Loading..

ম্যাগাজিন

০২ এপ্রিল, ২০২০ ০১:৩৩ অপরাহ্ণ

সাইবার অপরাধ

আমি সবসময় খেয়াল রাখি আমার শিক্ষার্থীরা যেনও বিপদগামী না হয়।সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে আমি বিদ্যালয়ের ৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ১ টা দল গঠন করি।যাঁদের কাজ হবে স্কুল চলাকালীন যা চোখে পড়বে, সব তথ্য আমাকে দেওয়া এবং খুব গোপনে।এভাবেই আমি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন তথ্য এ গ্রপের মাধ্যমে পেতে থাকলাম।২০১৯ সালের নভেম্বর মাস।বার্ষিক পরীক্ষা চলে। এমম সময় নাইনের এক মেয়ে এসে আমাকে খবর দিল,তাঁর এক বান্ধবী পরীক্ষা হলে কিছু লিখছে না।আমাদের স্কুল দুই শিফটে,আমি দিবা শাখার শিক্ষক।নাইনের পরীক্ষা প্রভাতি শাখায় হচ্ছিল আর আমার পরীক্ষার ডিউটি দিবা শাখায়।আমি চিন্তা করলাম যে করেই হোক আমাকে সকালে গিয়ে পরীক্ষা চলাকালীন মেয়েটাকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে,আসলে কী ঘটছে! মেয়েটা ভালো ছাত্রী,তার আচরণের অতীত রেকর্ডও ভালো।কী হলো নতুন করে তবে! এ ভাবনায় সেদিন রাতে আমার ঘুম বার বার ভেঙে যেতে লাগল।আসলে স্কুলে চাকুরী করতে করতে কখন এসব শিক্ষার্থীরা আমার অংশ হয়ে গেছে আমি জানি না।সকালে নিজের ব্যক্তিগত কাজ কোনওরকম সেরে ছুটলাম স্কুলে,মেয়েটার পরীক্ষার রুমে।সত্যি অবাক হলাম,মেয়েটার চোখের নিচে কালি।বেশ কিছুক্ষণ কাওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে পরীক্ষার রুমে থাকলাম।দেখলাম খাতায় তেমন কিছু লিখছে না,কারও খাতা দেখে লেখার চেষ্টাও নেই।ওর অবস্হা দেখে আমার বুকের ভেতর কেমন যেনও মোচড় দিয়ে উঠল।আমি ওকে পরীক্ষা শেষ করে দেখা করতে বললাম। আমি ওকে নিয়ে জেনারেশন ব্রেক থ্রু প্রকল্পের রুমে গেলাম।আমার সাপোর্টিং কাউন্সিলিং-এর ৬ দিনের কোর্স করা ছিল।কারও সাথে নিরিবিলি বসতে চাইলে আমি এ রুমে মেয়েদের নিয়ে বসি।"কী হয়েছে আম্মু তোমার!" এ কথা জিজ্ঞেস করতেই হাউমাউ করে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলল, আমাকে বাঁচান মেডাম।আমি ওকে কাঁদতে দিলাম।একটু শান্ত হতেই বলল,আমি আত্মহত্যা করব মেডাম,আমি বাঁচব না।জানতে পারলাম,একটা প্রতিবন্ধী ছেলের সাথে ওর এফেয়ার ছিল ৬ষ্ট শ্রেণিতে পড়ার সময়।তখন ওরা কুমিল্লা ছিল।একসাথে অনেক ঘুরত,ছবিও ছিল ওদের একসাথে অনেক।সেই ছেলোটার সাথে ৬ মাস হলো ওর আর সম্পর্ক নেই।তাই সেই ছেলেটা প্রতিশোধ নিতে ওদের দুজনের ছবি বিকৃত করে ফেসবুকে ছেড়েছে।এমন ছবি ছেড়েছে,চোখ ফিরিয়ে নিতে হয় লজ্জায়, অপমানে।ও চিৎকার করে সবাইকে বলছে, আমি ছবি তুলেছি, কিন্তু এভাবে আমি ছবি তুলিনি।আমার কথা কেও বিশ্বাস করছে না,আমি কোথাও মুখ দেখাতে পারি না,আমি আত্মহত্যা করব ম্যাডাম।আমি চমকে উঠলাম,ওর মানসিক ভেঙে পড়া আর মানসিক বিপর্যয় আমি বুঝতে পারছিলাম। আমি ওকে বললাম আমি তোমাকে বিশ্বাস করি।