সহকারী অধ্যাপক
৩০ আগস্ট, ২০২৩ ১২:৩০ পূর্বাহ্ণ
পিএইচডি কি বিক্রয়যোগ্য কোনো পণ্য?
পিএইচডি
কি বিক্রয়যোগ্য কোনো পণ্য?
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় থাকতে গেলে শুধু শিক্ষার উন্নয়নের
ক্ষেত্রেই নয়, পদোন্নতি পাওয়ার জন্যও পিএইচডি ডিগ্রির গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায়
নেই। আর এ পদোন্নতি বা শিক্ষার কথাইবা বলি কেন, উচ্চশিক্ষার যে কোনো পর্যায়ে
গবেষণাকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। অন্য যে কোনো সেক্টরে কাজ করে
গবেষণা করার ইচ্ছা অনেকেরই থাকতে পারে। পিএইচডি ডিগ্রি মূলত গবেষণার স্বীকৃতি।
আবার দেশের যে কোনো সেক্টরের যে কোনো কাজের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে
গবেষণার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এদেশে রাজনীতিতে গবেষণার গুরুত্ব কম। তাদের ভাষা, ‘আমি
যা বুঝি এটাই শেষ কথা’। ফলে শিক্ষা ক্রমেই তার মান হারাচ্ছে। জাতি হিসাবে আমরাই
ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছি। যে কোনো ক্লাসে যে কোনো কিছু শিখে বিষয়টি নিয়ে নিজের মতো
করে একটু ভাবা ও বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখাও এক ধরনের গবেষণা। যে কোনো পর্যায়ের
গবেষণাহীন লেখাপড়া দুর্গন্ধভরা স্রোতহীন বদ্ধ জলাশয়ের সমান। তাই জ্ঞানার্জন ও
জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
বর্তমানে বিদেশি অখ্যাত বা কৃত্রিম
বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে এ ধরনের ভুয়া কাজ কারবার বেশি চলছে। আবার সরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মধ্যে সাদা, কালো, নীল, লাল রঙের গ্রুপের তো অভাব নেই।
একরঙা পাখাওয়ালা পাখিগুলো যেভাবে একসঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে চলাফেরা করে ও জীবনকর্ম
চালিয়ে যায়। পাশাপাশি বসে একটা পাখি ঠোঁট দিয়ে অন্যটাকে পিঠ চুলকিয়ে দিতে সাহায্য
করে। সেভাবে এখানে রঙে রঙে একরঙা হয়ে দলীয় বিবেচনায় নামমাত্র একটা কিছু
ইন্টার্নশিপ রিপোর্টের মতো লিখে পিএইচডি সার্টিফিকেট প্রাপ্তি প্রায়ই ঘটে চলেছে,
যাকে মূলত কোনো গবেষণাই বলা যায় না। আমার এ কথা শুনে কেউ আপত্তি তুললেও নিজের
চোখকে তো আর অবিশ্বাস করা যায় না। এ পোড়া চোখজোড়া তো শুধু এদেশের বৃষ্টিস্নাত
স্নিগ্ধ শ্যামলিমায় ভরা সৌন্দর্যই দেখে না, পঙ্কিল দলবাজ রাজনীতির কদর্যে ভরা
স্বার্থান্বেষী মহলের সুবিধাবাদী অপকর্মও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। তাই এসব আমাদের
জানা। এ দেশের ‘গমও উদা, যাতাও ঢিলা’ হওয়াতে দলীয় যোগসাজশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়
থেকেই শুধু বর্ণনামূলক তথ্য দিয়েই রচনা লেখার মতো থিসিস লিখতে আমি অনেককেই দেখেছি।
অন্তত এদেশের অনেক কনফারেন্সের চেয়ার হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়েও অনেক থিসিস
প্রেজেন্টেশনে তা দেখেছি। মানসম্মত হয়নি বলে সমালোচনাও করেছি; কিন্তু ডিগ্রি পাওয়া
বন্ধ করতে পেরেছি কি? অনেক ক্ষেত্রে থিসিস পরীক্ষা করতে আমার কাছে পাঠানো হয়েছে;
কিন্তু মনমতো না হওয়াতে (লাল-সাদা, নীল-সবুজ সংকেত বুঝিনে বলে) অপারগতা জানিয়ে
ফেরত পাঠিয়েছি। তাদেরও পরে ডিগ্রি পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি। হয়তো আমার মতো বেরসিক
শিক্ষক বাদে অন্য কোনো যোগ্য সমমনা-সমরঙা শিক্ষক মূল্যায়নের দায়িত্ব পালন করেছেন।
আমি একথা বলছি না যে, এ দেশের সব থিসিসের অবস্থাই খারাপ। এটি সংশ্লিষ্ট
সুপারভাইজারের যোগ্যতা ও নৈতিকতার ওপর নির্ভর করে। এ দেশে বেশ কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে
অনেক ভালো গবেষণা ও ভালো মানের সুপারভাইজারও আছেন। এরা এ দেশের গর্ব, যদিও
বর্তমানে তাদের বাজার মন্দা। অনেক সুপারভাইজার থিসিসের মানের ক্ষেত্রে আপস করেন না
বিধায় তাদের কাছে ছদ্মবেশী গবেষকরা বা ছাত্রছাত্রীরা তেমন একটা আসতে চায় না। এ
ধরনের নীতিমান মানসম্মত সুপারভাইজারদের অনেককেই আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি, অনেককে
দূর থেকে জানি। সংগত কারণেই (জ্ঞানার্জনের তৃষ্ণা মূল্য হারানোর কারণেই) তাদের
চলতি বাজারে কদর কম। কোনোরকম পক্ষপাতিত্ব করতে পারেন না বলে বা আধুনিক (?)
মূল্যবোধের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেন না বলে, তাদের নামে কৃত্রিম দুর্নামও বাজারে
আছে। এ দেশে এদের সংখ্যা ক্ষীয়মাণ। মোট কথা হচ্ছে, সরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই
পিএইচডি গবেষণা হচ্ছে; কিন্তু অধিকাংশেরই মান আশানুরূপ নয়। আবার একথা খোলামেলা
বলতে গেলেই ‘উচিত কথায় খালু বেজার হয়’। উচিত কথা শুনতে আমরা তো কেউ প্রস্তুত নই। এ
দেশে বাস করে কতরকমের পিএইচডির ব্যবহারই যে দেখলাম, সব কথা লিখিত আকারে বলতে গেলে
অনেকেই আমাকে ছিদ্রানুসন্ধানী বলতে দ্বিধাবোধ করবেন না। অর্থাৎ পিএইচডি ডিগ্রি
সার্টিফিকেটের উদ্দেশ্য এবং এর অপব্যবহার ও ফাঁকিবাজি চলমান বাজারে অনেক দেখছি।
ইউজিসি-ই একমাত্র পারেন সত্যতা যাচাইয়ের দায়িত্ব নিতে। মান যাচাই করতে হয় ওই
গবেষণার থিসিস কোন মানের ও কোন গ্রেডের গবেষণা জার্নালে গবেষক প্রকাশ করেছেন, তা
দিয়ে। মনের এ খেদে পড়ে অনেক বছর নামের আগে ‘ড.’ ডিগ্রি লেখা ছেড়ে দিয়েছিলাম।
কিন্তু বিভিন্ন না বলা কারণে শেষ রক্ষা করতে পারিনি।
বিষয়টি হচ্ছে পিএইচডি ডিগ্রি থাকলেই তিনি
মহাজ্ঞানী, বর্তমান যুগে একথা ভাবার আর কোনো অবকাশ নেই। পিএইচডি ডিগ্রি থাক আর না
থাক, অন্তত স্কোপাস ইনডেক্সড কিউ-১ ও কিউ-২ জার্নালে এদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে ডিগ্রি নেওয়া ব্যক্তিরা যদি দেশের জন্য বর্তমান প্রয়োজনীয় টপিকের ওপর গবেষণা
প্রকাশ করতে পারেন, এটা কিন্তু কম অর্জন নয়। তাদের মূল্যায়ন করা উচিত।
সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক এবং এ দেশের অনেক গবেষক এভাবে গবেষণা
কর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। কাজটা কিন্তু রাজনৈতিক জোগসাজশে সস্তা সার্টিফিকেট অর্জন
করার তুলনায় অনেক ভালো। মানসম্মত গবেষণা আর্টিক্যাল ছাড়া ভালো র্যাংকড জার্নালে
প্রকাশ করা কঠিন। আমরা এ ধরনের গবেষণা প্রকাশনার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছি না কেন!
