Loading..

খবর-দার

২২ নভেম্বর, ২০১৮ ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমি কেন শিক্ষক?

পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করা হয় অর্থ, ক্ষমতা এবং পদবির মানদণ্ডে। আপনি যত বেশি অর্থের মালিক কিংবা আপনি যত বড় পদবিধারী হবেন, সমাজে আপনার সম্মান এবং গ্রহণযোগ্যতা তত বেশি। সেই বিবেচনায় আমাদের দেশে শিক্ষকদের অবস্থান কতটা সম্মানজনক অবস্থায় আছে তা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে।

যে দেশে একজন শিক্ষক অধিকার আদায়ের জন্য কাফনের কাপড় পরে রাস্তায় অনশন করে। যে দেশে দারিদ্র্যের কষ্ট বইতে না পেরে একজন শিক্ষক গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মাহুতি দিতে চান। যে দেশে অধিকার আদায়ের মিছিলে পুলিশ ভাইয়েরা মরিচের গুঁড়া গুলিয়ে ছুড়ে মারে শিক্ষকের চোখে। সেই দেশে আপনি ‘কোয়ালিটি এডুকেশন’ কীভাবে আশা করেন? আগে রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষকের মূল্যায়নের জায়গাটি সুনিশ্চিত করতে হবে। তারপর ‘কোয়ালিটি এডুকেশন’-এর স্বপ্ন দেখতে হবে।

শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রের আর্থিক লেনদেন কিংবা স্বার্থ কিছুতেই থাকতে পারে না। এতে শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের শ্রদ্ধাবোধ কমে যায়।’ কথাটি মন্দ নয়। কিন্তু জীবনযাপনের ব্যয়ের সঙ্গে আর্থিক অসঙ্গতি থাকলে মানুষ অসৎ পথ বেঁচে নেয়। শিক্ষক একজন মানুষ। শুধু সম্মান দিয়ে তো আর জীবন চলে না। সীমিত বেতনে চলা সম্ভব নয় বলেই একজন শিক্ষক বাড়তি আয়ের পথ বেছে নেন। কোচিং-প্রাইভেট কিংবা অন্য কোনো ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। এটা সত্যি, এক্ষেত্রে শিক্ষকের শিক্ষক সুলভ ব্যক্তিত্ব ক্ষুণœ হয়। টাকার জন্য শিক্ষক, ছাত্র কিংবা অভিভাবকের কাছে নতজানু। এভাবে নতজানু হয়ে জ্ঞান বিতরণ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে না। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষকের সম্মান অনুযায়ী সম্মানী নির্ধারণ করা হলে কোচিং-প্রাইভেট সংকট ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক মধুর হবে।

একজন শিক্ষক পৃথিবীর তাবৎ পেশাজীবী গড়ার কারিগর। ক্রিকেটার, আমলা, ব্যাংকার, আইনজীবী, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তারসহ সব পেশার ব্যক্তিই শিক্ষকের ছাত্র। কথায় কথায় শিক্ষককে অনুসরণীয় ‘আদর্শের প্রতীক’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। আদর্শের প্রতীক রক্ষায় রাষ্ট্রীয়ভাবে কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে? স্বাভাবিকভাবেই, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কাঠামোয় একজন শিক্ষকের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা থাকলেও তা হয়নি। মুখে মুখে আদর্শের ধুয়া তুললেও বাস্তবে শিক্ষক হয়েছেন লাঞ্ছিত। এখানেও তবে শিকড় অবহেলিত। শিক্ষার শিকড়ে জল না ঢেলে কিংবা শিকড় আহত করে আমরা ভালো ফল পেতে পারি কি?

বিভিন্ন সভা-সেমিনারে কিংবা রাজনৈতিক মঞ্চে একটি সাধারণ প্রসঙ্গ আলোচনা হয়। তা হলো- ‘আমাদের শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীরা অনুপস্থিত। মেধাহীনরাই এখন শিক্ষকতায় আসে।’ যদি এতই বুঝে থাকি, তবে মেধাবীরা যাতে এই পেশায় আসে সেই ব্যবস্থা করলেই হয়। আচ্ছা, মেধাহীন শিক্ষকের ছাত্র কীভাবে মেধাবী হয়ে মেধানির্ভর দেশ গড়বে? শিক্ষা যদি জাতির সার্বিক উন্নয়নের চাবিকাঠি হয় তবে তালা খোলার আগে চাবির প্রতি যত্নবান হওয়া উচিত নয় কি? বহুল পঠিত মধুর বচন ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’। মেরুদণ্ড রক্ষায় আমরা কী করছি?

জাপানে সরকারের অনুমতি ছাড়া শিক্ষককে গ্রেফতার করা যায় না। আর আমাদের দেশে শিক্ষককে কানে ধরে ওঠবস করানো কিংবা মাথায় মল ঢেলে আমরা পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠি। হ্যাঁ, খারাপ শিক্ষক যে নেই তা বলছি না। অবশ্যই আছে। অপরাধকারী যেই হোন শাস্তি পাবেন। আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নন অথচ আমরা আইনের তোয়াক্কা করি না। ফ্রান্সের আদালতে কেবল শিক্ষকদের চেয়ারে বসার অনুমতি দেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষককে ভিআইপির মর্যাদা দেয়া হয়।

চীনে সব থেকে মর্যাদাপূর্ণ পদ শিক্ষকতা। কোরিয়ায় শিক্ষকরা মন্ত্রীদের সমান সুযোগ পান। এসবের বিবেচনায় আমাদের শিক্ষকরা কোথায় আছেন? প্রতিবছর আমাদের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা উন্নত বিশ্বে সরকারি খরচে ভিজিটে যান ওই দেশের শিক্ষা কাঠামো, শিক্ষকের রাষ্ট্রীয় অবস্থান সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করে সরকারকে রিপোর্ট দেয়ার জন্য। আমার মনে হয়, রিপোর্টে সব থাকে। কেবল শিক্ষকদের অবস্থান এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষককে মূল্যায়নের ফিরিস্তি রিপোর্টে থাকে না।

একদিন টিভি টক শোতে জনৈক আমলা খুব আফসোস করে বলেন, ‘কীভাবে শিক্ষকরা মানসম্মত পাঠদান করবে বলেন? খোঁজ নিয়ে দেখেন শিক্ষকের বাড়িতে বইয়ের সংগ্রহ নাই। পারিবারিক লাইব্রেরি নাই।’ শুনে ভালো লাগল। কিন্তু পরে আবারো শিক্ষকের আর্থিক দীনতার চিত্র ভেসে উঠল চোখের সামনে। একজন আমলা সারা বছর বিভিন্ন অজুহাতে যে পরিমাণ আর্থিক থোক বরাদ্দ কিংবা ভাতা পান। বই কেনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কিছুটা পেলেও প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকরা বছরে তার সিকি পরিমাণও পাচ্ছেন বলে মনে হয় না। প্রতিবেশী রাষ্ট্রে একজন প্রাথমিক শিক্ষকের মাসিক বেতন নাকি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের সমপরিমাণ। তাহলে এবার বিবেচনা করুন শিক্ষকের মান এবং দীন অবস্থা। যে দেশে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে একজন নিম্ন মাধ্যমিক/ মাধ্যমিক পাস গাড়ির চালকের বেতন এবং একজন বিএ, এমএ পাস শিক্ষকের বেতন সমান হয় তখন ‘কোয়ালিটি এডুকেশন’ আমরা কীভাবে প্রত্যাশা করব?

শিক্ষক দিয়ে আদমশুমারির কাজ করানো হয়। কার বাড়িতে কয়টা পাকা, কয়টা কাঁচা ল্যাট্রিন আছে তা গণনা করেন শিক্ষক। এমনকি ভোটগ্রহণের কাজেও শিক্ষক দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষক যেহেতু আদর্শের প্রতীক, সেহেতু তার কোনো ভুল থাকা চলবে না। শিক্ষক সাদা কাপড়ের মতো। তার গায়ে কোনো দাগ থাকা চলবে না। সাদা কাপড় দাগমুক্ত রাখতে বিশেষ যত্ন প্রয়োজন। সেই উদ্যোগ কেন আমরা নিচ্ছি না!

আমরা আলোকিত সমাজ চাই। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হোক দেশ, এই প্রত্যাশা সবার। কিন্তু শিক্ষার আলো বিস্তারে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি, তাদের জীবনমান উন্নয়নে এত অনীহা কেন? দূর হোক এই অনীহা। শিক্ষকের মনে হতাশা না থাকুক। শিক্ষা হোক আনন্দময়, স্বতঃস্ফূর্ত। পিতা-মাতার পরেই যিনি সন্তানকে সুশিক্ষায়

শিক্ষিত হওয়ার মন্ত্র শেখান। পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে তার যথাযথ মূল্যায়ন হোক। তবেই এদেশে মানসম্মত শিক্ষার প্রসার ঘটবে। –

 

লেখক: আমিনুল ইসলাম,শিক্ষক ও সাংবাদিক |