আমি সবার সাথে কথা বলছি।সব ঠিক হয়ে যাবে।তোমার সামনে সুন্দর স্বপ্ন আর ভবিষ্যত অপেক্ষা করে আছে।মেয়েটা আমার হাত শক্ত করে ধরে রইল, ছাড়তেই চাইল না।আমি ওকে বললাম বাসায় যাও,আমিতো আছি।ওর সাথে আমার মেসেন্ঞ্জারে এড ছিল না,এড হলাম।প্রথমে ভাবলাম কী করব! আমার যা যা করতে হবে ১। অভিভাবকের সাথে কথা বলা ২। স্কুলের স্টুডেন্টদের সাথে কথা বলা ৩। বাইরে ৩ টা স্কুলের শিক্ষার্থীরা বিষয়টাকে বাড়াবাড়ি পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে সেটা থামানো ৪।ছেলেটার সাথে কথা বলা যাতে সে এ পোস্টটা ডিলেট করে ও ক্ষমা চায় ৫। পুলিশকে জানানো।৬। আমার দেবর সাংবাদিক প্রয়োজন হলে ওকেও জানাতে হবে।৭। মেসেন্জ্ঞারে নিয়মিত ওর সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে।আমি ওর অভিভাবকের সাথে কথা বলি।তাঁরাতো মেয়েকে পারলে বাসা থেকে বের করে দেয়,আর অকথ্য বাসায় মুখে যা আসে তাই মেয়ে সম্পর্কে বলে।আমি ওর মাকে বলি,আপনি কী আপনার সন্তানের মৃত্যু চান! মা রেগে বলে,এমন মেয়ে মরে যাওয়াই ভালো।আমি ওর মাকে বুঝালাম,মেয়েটা এখন এমনিতেই মৃত্যুর দরজায় এক পা দিয়ে আছে,আমাদের যে কোনও ভুল আচরণ ওকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিবে।মা হিসেবে আপনার সন্তানকে জীবনের পথে ফিরিয়ে আপনাকেই আনতে হবে।আপনি আপনার সন্তানকে আজকেই গিয়ে বুকে জড়িয়ে নিবেন,ওকে মানসিক সাপোর্ট দিবেন।আরও কী কী করতে হবে বুঝিয়ে দিলাম।এবার ৯ম শ্রেণির যারা ওর কাছের তাদের ডাকলাম।ওই ফেসবুক আইডিতে রিপোর্ট করতে বললাম।আমি দেখলাম খারাপ একটা ডুয়েট ছবি দিয়ে মেয়েটার নামেও একটা ফেক আইডি খুলেছে ছেলেটা।আর স্কুলে যারা ওকে দেখতে পারত না,তাদের ডাকলাম।কারন বিষয়টাকে জটিল করে মিথ্যে কথা বানিয়ে ওরা জটিল করে তুলছে আরও।ওদের বুঝালাম,দেখলাম খুব কাজ দিল বুদ্ধিটা।ওরা আরও বেশি ভূমিকা রাখল, তাদের চেয়ে যারা মেয়েটার বন্ধু ছিল।মেয়েটার সাথেও কথা বললাম,ওর একই কথা! আমি লজ্জায় কোথাও মুখ দেখাতে পারি না,আমি বাঁচব না আপা।আমি ওকে যতটুকু পারলাম বুঝালাম।আসলে ছেলেটা ওকে ব্লাকমেইল করছিল।ছেলেটা বলছিল যদি মেয়েটা ওর সাথে রিলেশন কনটিনিউ করে তবে ছবিগুলো ডিলেট করবে।ছেলেটা কিছুতেই মানছিল না।মুসলিম, ইসলামিয়া,কলিজিয়েট স্কুলে আমার পরিচিত স্যার ম্যাডামদের বললাম, তাদের স্টুডেন্টদের নিয়ন্ত্রনে আনতে।বিষয়টি আমি স্কুল প্রশাসনকে জানালাম না কারন গোপনীয়তা খুব প্রয়োজন ছিল।আমি বার বার মেয়েটার প্রতি সমানুভূতি দেখাতে লাগলাম,ওর মানসিক সাপোর্টের আশ্রয়স্হল হতে বার বার চেষ্টা করতে থাকলাম ও সমাধানের বিকল্প চিন্তাগুলো ওকেই বের করতে বললাম।ছেলেটা কিছুতেই ওকে রেহাই দিচ্ছিল না।পরে ছেলেটার সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলাম ও সাথে আমার খালাত ভাইকেও জানালাম( খালাত ভাই পুলিশে কর্মরত)