এদের গবেষণা কাজে পৃষ্ঠপোষকতা করি না কেন! আমরা ব্যক্তিস্বার্থে, কখনো জীবন
বাঁচাতে, কখনো ঝামেলা এড়াতে ‘ডাহা মিথ্যা, মতলববাজ কথাবার্তা’ বুঝেও চেপে যাই।
‘ঠেলার নাম বাবাজি’, তাই।
আজ পিএইচডি প্রসঙ্গে লেখার উদ্দেশ্য আমার ছিল
না। ইদানীং পত্রিকায় দেখছি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়ার ক্ষমতা
নিয়ে লেখালেখি চলছে। ‘একেতো নাচুনে বুড়ি, তাতে পড়েছে ঢোলের বাড়ি’-তাই এত বেমানান
কথার অবতারণা। ২৩ জুলাই ২০২৩ ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় খবরের শিরোনাম দেখলাম,
‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার বন্ধ দুয়ার খুলে দেওয়া দরকার’। সে আলোচনা
সভায় অনেক বিদগ্ধ ব্যক্তিরাই কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থার
ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। অনেকে আলোচনায় এমন ভাব দেখিয়েছেন যে, বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সুযোগ দিলে এদেশ গবেষণা ও জ্ঞান-গরিমায় ভরে যাবে। অথচ
মানসম্মত শিক্ষা ও এদেশে শিক্ষার উন্নয়ন নিয়ে কথা পত্রিকায় আসেনি। আমরা
সার্টিফিকেটধারী হতে চাই, না শিক্ষামানের উন্নতি চাই? কোনটা আগে দরকার? ‘বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়কে পিএইচডি ডিগ্রির অনুমতি দিতে বিধিমালা হচ্ছে’ শিরোনামে খবরটি
‘বাংলা ট্রিবিউনে’ প্রকাশিত হয় গত ২৬ জুলাই। এ থেকে জানা যায়, ‘দেশের বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়ার সুযোগ দিতে বিধিমালা তৈরির প্রস্তুতি
নিয়েছে ইউজিসি।’ আমার বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, এতে কোনো কোনো
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করার সুযোগ চলে আসবে, অনেক ক্ষেত্রেই অপাত্রে
সার্টিফিকেট প্রদান করা হবে, সার্টিফিকেট নিয়ে ব্যবসা শুরু হবে এবং আয়েসের সঙ্গে
নামমাত্র ইন্টার্নশিপ রিপোর্ট দেখিয়েই সার্টিফিকেট প্রাপ্তি হবে। আবার অনেক ভালো
মানের পিএইচডি সুপারভাইজার মধ্যম মানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়ে গেছেন, তারা
সুযোগবঞ্চিত হবেন। আবার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রে পিএইচডির
মানের যে অবনতি রাজনৈতিক ও অনৈতিক যোগসাজশে হচ্ছে, তারও কোনো উন্নতি আর হবে না।
আমি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি দেওয়ার সুযোগের বিরোধিতা করি না। তবে
সরকারি-বেসরকারি উভয় বিশ্ববিদ্যালয়েই একটা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার মধ্যে আনার পরামর্শ
দিই। এটাকে অতি সংক্ষিপ্ত নীতিমালা বলা যায়।
দেশে পিএইচডির জন্য ইউজিসি নিজের নিয়ন্ত্রণে
একটা কনসোর্টিয়াম প্রতিষ্ঠা করতে পারে। সেখানে আগ্রহী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে
কর্মরত (সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেও আপত্তি নেই) সুপারভাইজারদের সিভি নিয়ে নাম
তালিকাভুক্ত করতে পারে। সুপারভাইজারদের যোগ্যতা দেখা যেতে পারে। পিএইচডির জন্য
গবেষণায় আগ্রহীদের কাছ থেকে দরখাস্ত আহ্বান করতে পারে। মনোনীত গবেষকদের তালিকা
যেখানে প্রকাশ করবে। একটা গবেষণায় প্রথম ও দ্বিতীয় সুপারভাইজারের ব্যবস্থাও রাখা
যেতে পারে। গবেষকদের মাসিক বৃত্তি দিতে হবে। সুপারভাইজারদেরও মাসিক সম্মানি
প্রাপ্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। শিক্ষার্থীরা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম
রেজিস্ট্রেশন করবেন। তারা প্রথমেই কমপক্ষে চারটি বিষয়ে নিয়মিত ক্লাসে কোর্স-ওয়ার্ক
করবেন। পরীক্ষায় মানসম্মত গ্রেড পেয়ে পাশ করবেন। এরপর সুপারভাইজারের সঙ্গে নিয়ে
গবেষণা টপিক ও গবেষণা প্রপোজাল তৈরি করবেন। ইউজিসি নিয়ন্ত্রিত কনসোর্টিয়াম অফিসে
এক্সটারন্যালদের উপস্থিতিতে গবেষক প্রপোজাল ডিফেন্সে অংশ নেবেন এবং প্রয়োজনে
পরিবর্তনসাপেক্ষে গবেষণা প্রপোজাল চূড়ান্ত করবেন। গবেষণার কাজও শুরু হবে। মাঝপথে
প্রতিজন গবেষক কনসোর্টিয়াম কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে নিজের গবেষণা কাজের অগ্রগতি
তুলে ধরবেন; প্রয়োজনীয় সাজেশন নেবেন। নির্দিষ্ট মেয়াদ পূর্ণ হলে চূড়ান্ত গবেষণা
রিপোর্ট জমা দেওয়ার আগে গবেষক ও তার সুপারভাইজারের যৌথ নামে কিউ-১ বা কিউ-২
স্কোপাস ইনডেক্সড গবেষণা জার্নালে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দুটি গবেষণা আর্টিক্যাল
প্রকাশিত হতে হবে। সে দুটো প্রকাশিত আর্টিক্যাল থিসিসের সঙ্গে জমা দিতে হবে। থিসিস
ইন্টারন্যাল ও এক্সটারন্যাল পরীক্ষকের কাছে পাঠানো হবে। অতপর মূল্যায়ন শেষে
গবেষককে থিসিস ডিফেন্সের জন্য ডাকা হবে। ইন্টারন্যাল ও এক্সটারন্যাল থিসিস
ডিফেন্সে তিনি উপস্থিত থাকবেন। প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে এবং চূড়ান্ত থিসিস গ্রহণ
করে কনসোর্টিয়াম অফিস সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়কে সার্টিফিকেট ইস্যু করার জন্য
অনুরোধ করবে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও ইউজিসি এসব নিয়মের অনেকটাই প্রয়োগ
করতে পারে। এতে দেশে শিক্ষা ও গবেষণার মান বাড়বে, দেশ উপকৃত হবে। আবার অনেক টাকা
ব্যয়ে কেনা বা দলবাজির মাধ্যমে সংগৃহীত পিএইচডি প্রাপ্তির বিকৃত মানসিকতার
বহিঃপ্রকাশ বহুলাংশে কমে যাবে।