Loading..

ম্যাগাজিন

১৮ জুলাই, ২০২২ ০৬:৩৪ অপরাহ্ণ

শিক্ষকতা সম্পর্কে এক বিচারকের মূল্যায়ন পড়ূন, ভালো লাগবে-

শামীমা আফরোজ। শৈশবে স্বপ্ন দেখেছেন শিক্ষক হওয়ার। তবে সময় তাকে বসিয়ে দিয়েছে বিচারকের আসনে। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের রিসার্চ অফিসার হিসেবে পেশাগত জীবনের পথচলা শুরু। তারপর বিভিন্ন জেলা আদালতে গুরুত্বপূর্ণ বিচারিক দায়িত্ব পালনের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে গাজীপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক।  তিনি দুই সন্তানের জননী। তার স্বামী দেলোয়ার হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের  অধ্যাপক। বর্তমানে প্রেষণে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

বিচারক শামীমা আফরোজ বর্তমান পেশাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করেন, ভালোবাসেন। ভালো বিচারক তৈরিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রয়েছে বলে বিশ্বাস করেন। তিনি চান, বিচার বিভাগের সুফল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পৌছে যাক। আদালত হয়ে উঠুক মানুষের সত্যিকারের শেষ আশ্রয়স্থল। তার মতে, আদালতের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা সমাজের মানুষে মানুষে অনাস্থার ও স্বার্থপরতার বহিঃপ্রকাশ। তাই চান, ছোট খাটো বিরোধগুলো মানুষ নিজেরাই নিষ্পত্তি করুক। আদালতে আসার প্রয়োজন যেন কমে যায়।

সম্প্রতি এক একান্ত সাক্ষাতকারে এমন আরও অনেক বিষয়ে অকপটে নিজের মতামত তুলে ধরেন বিচারক শামীমা আফরোজ। তার সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করেন দৈনিকশিক্ষাডটকম সম্পাদক ও দৈনিক আমাদের বার্তার নির্বাহী সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান খান।

সিদ্দিকুর রহমান খানঃ আপনি ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সময়টায় বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের রিসার্চ অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন ব্যারিষ্টার এম আমিরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ের অনেক কিছুর দুর্লভ সাক্ষী। আপনার কি মনে হয়, তার কাছে আরও অজানা অনেক কিছু আছে যা এখনই লিপিবদ্ধ করা উচিত?

শামীমা আফরোজঃ প্রথমত বলে রাখি, ছাত্রজীবন শেষ করার সাথে সাথে ব্যারিষ্টার এম আমীরুল ইসলামের মত একজন ব্যক্তির সঙ্গে কাজ করার সুযোগটা আমার জন্য অসাধারণ একটি ব্যাপার ছিলো। খুব কাছ থেকে তাঁর কাজ এবং ব্যক্তিত্বকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে। এটি আমার জন্য অনন্য একটি অভিজ্ঞতা! 

স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুর সময় এবং মুজিব নগর  সরকারের অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তিনি, ফলে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। আমি মনে করি, সেই সময় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তার দেখা ঘটনা তার জবানিতে Documented  হওয়া উচিত।

এছাড়াও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং মর্যাদার লড়াইয়ে তাঁর এবং সাথে আরও যাঁদের দীর্ঘ  সংগ্রাম রয়েছে, যে কারণে বিচার বিভাগ আজকের এই পর্যায়ে এসেছে, সেটার অভিজ্ঞতাও আমরা তাঁর কাছ থেকে জানতে পারি। দায়িত্বশীল কেউ এ ব্যাপারে তাঁকে এখনই তাগিদ দেবেন বলে আশা করি। তিনি এই ইতিহাসের একজন সাক্ষী এবং সেই ইতিহাসেরই অংশ। কিছুদিন পর হয়তো এই সুযোগটা আর থাকবে না। 

সিদ্দিকুর রহমান খানঃ প্রথম জেনারেশন বিচারক আর ২য় জেনারেশন বিচারক, এদের মধ্যে গুণগত পার্থক্য দেখেন?

শামীমা আফরোজঃ সময়ের সাথে সাথে প্রযুক্তি এবং অন্যান্য কারণে সব মানুষেরই জীবনযাত্রা এবং চিন্তা ভাবনায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। বিচারকদেরও এই Context এর মধ্যেই  কাজ করতে হয়। আমাদের আগে যারা এই বিচার বিভাগে ছিলেন, তাদের সঙ্গে সমাজের অন্যান্য মানুষের সাথে যোগাযোগ ছিলো সীমিত। জীবনযাত্রাও ছিলো অপেক্ষাকৃত সহজ। এখনকার প্রেক্ষাপট ভিন্ন হওয়ায় যোগাযোগের মাত্রা বেড়েছে। ফলে  কিছু তো পার্থক্য তৈরি হয়েছে! সেই পার্থক্য ভালো না মন্দের দিকে সেটার বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা হতে পারে এবং সেটা ভিন্ন আলোচনা। 

সিদ্দিকুর রহমান খানঃ এর চেয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলে ভালো করতেন মনে হয়?

শামীমা আফরোজঃ শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। একজন শিক্ষক তাঁর ছাত্রদের সামনে প্রজ্ঞা এবং অভিভাবকত্বের প্রতীক হয়ে দাঁড়ান। ছাত্রদের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য তৈরি থাকতে হয় তাঁকে। ছাত্রদের স্বপ্নকে জাগিয়ে দেবার দায়িত্বও তাঁর। এই পেশাকে ভীষণভাবে শ্রদ্ধা করি। তবে পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে অপেক্ষাকৃত কঠিন বলে মনে হয়েছে। শৈশবে স্বপ্নও দেখেছি শিক্ষক হবার। নিয়মিত শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করাটা আমার জন্য বেশ দুরূহ। আমার বর্তমান কাজটি ভালোবাসি। তবে শিক্ষকতায় যুক্ত হলে তার challenge গ্রহণ করতাম এবং আন্তরিকতার সাথেই সেই দায়িত্ব পালন করতাম। 

সিদ্দিকুর রহমান খানঃ ভালো বিচারক বা বিচারপতি পেতে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক কতটা জরুরি মনে করেন?

শামীমা আফরোজঃ সমাজে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ভালো শিক্ষকের অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ম-শৃঙ্খলা, নৈতিক শিক্ষা এবং জ্ঞান চর্চ্চার যে পরিবেশ, যে কোনো পেশার মানুষের মনে গভীর  ছাপ ফেলে। এসবই একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব তৈরিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এছাড়া একজন ভাল শিক্ষক তার ছাত্রদের মধ্যে স্বপ্ন জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেন। ফলে ভালো বিচারক তৈরিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রয়েছে। প্রাচীনকালে আমরা দেখেছি, ছাত্রদের একটা বড় সময় শিক্ষকের সাহচর্যে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যয় করার ঐতিহ্য ছিলো। সেটা সে সময়ের জাতির মনন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো। এখনও উন্নত বিশ্বে শিক্ষকরা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুবই দায়িত্বপূর্ণ এবং ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। 

আমার নিজের,  বাংলাদেশ ছাড়াও জাপান এবং রাশিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থাকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সেখানে দেখেছি academic শিক্ষার পাশাপাশি মানবিকতা, শৃঙ্খলা, Essential life skill এর বিষয়ে ছাত্রদের শেখানো হয়। এসব শিক্ষা পরবর্তীতে তাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। 

সিদ্দিকুর রহমান খানঃ এমন কোন রায় দিয়েছেন যেটা এখনও ঘুম নষ্ট করে?

শামীমা আফরোজঃ মানুষ মাত্রই ভুল করে। বিচারকরাও এর ব্যতিক্রম নন। কিছু কিছু সিদ্ধান্ত  দেয়ার পরে ভুল ছিল বলে পরবর্তীতে  মনে হয়েছে। অনেক আগের ঘটনা হলেও বিষয়গুলো আমাকে এখনও কষ্ট দেয়।

সিদ্দিকুর রহমান খানঃ দেশে উকিলের সংখ্যা বেশী হয়ে গেছে এমনটা অনেকে বলে থাকেন, আপনার কি মনে হয়?

শামীমা আফরোজঃ উকিলদের সংখ্যা নিয়ে আমি সমালোচনা করবো না, বা এটা নিয়ে আমি ভাবিতও নই। যেটা সমস্যা তা হলো পড়াশুনা করে, পরিশ্রম করে ওকালতি করার প্রবণতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে Criminal Practice টা মূলত জামিন নির্ভর হয়ে গেছে। এই ক্ষেত্রে অর্থের আগমন ভাল বলে তারা জামিন নিয়ে যত আগ্রহী, অন্য ক্ষেত্রে সেভাবে নন। ফলে Trial বা Argument এর জন্য ভালো উকিল পাওয়া যায় না এবং একই কারণে সিভিল মামলাতেও ভালো ও পরিশ্রমীও উকিল পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া নতুন প্রজন্মের উকিল দের মধ্যে Criminal Practice এর প্রবণতা বেশী।

সিদ্দিকুর রহমান খানঃ শুধু আর্থিকভাবে কেউ সৎ হলেই তাকে আমরা বাহবা দেই, কিন্তু নৈতিকভাবে সৎ হওয়ার তাগিদ সমাজে কতটা দেখতে পান?

শামীমা আফরোজঃ সততা বিষয়টাকে কেবল আর্থিক বিষয়ের সাথে বিবেচনা করার প্রবণতা মানুষের মধ্যে ব্যপকভাবেই আছে। একজন ব্যক্তির আচরণকে সামগ্রিকভাবে বিবেচনা না করে বিচ্ছিন্নভাবে কেবল তার আর্থিক সচ্ছতা নিয়ে আলোচনা করলে আলোচনাটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আর্থিকভাবে তো ব্যক্তিকে সৎ হতেই হবে, এ বিষয়ে কোনো compromise নাই। কিন্তু একজন ব্যক্তি ঘুষ খান না, কিন্তু তার কাজের প্রতি দায়িত্বশীল নন, আচার আচরণে রূঢ়, নৈতিকতার কোনো মানদণ্ডেই তাকে ফেলা যাচ্ছে না, সেটিও সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। 

সিদ্দিকুর রহমান খানঃ রাশানরা আমাদের ৭১ এর বন্ধু। আপনি ওখানে ছিলেন। রাশিয়া এখন ইউক্রেনে যা করছে তা নিয়ে আমাদের এখানকার বুদ্ধিজীবীরা নীরব, বিচারপতিরাও নীরব। এই নীরব থাকাতে আপনি কীভাবে দেখেন? 

শামীমা আফরোজঃ দেখুন, কোনো দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কেমন হবে এবং বৈশ্বিক কোনো ঘটনায় আমরা কী প্রতিক্রিয়া দেখাবো তা পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় ‘Policy’ গত বিষয়। এটা রাজনীতিবিদরা, যাঁরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত, তাঁরা নির্ধারণ করে থাকেন। কিন্তু দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে কথা বলাটা বিচারকদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তাঁরা কোনো পক্ষাবলম্বন করতে পারেন না। এটা Academician বা রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব। তবে, সমাজের অন্য সব মানুষের মতই একজন বিচারক কোথায় কী ঘটছে সেসম্পর্কে ওয়াকিবহাল হবেন এবং সে সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিও থাকবে। কিন্তু Publicly তা তাঁর প্রকাশ করাটা সমীচীন নয়।

সিদ্দিকুর রহমান খানঃ অবসরে যাওয়ার আগের দিন বিচারালয়ে কি অবস্থা দেখতে চান?

শামীমা আফরোজঃ অবসরে কেবল নয়, আমি এখনি চাই যে, বিচার বিভাগের সুফল প্রান্তিক জনগোষ্ঠি পর্যন্ত যেন পৌছে যায়। আদালত যেন হয় মানুষের সত্যিকারের শেষ আশ্রয়স্থল। সঠিক তথ্য না পাওয়ার কারণে আদালতে এসে মানুষের অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হয়। সত্যিকারের আধুনিক বিচার ব্যবস্থা চালু হলে এ সমস্যার সমাধান হবে বলে বিশ্বাস করি। তবে সাথে সাথে এটাও মনে করি, আদালতের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা সমাজের মানুষে মানুষে অনাস্থার ও স্বার্থপরতার বহিঃপ্রকাশ। অনেক সময় দেখা যায়, মানুষ অতিরিক্ত পরিমাণে আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করলে সমাজের অগ্রসরতা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলে আমি চাই যে, সমাজের মধ্যে শান্তি এবং সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পাক, ছোট খাটো বিরোধ নিজেরাই নিষ্পত্তি করুক। আদালতে আসার প্রয়োজন যেন কমে যায়।

বি: দ্র: লেখাটি দৈনিক আমাদের বার্তার ঈদুল আজহা ২০২২ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত। 

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি