ষত্রের নাম অনুসারে, আশ্বিন- আশ্বিনী নক্ষত্রের নাম অনুসারে, কার্তিক- কৃত্তিকা নক্ষত্রের নাম অনুসারে, অগ্রহায়ণ (মার্গশীর্ষ) মৃগশিরা নক্ষত্রের নাম অনুসারে, পৌষ- পুষ্যা নক্ষত্রের নাম অনুসারে, মাঘ- মঘা নক্ষত্রের নাম অনুসারে, ফাগুন- উত্তর ও পূর্ব ফাল্গুনী নক্ষত্রের নাম অনুসারে, চৈত্র- চিত্রা নক্ষত্রের নাম অনুসারে।

নতুন বছর একজন লোকের ভাল যাক এটা তার বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাঙ্খীররা অবশ্যই কামনা করে। আর এ শুভ কামনা আমরা লক্ষ্য করি নববর্ষের শুভেচ্ছা কার্ড বিতরণের মাধ্যমে। নববর্ষের আরও পূর্বেই দোকান থেকে বিষয়ভিত্তিক শুভেচ্ছা কার্ড সংগ্রহ করে আপনজনের ঠিকানায় ডাকযোগে পাঠানো হয়। দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে শুভেচ্ছা বাণী দিয়ে থাকে যা পত্র-পত্রিকায় এবং রেডিও-টেলিভিশনে প্রচার করা হয়। আধুনিককালে মোবাইল ফোনে এসএমএস-এর মাধ্যমে এবং ইন্টারনেটে ই-মেইলের মাধ্যমে এবং কেউ কেউ সরাসরি ফোন করেও নববর্ষের শুভেচ্ছা জানায়।

পহেলা বৈশাখ উদযাপনে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঐদিন সরকারী ছুটি থাকে। ফলে লোকজন ছুটির দিন কাটানোর আমেজ নিয়ে ঘর থেকে বের হয়। আবার রাষ্ট্রীয় বেতার ও টেলিভিশনে এবং বেসরকারী চ্যানেলগুলো ও পত্র-পত্রিকায় ঐদিন নববর্ষ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। পত্র-পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশের সুবাদে লেখক-কবি-সাহিত্যিকগণ নানা নিবন্ধ, প্রবন্ধ, কবিতা ইত্যাদি রচনা করে থাকেন। বিশেষ সাময়িকপত্রও প্রকাশিত হয় এ উপলক্ষে। বেতার-টিভিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানের মধ্যে টকশো, আলোচনা, আবৃত্তি, সরেজমিন প্রতিবেদন ইত্যাদি নানা মাত্রার আয়োজন থাকে।

বাংলা সন প্রবর্তনই করা হয়েছিল জমির খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে। একটি কথা বলে রাখা ভাল আমাদের প্রাচীন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সরকার চলতো কৃষকের দেয়া খাজনার টাকায়। আজকাল আয়কর, সম্পদকর, নানা রকম শুল্ক, উন্নয়ন কর, শিল্প, প্রাকৃতিক সম্পদ, বিদ্যুৎ টেলিফোন ইত্যাদি নানা খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়ে থাকলেও জমির খাজনা কিন্তু এখনো জারী আছে। প্রাচীনকালে যেহেতু মোটামুটি জমির খাজনার উপরই জমিদার, সুবাহদার, সরকার সবাইকে নির্ভর করতে হতো তাই খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে বছরের প্রথম দিন আয়োজন করা হতো পুইনাহ নামক অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানে রায়ত বা প্রজা রাজাকে তার প্রাপ্য খাজনা পরিশোধ করে দিত। কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের এই পুন্যাহ অনুষ্ঠানের রীতিও এখন পরিবর্তিত হয়েছে। এখন নানা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান তাদের পাওনা আদায়ের জন্যে হালখাতা অনুষ্ঠানের ন্যায় পুন্যাহ অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। এ অনুষ্ঠানেও মিষ্টি বিতরণের এবং ক্ষেত্র বিশেষে আরও ভাল খাবার-দাবারের আয়োজন করা হয়ে থাকে। পাশাপাশি বিনোদনের জন্য কলের গান, গ্রামোফোন ইত্যাদির আয়োজন যুক্ত হয় এর সাথে।

একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের অধিবাসী হিসেবে আমরা এখন আমাদের আত্মপরিচয় ও সংস্কৃতিতে জানা ও চর্চা করা দরকার। বাংলা সন, পহেলা বৈশাখ আমাদের জীবনে জাগরণের এক মন্ত্র। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে নিষ্কলুষ অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে আমরা দেশের সংস্কৃতির লালনের পাশাপাশি জাতীয় চেতনাকে করতে পারি দৃঢ়। আমাদের উচিত হবে সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশে ভাল অনুষ্ঠানগুলো পালনে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া। বাংলাদেশের যে কোন বিষয়ে যারা ভাল করে, ভাল অবদান রাখে তাদেরকে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে পুরস্কৃত করা। বাংলাদেশে জমির খাজনা বাংলা মাসের হিসাবে পরিশোধ করার রেওয়াজ কয়েকশ বছর যাবত চালু আছে। এ ব্যবস্থাকে বাতিল করা যাবেনা। আসুন, পহেলা বৈশাখকে  আমরা আমাদের প্রাণের উৎসব হিসাবে পালন করি।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাঁথিয়া মহিলা ডিগ্রি কলেজ, সাঁথিয়া,পাবনা।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি