সহকারী শিক্ষক
০২ জুলাই, ২০২২ ০৮:৪০ অপরাহ্ণ
অ্যাডিডাস এর ইতিহাস ও বিখ্যাত হয়ে ওঠা
অ্যাডিডাস এর ইতিহাস ও বিখ্যাত হয়ে ওঠা
সারা পৃথিবী জুড়ে ইয়াং জেনারেশনের কাছে অ্যাডিডাস নিয়ে একটা আরবান লিজেন্ড প্রচলিত আছে। অ্যাডিডাসের সম্পূর্ণ মানে হল “অল ডে আই ড্রিম অ্যাবাউট স্পোর্টস (ADIDAS = All Day I Dream About Sports)।
তবে আসল ঘটনা হল, অ্যাডিডাসের নামকরণ করা হয়েছে এর প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডলফ ‘অ্যাডি’ ড্যাসলার এর নামে। অ্যাডি এবং তার ভাই এই কোম্পানিটি শুরু করেছিলেন। তবে কোন পরিপ্রেক্ষিতে কীভাবে তারা এটা শুরু করেছিলেন এবং পরবর্তীতে কী হল সেসব ঘটনা মানুষ তেমন একটা জানে না।
.
# অ্যাডিডাসের শুরু
জার্মানির বাসিন্দা অ্যাডলফ (অ্যাডি) ড্যাসলার খুব ভালো ফুটবল খেলতেন। তার বাবা ছিলেন পেশায় একজন মুচি। অ্যাডি’র বয়স যখন ২০ বছর তখন সে মাঠে খেলার জন্য ও দৌড়ানোর জন্য স্পাইকওয়ালা বিশেষ এক ধরনের জুতা তৈরি করে।
এটা ১৯২০ সালের কথা। চার বছর পরে, ১৯২৪ সালে, অ্যাডির ভাই রুডলফ (রুডি) ড্যাসলার ও অ্যাডি মিলে জার্মানিতে ‘গেবরুডার ড্যাসলার’ নামে একটা স্পোর্টস স্যু কোম্পানি তৈরি করে। এই জুতার কোম্পানিটিই পরবর্তীতে, কালের বিবর্তনে, অ্যাডিডাস হয়ে উঠেছে।
১৯২৫ সালের দিকে ড্যাসলার ভাইয়েরা চামড়ার জুতা তৈরি করত। এগুলি ছিল মূলত স্পোর্টস জুতা ও দৌড়ানোর জুতা। সেসব জুতায় হাতে তৈরি স্পাইক লাগানো হত।
১৯২৮ সালে সর্বপ্রথম অ্যাডি ড্যাসলারের নিজস্ব ডিজাইন করা জুতা বিখ্যাত হতে শুরু করে। এটা ১৯২৮ সালের আমস্টারডাম অলিম্পিকের ঘটনা।
১৯৩৬ সালের অলিম্পিক ড্যাসলার ভ্রাতৃদ্বয়ের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। এই অলিম্পিকে বিখ্যাত অ্যাথলেট জেসি ওয়েন ড্যাসলারদের তৈরি করা জুতা পরে ট্র্যাকে দৌড়ান এবং যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে মোট ৪টি গোল্ড মেডেল জিতে নেন।
১৯৫৯ সালে অ্যাডলফ ‘অ্যাডি’ ড্যাসলার যখন মারা যান, তখন সাতশ’রও বেশি স্পোর্টস স্যু এবং অ্যাথলেটিক সামগ্রীর ডিজাইন তার নামে পেটেন্ট করা। ১৯৭৮ সালে আমেরিকান ক্রীড়া সামগ্রী প্রস্তুতকারক ইন্ডাস্ট্রির হল অব ফেমে তাকে উপাধি দেওয়া হয়েছে আধুনিক ক্রীড়া সামগ্রী প্রস্তুতকারক ইন্ডাস্ট্রির প্রতিষ্ঠাতা।
.
# ড্যাসলার ভ্রাতৃদ্বয় ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যাডলফ ও রুডলফ দুই ভাইই এনএসডিএপি’র (NSDAP- The National Socialist German Workers’ Party) সদস্য ছিলেন। ওই সময় তারা দূর থেকে ট্যাংকে গোলা নিক্ষেপ করার বাজুকা ধরনের একটা বিশেষ অস্ত্র তৈরি করেন। জার্মান ভাষায় এই অস্ত্রের নাম ছিল ‘প্যানজারশেরেক’। এই অস্ত্র তৈরিতে শ্রমিকদেরকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্য করা হয়েছিল—এমন একটা গুজব প্রচলিত আছে।
পরবর্তীতে যুদ্ধের সময়ই ড্যাসলার ভাইয়েরা হিটলারের নাৎসি পার্টিতে যোগ দেন। এবং মজার কথা হল, হিটলার ইয়ুথ মুভমেন্টে অংশগ্রহণকারীদের জন্য অ্যাডি ড্যাসলার জুতা সরবরাহ করতেন। তখন অবশ্য, ১৯৩৬ অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী জার্মান অ্যাথলেটদের জন্যও অ্যাডি জুতা সরবরাহ করছিলেন। এমন একটা কথা প্রচলিত আছে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যেসব রাশিয়ান সৈন্য জার্মান বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছিল, অ্যাডি ড্যাসলার নাকি তাদেরকে তার কোম্পানিতে শ্রমিক হিসাবে ব্যবহার করছিলেন। কারণ তখন যুদ্ধের কারণে কাজ করার মত শ্রমিক সংকট ছিল।
তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ই ড্যাসলার ভ্রাতৃদ্বয়ের সম্পর্কে চিড় ধরে এবং তাদের সম্পর্ক ভেঙে যায়। এর পিছনের কারণ হল, অ্যাডির ভাই রুডলফ বিশ্বাস করতেন অ্যাডি আমেরিকান ফোর্সের সাথে গোপনে যোগ দিয়ে জার্মান বাহিনীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। যুদ্ধের পরে, ১৯৪৮ সালে রুডলফ ড্যাসলার নিজেই আলাদা একটা কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। ক্রীড়া সামগ্রী তৈরিকারী রুডলফের সেই কোম্পানিটিই আজকের বিখ্যাত ব্র্যান্ড পুমা। পুমা তখন থেকেই অ্যাডিডাসের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।
.
# আধুনিক সময়ে অ্যাডিডাস ব্র্যান্ড হিসাবে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল যেভাবে
১৯৭০ এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাথলেটিক জুতার ব্র্যান্ড হিসাবে সবার উপরে ছিল অ্যাডিডাস। ১৯৭১-এ বক্সার মোহাম্মদ আলী ও জো ফ্রেজার এর সেই বিখ্যার লড়াই—‘দ্যা ফাইট অব দ্য সেঞ্চুরি’-তে দুজনই অ্যাডিডাসের জুতা পরে বক্সিং-এ নেমেছিলেন।
১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিক গেমসের অফিসিয়াল সাপ্লায়ার ছিল অ্যাডিডাস।
যদিও এই গত কয়েক বছরে অ্যাথলেটিক স্যু এর আন্তর্জাতিক বাজারে অ্যাডিডাসের শেয়ার কিছুটা কমেছে, তবে এখনো অ্যাডিডাস ব্র্যান্ড হিসাবে বিরাট শক্তিশালী। জার্মানীতে সাধারণ একটা পারিবারিক ব্যবসা হিসাবে শুরু হওয়া অ্যাডিডাস এখন বিরাট একটা কর্পোরেশন। ফ্রান্সের আরেক গ্লোবাল কর্পোরেশন সালোমন এর সাথে জোটবদ্ধ হয়ে তারা সারা পৃথিবীতে অপারেট করছে।
২০০৪ সালে অ্যাডিডাস যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ভ্যালে অ্যাপারেল কোম্পানিকে কিনে নিয়েছে। ভ্যালে অ্যাপারেল কোম্পানিটি যুক্তরাষ্ট্রের ১৪০টিরও বেশি কলেজের অ্যাথলেটিক দলের পোশাক ও সরঞ্জাম সরবরাহের জন্য চুক্তিবদ্ধ ছিল। এখন সেগুলি অ্যাডিডাসের অধীনে।
২০০৫ সালে অ্যাডিডাস ঘোষণা দিয়ে আরেক বিখ্যাত কোম্পানি রিবক-কে কিনে নেয়। রিবক-কে কিনে নেওয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে নাইকি’র সাথে প্রতিযোগিতায় অ্যাডিডাস কয়েক ধাপ এগিয়ে যায়।
অ্যাডিডাসের মূল ভবন বা হেডকোয়ার্টার এখনো জার্মানীতেই অবস্থিত, অ্যাডি ড্যাসলারের নিজের শহর সেই হারজোগেনাউরাক-এ। বিখ্যাত জার্মান ফুটবল ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখের মালিকানায়ও অ্যাডিডাসের বড় একটা অংশিদারিত্ব আছে।
- - -
ছবি. জার্মানির হেরজোগানারাখে, অ্যাডি ড্যাসলার স্টেডিয়ামে, ভাস্কর জোসেফ তাবাচনিকের ২০০৬ সালে গড়া অ্যাডলফ ড্যাসলারের ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য
সূত্র. 'থটকো' ও 'দি ন্যাশনাল'
সৌঃ সি বি