আমার একেকটা মূহুর্ত কীভাবে যে কাটছিল বুঝাতে পারব না।মনে হচ্ছিল বার বার আমি বুঝি কিছু করতে পারলাম না।আমি বুঝি একটা মেয়েকে বাঁচাতে পারলাম না।আমি সব কাজের মাঝেও মেয়েটাকে মানসিক সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি সব কাজ করছিলাম কিন্তু খুব গোপনে।কারন এর সাথে মেয়েটার সম্মান জড়িত।ফেসবুকে ছবি কয়জন দেখবে! যাদের সাথে এড শুধু তারাই! বা তাদের থেকে কয়েকজন! আমি বিষয়টার তাই ১০০% গোপনীয়তা রক্ষা করি।আর অন্য টিচাররাও তেমন কিছু ভাবল না কারন তাঁরা জানেন আমি মেয়েদের সাথে অনেক কাজ করি।এটাও তেমন এক কাজ হয়ত! সবশেষে ছেলেটার সাথে কথা বললাম।ওকে অনেক অনেক বুঝালাম কিন্তু নরম হলো না।অবশেষে পুলিশকে(খালাত ভাই) জানালাম,এবার কাজ হলো।অবশেষে সেই ফেক একাউন্ট নিষ্ক্রিয় হলো।আমি মেয়েটাকে আত্মহত্যার হাত থেকে সাময়িক হলেও বাঁচাতে পারলাম।তারপরও আজও মেয়েটাকে আমার মানসিক সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছি। শিক্ষক হিসেবে আমার অনেক দায়িত্ব। আমি পেরেছি একজনকে হলেও রক্ষা করতে।এই অনুপ্রেরণা ও আত্মতৃপ্তি আমার সারাজীবনের গল্প জুড়ে থাকবে।এ কথাগুলো লিখার মূল উদ্দেশ্য...আন্তরিকভাবে চাইলেই আমরা শিক্ষকরা অনেক কিছু করতে পারি।আমরা শিক্ষার্থীদের মনে স্বপ্নের চারাগাছ রোপণ করে দিতে পারি,সেই চারাগাছের সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে যত্ন করতে পারি,আবেগকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে চারাগাছের মাটি প্রয়োজন অনুযায়ী নরম ও শক্ত করতে পারি, চারাগাছে প্রয়োজমত  পানি দিয়ে যোগ্য মানবসম্পদ গড়ে তুলতে পারি।সব আমাদের হাতে নেই,কিন্তু যতটুকু আছে আন্তরিকতার সাথে ভালোবেসে কাজে লাগাই।দেখবেন আমাদের চারপাশটা হেসে উঠবে,হেসে উঠবে ৩০ লাখ শহীদের স্বপ্ন এই সোনার বাংলাদেশ।( ইচ্ছে করেই মেয়েটার সম্মানের স্বার্থে ওর নাম গোপন রাখলাম)


আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি