Loading..

খবর-দার

০৪ নভেম্বর, ২০১৯ ১১:১১ অপরাহ্ণ

পঠন দক্ষতা

বাংলা পঠনের ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের সাধারণত যে সব সমস্যা চিহ্নিত হয় সেগুলো হলো- কিছু ছাত্র বর্ণ চেনে না, কিছু ছাত্র বানান করতে পারে কিন্তু উচ্চারণ করতে পারে না, বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর মধ্যে বানান করে পড়ার প্রবণতা, অনেকে বানান করে কিন্তু উচ্চারণ হয় ভিন্ন, অনেক শিক্ষার্থীর পড়ার ক্ষেত্রে জড়তা দেখা যায়, অনেক শিক্ষার্থী একই শব্দ বারবার উচ্চারণ করে, অনেকের ‘কার’ চিহ্ন ব্যবহার করে শব্দ উচ্চারণে অসুবিধা হয়, অনেক শিশুর দীর্ঘ শব্দ বানান করে উচ্চারণ করতে অসুবিধা হয়, অনেকে শব্দের শেষের বর্ণ উচ্চারণ করে না, অনেক শিক্ষার্থী বর্ণ সঠিকভাবে চিনতে পারে না, কিন্তু মুখস্ত উচ্চারণ করতে পারে। আবার অনেকে কার চিহ্ন চিনতেই পারে না।

দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের সাধারণত যে সব পঠন সমস্যা হয় সেগুলো হলো- অনেকের ‘কার’ চিহ্ন দিয়ে উচ্চারণ সঠিক হয় না, কিছু শিক্ষার্থী শব্দের সঙ্গে নতুন বর্ণ বা শব্দ যোগ করে পড়ে, অনেকে বানান করে পড়ে, কারও কারও যুক্ত অক্ষর উচ্চারণ করে পড়তে সমস্যা হয়। আবার অনেকের বর্ণ সম্পর্কে অস্বচ্ছ ধারণা, পড়ার ক্ষেত্রে জড়তা থাকা, শব্দ ছেড়ে ছেড়ে পড়া, একই শব্দ বারবার পড়া- এ ধরনের সমস্যাও দেখা যায়। অনেকে আবার একেবারে পড়তেই পারে না। কিছু শিক্ষার্থী সঠিক উচ্চারণ করতে পারে না, কঠিন শব্দ বাদ দিয়ে পড়ে, অনেকে পড়া মুখস্থ করে কিন্তু শব্দ চেনে না। আবার অনেকের মধ্যে সম্পূর্ণ বাক্য মুখস্ত করার প্রবণতা দেখা যায়- স্বাভাবিক গতিতে পড়তে পারে না।নো সংখ্যা

শিশুর পঠন-দক্ষতা বৃদ্ধির কৌশল

শরীফুল্লাহ মুক্তি

  • ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ০১ নভেম্বর ২০১৮

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শেখার পত্তন’। রামনিধি গুপ্ত বলেছেন, ‘নানান দেশের নানান ভাষা, বিনে স্বদেশী ভাষা পুরে কি আশা’। তাছাড়া ‘Exposure’ এবং ‘Contextual Clarity’ ইংরেজি এই শব্দ দুটি পৃথিবীর বিখ্যাত শিক্ষা মনোবিজ্ঞানীদের দ্বারা পরীক্ষিত ও ব্যবহৃত। Exposure শব্দের অর্থ হলো প্রকাশ/প্রভাবিত করা/উদঘাটন/অভিজ্ঞতার অনুশীলনের সুযোগ। আর Contextual Clarity শব্দের মানে হলো কোনো বিষয়কে দেখে, শুনে এবং অনুভবের সমম্বয় শেখা। এই দুই বিষয়ের সমন্বয় হলেই কেবল প্রকৃত শিক্ষালাভ সম্ভব।

প্রাথমিক শিক্ষার অন্যতম বাহন মাতৃভাষা। কিন্তু আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহের বেশিরভাগ শিশুর বাংলায় পঠন দক্ষতা প্রত্যাশিত মানে পৌঁছুতে পারছে না। পেশাগত কারণে মাঝে মাঝে কর্মসহায়ক গবেষণা পরিচালনা করতে হয়। ‘বাংলা আমাদের মাতৃভাষা হওয়া সত্ত্বেও কেন আমাদের শিশুরা বাংলা সাবলীলভাবে পড়তে পারে না : সমস্যাসমূহ চিহ্নিতকরণ এবং উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক একটি কর্মসহায়ক গবেষণা পরিচালনা করি। প্রথম শ্রেণী থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত শিশুদের বাংলা বিষয়ে পাঠগত অবস্থান নির্ণয় করার জন্য শ্রেণী ভিত্তিক কিছু মূল্যায়ন-উপকরণ/টুলস তৈরি করে কয়েক মাসব্যাপী বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ কর্মসহায়ক গবেষণা সম্পাদন করি। মূল্যায়ন-উপকরণ তৈরির ক্ষেত্রে শ্রেণিভিত্তিক অর্জনোপযোগী যোগ্যতাগুলোকে প্রাধান্য দেয়া হয়। শিক্ষার্থীদের পাঠগত অবস্থান নির্ধারণের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সাবলীল পাঠক তৈরিতে আমাদের করণীয় বিষয়েও অভিজ্ঞ শিক্ষক ও বাংলা বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করা হয় এবং মতামত ও পরামর্শ/সুপারিশ নেয়া হয়।

দেখা গেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের একটা বড় অংশ ঠিকমতো বাংলা পড়তে ও লিখতে পারে না। নিজ মাতৃভাষায় দুর্বলতার কারণে ছাত্রছাত্রীদের অন্যান্য পাঠ্য বিষয়েও কাক্সিক্ষত যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না। বাংলা বিষয়ে ফলাফল ভালো না হলে বাংলায় লিখিত অন্যান্য বিষয়, যেমন- বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, প্রাথমিক বিজ্ঞান, ধর্ম ও মৌলিক শিক্ষা, প্রাথমিক গণিত ইত্যাদি বিষয়েও তাদের অবস্থান ভালো নেই।

কর্মসহায়ক গবেষণায় পাওয়া তথ্য ও উপাত্ত থেকে বাংলা পঠনের ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের সাধারণত যে সব সমস্যা চিহ্নিত হয় সেগুলো হলো- কিছু ছাত্র বর্ণ চেনে না, কিছু ছাত্র বানান করতে পারে কিন্তু উচ্চারণ করতে পারে না, বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর মধ্যে বানান করে পড়ার প্রবণতা, অনেকে বানান করে কিন্তু উচ্চারণ হয় ভিন্ন, অনেক শিক্ষার্থীর পড়ার ক্ষেত্রে জড়তা দেখা যায়, অনেক শিক্ষার্থী একই শব্দ বারবার উচ্চারণ করে, অনেকের ‘কার’ চিহ্ন ব্যবহার করে শব্দ উচ্চারণে অসুবিধা হয়, অনেক শিশুর দীর্ঘ শব্দ বানান করে উচ্চারণ করতে অসুবিধা হয়, অনেকে শব্দের শেষের বর্ণ উচ্চারণ করে না, অনেক শিক্ষার্থী বর্ণ সঠিকভাবে চিনতে পারে না, কিন্তু মুখস্ত উচ্চারণ করতে পারে। আবার অনেকে কার চিহ্ন চিনতেই পারে না।

দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের সাধারণত যে সব পঠন সমস্যা হয় সেগুলো হলো- অনেকের ‘কার’ চিহ্ন দিয়ে উচ্চারণ সঠিক হয় না, কিছু শিক্ষার্থী শব্দের সঙ্গে নতুন বর্ণ বা শব্দ যোগ করে পড়ে, অনেকে বানান করে পড়ে, কারও কারও যুক্ত অক্ষর উচ্চারণ করে পড়তে সমস্যা হয়। আবার অনেকের বর্ণ সম্পর্কে অস্বচ্ছ ধারণা, পড়ার ক্ষেত্রে জড়তা থাকা, শব্দ ছেড়ে ছেড়ে পড়া, একই শব্দ বারবার পড়া- এ ধরনের সমস্যাও দেখা যায়। অনেকে আবার একেবারে পড়তেই পারে না। কিছু শিক্ষার্থী সঠিক উচ্চারণ করতে পারে না, কঠিন শব্দ বাদ দিয়ে পড়ে, অনেকে পড়া মুখস্থ করে কিন্তু শব্দ চেনে না। আবার অনেকের মধ্যে সম্পূর্ণ বাক্য মুখস্ত করার প্রবণতা দেখা যায়- স্বাভাবিক গতিতে পড়তে পারে না।

তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের সাধারণত যে সব পঠন সমস্যা হয় সেগুলো হলো- অনেকে স্পষ্ট উচ্চারণে পড়তে পারে না, কিছু শিক্ষার্থী বানান করে শুদ্ধ উচ্চারণে পড়তে পারে না, অনেকে ‘কার’ চিহ্ন দিয়ে সঠিক উচ্চারণে পড়তে পারে না। আবার অনেকে স্বাভাবিক গতিতে পড়তে পারে না, অনেকে যুক্তবর্ণের সঙ্গে ‘কার’ চিহ্ন দিয়ে পড়তে পারে না। অনেকে অতিরিক্ত শব্দ যোগ দিয়ে পড়ে, আবার অনেকে কঠিন শব্দ বাদ দিয়ে পড়ে। অনেক শিক্ষার্থী বাক্য তৈরি করতে পারে না। অনেকে আবার কিছু কিছু বর্ণ চিনতে পারে না, একই শব্দ বারবার উচ্চারণ করে পড়ে, যুক্তাক্ষর সঠিক উচ্চারণ করতে পারে না। কেউ কেউ আবার সুর করে পড়ে। কারও কারও দাঁড়ি, কমা সঠিক রেখে পড়তে সমস্যা হয়।

এই যখন অবস্থা তখন আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে- কী করা যায়। কিভাবে বাংলা বিষয় আরও ভালোভাবে শিশুদের শেখানো যায়। এ বিষয়ে বিভিন্ন শ্রেণিতে যারা বাংলা বিষয় পড়ান এবং বাংলা বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণে যারা প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেছিলেন তাদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে তারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যারা বাংলা বিষয় পড়ান সে সব শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যক্ত করেন। পাশাপাশি বাবা-মা ও অভিভাবকদেরও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখার প্রতি জোর দেন।

শিশুকে প্রকৃত শিক্ষায় পরিপূর্ণ করে গড়ে তুলতে হলে পঠন-দক্ষতা অর্জন করানো আবশ্যক। পড়া শুধু বর্ণ বা শব্দ চিনে আউড়ে যাওয়া নয়- পাঠ্য বিষয়টির মর্মার্থ অনুধাবন করার অর্থ পঠন-দক্ষতা অর্জন করা। পঠন-দক্ষতা অর্জন করানোর জন্য প্রথম থেকেই নানা উপকরণের মাধ্যমে শিশুকে আবশ্যিক সহায়তা প্রদান করতে হবে। শুধু পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে পাঠদান করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিশুর পক্ষে পড়ার প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করা কষ্টকর হয়। সেই জন্য পঠন-দক্ষতা অর্জনে শিশুকে সহায়ক/সম্পূরক উপকরণের ব্যবহার ও তার প্রয়োগ কৌশল জানানো প্রয়োজন।

প্রাথমিক শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো সব শিশুকেই সাবলীল পাঠক হিসেবে গড়ে তোলা। এখন প্রশ্ন থাকতে পারে সাবলীল পঠন কী? আমরা সাবলীল পঠনকে আবার শ্রেণীভিত্তিক ভাগ করতে পারি। যেমন- প্রথম শ্রেণীতে সাবলীল পঠন বলতে আমরা বুঝব- শিক্ষার্থীর প্রথম শ্রেণীর আমার বাংলা বই ও প্রথম শ্রেণীর উপযোগী সম্পূরক পঠনসামগ্রী অর্থ বুঝে পড়তে পারা। আবার দ্বিতীয় শ্রেণীতে সাবলীল পঠন বলতে আমরা বুঝব- শিক্ষার্থীর দ্বিতীয় শ্রেণীর আমার বাংলা বই ও দ্বিতীয় শ্রেণীর উপযোগী সম্পূরক পঠনসামগ্রী অর্থ বুঝে, বানান ছাড়া, বিরাম চিহ্ন ব্যবহার করে পড়তে পারা। তৃতীয় শ্রেণীতে সাবলীল পঠন বলতে আমরা বুঝব- শিক্ষার্থীর তৃতীয় শ্রেণীর আমার বাংলা বই ও তৃতীয় শ্রেণীর উপযোগী সম্পূরক পঠনসামগ্রী বানান ছাড়া, বিরামচিহ্ন ব্যবহার করে স্বরভঙ্গি ও স্বরাঘাত বজায় রেখে বিষয়বস্তুর অর্থ ও মূলভাব বুঝে পড়তে পারা। সাবলীল পঠনের শর্তসমূহ হচ্ছে- শব্দ ও বাক্য সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারা, শুদ্ধ ও স্পষ্ট উচ্চারণ করতে পারা, স্বাভাবিক গতিতে পড়তে পারা, পঠিত বিষয়ের মর্ম বুঝতে পারা, বিরামচিহ্ন ব্যবহার করে, স্বরাঘাত ও স্বরভঙ্গি বজায় রেখে পড়তে পারা।

শিশুরা সবাই মৌখিক ভাষার ব্যবহার জানে। তাদের আয়ত্তে একটি সমৃদ্ধ মৌখিক শব্দ-ভান্ডার ও বাক্য-কাঠামো থাকে। এ সব শব্দ দিয়ে সে বয়স ও সামর্থ্য অনুযায়ী শব্দ ব্যবহার করে ছোট ছোট বাক্য গঠন করতে পারে। প্রথমে শিশুর এ দক্ষতা শুধু বলা ও শোনার মধ্যেই সীমিত থাকে। শিক্ষকরা ধীরে ধীরে মৌখিক ভাষার যে একটি লিখিত রূপ আছে তার সঙ্গে শিশুদের পরিচয় করান। লিখিত কোনো কিছু কারো কোনো রকম সাহায্য ছাড়া অর্থ বুঝে, বিরামচিহ্ন ঠিক রেখে সাবলীলভাবে পড়তে পারার ক্ষমতাকে পঠন-দক্ষতা বলা যেতে পারে। মানসম্মত পঠন দক্ষতা হলো প্রথম শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি বয়সী শিশুদের প্রতি মিনিটে ৪৫-৬০টি শব্দ পড়ে তার অর্থ বুঝতে পারা।