প্রভাষক
২২ মে, ২০২২ ০৬:৩৬ অপরাহ্ণ
কালিয়াকৈর উপজেলার পদার্থবিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. মেঘনাদ সাহার জীবনী
কালিয়াকৈর উপজেলার পদার্থবিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. মেঘনাদ সাহার জীবনী
জন্ম, বাল্যকাল ও সমাজ জীবন
মেঘনাথ সাহা ৬ অক্টোবর, ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ববঙ্গের ঢাকা জেলার অন্তর্গত শেওড়াতলী গ্রামে (বর্তমানে বাংলাদেশের গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার অন্তর্গত)
জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম জগন্নাথ সাহা ও মাতার নাম ভুবনেশ্বরী সাহা। তিনি
ছিলেন পঞ্চম সন্তান।[১০] তার পিতা ছিলেন পেশায় মুদি।
তৎকালীন সময়ের ধর্মগোড়া উচ্চ-অহংকারী ব্রাহ্মণদের
কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মীয় মতাদর্শের কারণে এবং শৈশব-কিশোর এবং কর্মজীবনে জাতপাতের
শিকার হওয়ায় তার হৃদয়ে বৈদিক হিন্দুধর্মের গোঁড়ামির প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মেছিল।
প্রাথমিক
শিক্ষা
গ্রামের টোলে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। সেই সময় তার গ্রামের
বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখার করার সুযোগ ছিল। তার পিতা ছোটবেলায়
তার বিদ্যাশিক্ষা অপেক্ষা দোকানের কাজ শেখা আবশ্যক মনে করেন। কিন্তু তার দাদা
জয়নাথ এবং তার মায়ের ঐকান্তিক চেষ্টায় এবং তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা
তার ইতিহাস এবং গণিতের মেধার কথা তার পিতার কাছে অবগত করলে তার পিতা তাকে হাই
স্কুলে ভর্তি করতে সম্মত হন। এরপর তিনি শেওড়াতলী গ্রাম থেকে সাত মাইল দূরে
শিমুলিয়ায় মধ্য ইংরাজি বিদ্যালয়ে (মিডল স্কুল - ব্রিটিশ আমলে চতুর্থ ও পঞ্চম
শ্রেণি পড়ার স্কুল) ভর্তি হন। এত দূরে প্রতিদিন যাওয়া আসা করে তার পক্ষে
পড়াশোনা করা দুরূহ হওয়ার পাশাপাশি মেঘনাদের বাবার পক্ষেও আর্থিক সামর্থ্য ছিল না
শিমুলিয়া গ্রামে মেঘনাদকে রেখে পড়ানোর। তখন মেঘনাদের বড় ভাই এবং পাটকল কর্মী
জয়নাথ শিমুলিয়া গ্রামের চিকিৎসক অনন্ত কুমার দাসকে মেঘনাদের ব্যবস্থা নিতে
অনুরোধ করায় তিনি রাজি হন। সেখানে তিনি শিমুলিয়ার ডাক্তার অনন্ত নাগের বাড়িতে
থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির পাঠ লাভ করেন। এই স্কুল থেকে তিনি শেষ পরীক্ষায় ঢাকা
জেলার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে বৃত্তি পান।
ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ
মেঘনাদ ১৯২৮ সালে তার সমস্ত গবেষণার ফলাফল একত্র করে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রির
জন্য আবেদন করেন। তার সব গবেষণা বিবেচনা করার জন্য উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
তার থিসিস পেপার বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। বিদেশে অধ্যাপক ডাবলু রিচার্ডসন,
ডঃ পোর্টার এবং ডঃ ক্যাম্বেল তার থিসিস পেপার পর্যালোচনা করেন। এরপর
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ১৯১৯ সালে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি প্রদান করে। একই বছর মেঘনাদ প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন। যার ফলে তিনি ইংল্যান্ড ও জার্মানীতে গবেষণার
সুযোগ পান।
কর্মজীবন
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগদীশ চন্দ্র বসু, সত্যেন বোস সহ অন্যান্য বাঙালি বিজ্ঞানীদের সাথে মেঘনাদ সাহা
১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আশুতোষ
মুখোপাধ্যায়, কলকাতার বিখ্যাত
আইনজীবী তারকনাথ পালিত রাজবিহারী ঘোষের অর্থানুকূল্যে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও গণিত বিভাগে
স্নাতকোত্তর পাঠ্যক্রম পঠনের জন্য রাজাবাজার সায়েন্স
কলেজ উদ্বোধন করেন। সেসময় উপাচার্য মেঘনাথ
সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর স্নাতকোত্তরের ফল ভাল থাকায় তাদের গণিত বিভাগে প্রভাষক
হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়। তারা দুজনেই গণিতের প্রভাষক হিসেবে
নিযুক্ত হন কিন্তু তাদের পদার্থবিজ্ঞান পছন্দসই বিষয় হওয়ায় উপাচার্যের অনুমতি
নিয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে চলে আসেন। গণিত বিভাগের প্রভাষক থাকাকালীন মেঘনাথ
সাহা জ্যামিতি ও ভূগোলের বিষয়
অধ্যায়ন করেছিলেন এবং পাঠদান করেছিলেন। তার ভূ-তাত্বিক বিজ্ঞান সম্পর্কিত আগ্রহ থেকেই পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে ভূতত্ত্ববিদ্যা
পাঠক্রমের সূচনা হয়। পরবর্তী সময়ে তিনি ভূতাত্ত্বিক সময় নিরূপণ
বিষয়ের উপর গবেষণা করেছিলেন।
১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে দেবেন্দ্রমোহন বসু গবেষণার জন্য জার্মানিতে যান কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য অন্তরীণ হয়ে পরায় মেঘনাথ সাহা এবং সত্যেন্দ্রনাথ
বসুকে তাত্বিক ও পরীক্ষামূলক গবেষণায় নিয়োজিত হতে হয়। সেই সময় প্রবীণ অধ্যাপক
ছাড়াই মেঘনাথ সাহা পদার্থ বিজ্ঞানের গবেষণা শুরু করেন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে এস
কে মিত্র, পি
এন ঘোষয়ের সহযোগিতায় তিনি
পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পড়ানোর ব্যবস্থা করতে সক্ষম
হন। সেই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তিনি প্রভাষক হিসেবে তাপ গতিবিদ্যা পড়াতেন। আধুনিক পদার্থবিদ্যার বিষয়গুলি তিনি ও তার
সহযোগীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেন।
আপেক্ষিকতাবাদ সহ আধুনিক পদার্থবিদ্যার সদ্য আবিষ্কৃত বিষয়গুলি তারা পাঠ্যক্রমে
অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তৎকালীন সময়ে পদার্থবিজ্ঞানে বিষয়গুলির মূলত জার্মান
ভাষায় প্রকাশিত হত, সেগুলিকে ইংরাজিতে অনুবাদ করতে হয়েছিল। তার ঢাকা কলেজে
পড়াকালীন জার্মান ভাষা শিক্ষা এই কাজে তাকে সাহায্য করেছিল।
সাধারণ আপেক্ষিকতা
তত্ত্ব আবিষ্কারের তিন
বছরের মধ্যেই তিনি ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু সেটা জার্মান থেকে অনুবাদ করেছিলেন যা ইংরেজি ভাষায় সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের সর্বপ্রথম অনুবাদ। প্রিন্সটনের আইনস্টাইন আর্কাইভে তাদের
অনুবাদের একটি প্রত্যায়িত রাখা আছে।
১৯১৭ থেকে ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কোন প্রবীণ অধ্যাপকের
তত্ত্বাবধান ছাড়াই তিনি লন্ডনের ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিন ও ফিজিক্যালি রিভিউ
জার্নালে তার মৌলিক গবেষণা গুলি প্রকাশ করেন। বিকিরণ চাপ সম্পর্কিত গবেষণা জন্য
১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন।১৯১৯
খ্রিষ্টাব্দে অন হার্ভার্ড ক্লাসিফিকেশন অফ স্টেলার স্পেক্ট্রাম গবেষণার
জন্য প্রেমচাঁদ
রায়চাঁদ বৃত্তি পান এবং বিদেশে
গবেষণার সুযোগ পেয়ে যান।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা
রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজে মেঘনাদ সাহার স্মৃতির উদ্দেশ্যে
স্থাপিত আবক্ষ মূর্তি
মেঘনাথ সাহা ২৪ বছর বয়সে ফিলোসফিক্যাল মাগাজিনে “On
Maxwell’s Stress” শিরোনামে তার প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।[৩৬] তিনি
কমবেশি ৮০ টি মৌলিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। তিনি তার সবকটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাই ভারতের
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে করেছেন। এরমধ্যে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান
বিভাগ, এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান
বিভাগ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের পালিত গবেষণাগার এবং ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার
ফিজিক্স অন্যতম। এছাড়া তিনি বিদেশে ফাউলার এবং নার্নস্টের
গবেষণাগারে কিছুদিন গবেষণা করলেও সেখানে কোন বিজ্ঞানী সহযোগিতায় একটাও গবেষণাপত্র
প্রকাশ করেননি। তার গবেষণার কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান। এই বিষয়ে
তিনি আয়নন তত্ত্ব এবং নক্ষত্রের শ্রেণিবিন্যাসে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। এছাড়াও বিকিরণ তাপ, পরমাণু বিজ্ঞান, তাপগতিতত্ত্ব, বর্ণালী বিজ্ঞান এবং আয়নোস্ফিয়ার সম্পর্কিত
অনেক গবেষণা করেছেন। পরবর্তীকালে তিনি পরমাণু ও নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কিত
গবেষণা করেন এবং ভারতে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করায় উৎসাহী হন।
এছাড়াও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় পরমাণু বিজ্ঞান, জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা, নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যা,
আয়ন মণ্ডল, বায়ুমণ্ডল ও মহাকাশবিজ্ঞান, পঞ্জিকা সংস্কার, বন্যা প্রতিরোধ ও নদী পরিকল্পনা
সহ নানা বিষয়ে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনামূলক নিবন্ধ লিখেছেন।
সাহা সমীকরণ
ডক্টর সাহা তার তাপীয় আয়ন-তত্ত্বে আয়নীভবন সংক্রান্ত একটি
সমীকরণ উপস্থাপন করেন যা সাহা আয়নীভবন সমীকরণ নামে
পরিচিত। ১৯২০ সালে Philosophical Magazine–এ প্রকাশিত প্রবন্ধে সাহা এই
সমীকরণ দেন। একটি একক পরমাণু দ্বারা গঠিত গ্যাসের জন্য সাহা সমীকরণটি হল:
যেখানে,
রাশিমালা
যেখানে
প্লাসকেটের কাছে তিনি চিঠিতে তার আবিষ্কৃত আয়নন তত্ত্বের
আবিষ্কারের ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন
“ |
|
জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে যখন ভাবছি এবং এমএসসিতে তাপ
গতিতত্ত্ব ও বর্ণালি বিজ্ঞান পড়াচ্ছি তখনই ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে তাপীয় আয়ননতত্ত্বের
ধারণা আমার মাথায় আসে। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে ডিসেম্বর সংখ্যায় Phusikalische
Zeitschrift (৫৭৩পৃ.) পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ পড়ে দেখি যে, এডিংটন নক্ষত্রের
গঠন নিরূপণে নক্ষত্রের উচ্চ উষ্ণতায় পরমাণু ও আয়নের যে কথা বলেছিলেন, তা ব্যাখ্যা
করতে এগার্ড নার্নস্টের তাপ তাপতত্ব প্রয়োগ করেছেন। নার্নস্টের ছাত্র ও তার সহকারী
এগার্ড নার্নস্টের তাপীয় আইনের যে সূত্র দিয়েছেন তাতে বোরের তত্ত্ব থেকে আয়নন
বিভব যে ধারণা পাওয়া যায় তা লক্ষ্য না করেই সূত্রটি তৈরি করেছেন। ফ্রাঙ্ক ও হাৎজ
যে বোর তত্ত্বের সফল পরীক্ষা করেছেন সে সময় তা বিজ্ঞান জগতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
এগার্ড ইলেকট্রনের জন্য সাকুরের সূত্রের রাসায়নিক স্থিরাঙ্ক ব্যবহার করেছেন কিন্তু
লোহার মত ভারী পরমাণুর ইলেকট্রন বিযুক্ত অবস্থায় বহুধা আয়নন বিভবের মান কৃত্রিমভাবে
কল্পনা করেছেন। তার ভিত্তিতে তিনি নক্ষত্রের অভ্যন্তরে লোহার আয়তন ব্যাখ্যা করার
চেষ্টা করেছেন। এগার্টের গবেষণাপত্র আমার ধারণা হলো এগার্টের সূত্রে আয়নন বিভব নিখুঁত
মান বসিয়ে পরমাণুর একক বা বহুদা আয়নায়ন যেকোনো উষ্ণতা ও চাপে গণনা করা একান্ত
জরুরী। এই থেকে আমি আমার তাপীয় আয়নন সূত্র আবিষ্কার করি, যা এখন আমার নামে পরিচিত।
ক্রোমোস্ফিয়ার ও নক্ষত্রের সমস্যা আমার জানা ছিল। আমি সেই সূত্র তখনই সেখানে প্রয়োগ
করি। |
১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে আক্রান্ত
হয়ে মারা যান। এ সময় তিনি তার কর্মস্থল ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ভবনের পরিকল্পনা কমিশনের দিকে
যাচ্ছিলেন; এমন সময় পড়ে যান। হাসপাতালে নেবার পর স্থানীয় সময় সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে
মারা যান। রিপোর্টে বলা হয়: তিনি মারা যাবার ১০ মাস আগে থেকে উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। তাকে
পরের দিন কলকাতার কেওড়াতলা মহাশ্মশান এ দাহ
করা হয়।