Loading..

প্রকাশনা

২৯ জুলাই, ২০২২ ০৬:২৪ অপরাহ্ণ

আমাদের কিশোর জীবন ও কিশোর গ্যাং

আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে গ্রামে। গ্রামের মাঠ, গাছ, পুকুর, জোছনা রাত ছিল আমাদের বিনোদনের উপকরণ। তখন আমাদের হাতে মোবাইল, ভিডিও-গেম থাকত না। থাকত ফুটবল, ডাংগুলি; খুব বেশি হলে ক্রিকেট ব্যাট। বৃষ্টির মধ্যে কিংবা জোছনা রাতে দল বেঁধে ফুটবল খেলা কিংবা হৈ-হুল্লোড় ছিল আমাদের আনন্দের সর্বোচ্চ উৎস। কৈশোরকালের এই দল বেঁধে চলাই আমাদের কাছে ছিল কিশোর গ্যাং।

আমাদের সময় এইকিশোর গ্যাংএর যে অপরাধ প্রবণতা একেবারেই ছিল না, তা নয়। কারো ওপর রাগ হলে একটু শাসানো; কিংবা কারো বাড়িতে ঢিল ছুড়ে মারা; কিংবা কারো আমগাছের আম চুরি করা; কারো বাড়ির মুরগি চুরি করে পিকনিক করা- এই ছিল কিশোরদের অপরাধের তালিকা। অবশ্য এলাকারদাদু শ্রেণিরমানুষরা এগুলোকে খুব উপভোগ করতেন। এটাকে তারা বিনোদনের অংশ মনে করতেন। কিশোরদের সঙ্গে যোগ দিতেও দেখেছি তাদের। এমনকি যার বাড়িতে মুরগি চুরি করা হয়েছে- সেই বাড়ির দাদুও পিকনিকে যোগ দিতেন। তখন প্রযুক্তির এত উৎকর্ষতা ছিল না। খারাপ কাজের জন্য কখনো কিশোরদের সংবাদের শিরোনাম হতে হয়নি।

আমাদের কৈশোরকালের কয়েকটি ঘটনা বেশ মনে আছে। একবার আমাদের গ্রামের এক বৃদ্ধ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। দারিদ্র্যতার কারণে চিকিৎসা হচ্ছিল না। তখন গ্রামের কয়েকজন কিশোর মিলে গ্রামে গ্রামে টাকা-চাল তুলে ওই বৃদ্ধের পাশে দাঁড়িয়েছিল। একবার কন্যাদায়গ্রস্ত এক পিতার পাশে দাঁড়িয়ে তার মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল তখনকার দিনের কিশোর গ্যাং।

কিন্তু এখনকার কিশোর গ্যাং এর নাম শুনলেই রক্ত হিম হয়ে আসে। ছিনতাই, ছুরিকাঘাত, গুলি করে হত্যা, যৌন আসক্তি, দস্যিপনা, দুরন্তপনা চরমপন্থা, কথায় কথায় স্টেপ- এখনকার কিশোর গ্যাংয়ের নিত্য-নৈমিত্তিক কাজ। নিজেকে জাহির করতে, হিরো সাজতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ছে অপরাধের সঙ্গে। থেকে আর বের হতে পারছে না তারা। ফলে দিন দিন বাড়ছে কিশোর অপরাধের সংখ্যা।

বর্তমানে ছাত্রীকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করলে হত্যার শিকার হতে হয়। এমনকি শাসন করতে গিয়ে শিক্ষকরাও এসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। সেখানে সাধারণ মানুষ কী করবে? আর এখন প্রতিনিয়তই সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে কিশোর গ্যাং।

বিগত কয়েক বছর ধরে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত অনেক বেড়ে গেছে। বিষয়টি এখন অভিভাবক প্রশাসনের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিনিয়তই নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে সংবাদপত্রে। কয়েকদিন আগে দৈনিক যুগান্তরে উদাসীন পরিবারে বেপরোয়া সন্তান; অভিভাবক পুলিশও অসহায়, কাজে আসছে না মুচলেকা শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। অভিভাবক পুলিশ যেখানে অসহায় সেখানে এসব উঠতি কিশোরদের গ্যাং সামলামে কে?

এখন প্রশ্ন হচ্ছে- কেন এই কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান? নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা তাদের মতামত দিচ্ছেন। কিন্তু কিশোর গ্যাংয়ের লাগাম টানা যাচ্ছে না।

গত বছরের ২১ জুন দৈনিক যুগান্তরে এক প্রতিবেদনে কিশোর গ্যাং গড়ে তোলার নেপথ্যে অন্তত দুই ডজন মূল কারণ উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে- অস্ত্র মাদকের দৌরাত্ম্য, ভিনদেশি কালচারের অনুপ্রবেশ, বিশৃঙ্খল পারিবারিক পরিবেশ, কর্মহীনতা এবং হতাশা বোধ থেকে কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে গ্যাং কালচারে এছাড়া একাকিত্ব, অভিভাবকের সান্নিধ্য না পাওয়া, শিক্ষকদের অতিমাত্রার শাসন, খারাপ ফলাফল, সহপাঠীর মাধ্যমে বিদ্রূপ এবং স্কুলের ম্যানেজমেন্টের অব্যবস্থাপনার পাঠদান প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার বিষয়গুলো উসকে দিচ্ছে গ্যাং কালচার। কো-এডুকেশনে হিরোইজম, খারাপ সাহচর্য, আড্ডাবাজি, অপরাধ জগতে যুক্ত হওয়ার মানসিকতা থেকে অনেকে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হচ্ছে। পাশাপাশি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার হাতছানি, অল্প বয়সে যৌন আসক্তি, হীনমন্যতা থেকে ব্যক্তি সত্তা প্রমাণের চেষ্টা, দস্যিপনা, দুরন্তপনা চরমপন্থা মনোভাব থেকেও গ্যাংয়ে যোগ দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে।

ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘সারা দেশেই কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রক বা পৃষ্ঠপোষক রয়েছে। পর্দার আড়ালে থেকে রাজনৈতিক অভিমত, একই সমাজ ব্যবস্থার ভেতর যখন দরিদ্র শ্রেণি উচ্চবিত্তের বসবাস থাকে তখন উচ্চবিত্তের জীবনযাত্রা দেখে দরিদ্র শ্রেণির সন্তানরা নিজেদের ভাগ্যবঞ্চিত মনে করে। তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা তৈরি হয়। হতাশা থেকে কিশোর গ্যাংয়ের সৃষ্টি হতে পারে। সমাজে অস্ত্র মাদকের দৌরাত্ম্য গ্যাং কালচারকে উসকে দেয়। সমাজে যখন একটি গ্যাংয়ের অস্তিত্ব থাকে তখন তার বিপরীতে আরেকটি গ্যাং তৈরি হতে পারে। একে অপরকে দেখে অনেকে গ্যাং সদস্য হতে উৎসাহী হয়। সিনিয়ররা যখন জুনিয়রদের নিরাপত্তা দিতে না পারে তখন জুনিয়ররা গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ে। ভিনদেশি কালচারের অনুপ্রবেশে কিশোররা সহিংসতা সম্পর্কে জানতে পারে। সহিংসতায় আকৃষ্ট হয়ে ওই কালচার রপ্ত করতে চায়।

এখন ভাবতে হবে- এই সংকট থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? এখন কিশোর গ্যাং কালচার থেকে বের হতে গেলে প্রথমে অভিভাবকদের এগিয়ে আসতে হবে। সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতে হবে; তাদের সময় দিতে হবে। তাদের মনে আশা জাগাতে হবে। হতাশা, উচ্ছৃঙ্খলতা, হীনমন্যতা, অপরাধপ্রবণতা থেকে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনে মনোবিজ্ঞানীদের সহায়তা নিতে হবে। আমাদের যান্ত্রিক জীবনে এত কিছু করা কষ্টসাধ্য হলেও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমাদের তা করতে হবে। তবেই সম্ভব হবে কিশোর গ্যাংয়ের লাগাম টানা।

 

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি