Loading..

খবর-দার

০৭ এপ্রিল, ২০২০ ০৬:২৩ অপরাহ্ণ

করোনা : বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি ধার্মিকের নজিরবিহীন আপোষ।

করোনা : বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি ধার্মিকের নজিরবিহীন আপোষ।

করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি ধর্মবিশ্বাসী মানুষ তাদের সারাজীবনের ধর্মীয় আচার পালনের রীতি বদল করেছেন বা করতে বাধ্য হচ্ছেন। মঙ্গলবার (৭ এপ্রিল) বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শাকিল আনোয়ার।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, বেশ কিছু ক্ষেত্রে ধর্মীয় জমায়েত ভাইরাস ছড়ানোতে বড় ভূমিকা রেখেছে এমন প্রমাণ পাওয়া পর ধর্মীয় আচার পালনের চিরাচরিত প্রথার ওপর কঠোর সব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।

চাপের মুখে ধর্মীয় আচার, ধর্মীয় নানা গোষ্ঠী
দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনা ভাইরাস ছড়ানোর জন্য প্রধানত দায়ী করা হচ্ছে শিনজচওঞ্জি চার্চ অব জেসাস নামে ছোট একটি ক্ষুদ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীকে। বলা হচ্ছে, সমাবেশের ওপর বিধিনিষেধ অবজ্ঞা করে গোপনে তাদের কয়েক হাজার সদস্য একটি সৎকার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন, যেখান থেকে ঐ সংক্রমণের শুরু।

দক্ষিণ কোরিয়ায় সংক্রমণের যত কেস পাওয়া গেছে, তার ৭৩ শতাংশের সাথেই এই গোষ্ঠীর সদস্যদের যোগাযোগ পাওয়া গেছে। শিনচিওঞ্জির শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। চাপের মুখে তাদের শীর্ষ নেতা লি মান হি টিভিতে হাঁটু গেড়ে হাতজোড় করে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।

ভারতে এখন করোনা ভাইরাস সংক্রমনের জন্য তাবলিগ জামাত নামে একটি মুসলিম গোষ্ঠী তোপের মুখে পড়েছে। গত মাসে দিল্লিতে তাদের এক সমাবেশে যোগ দেয়া লোকজনের প্রায় এক হাজার জনের শরীরে করেনা ভাইরাস পাওয়া যাওয়ার পর সোমবার পর্যন্ত তারা এবং তাদের সাথে সংস্পর্শে এসেছে এমন ২২ হাজারেরও বেশি লোককে কোয়ারেন্টিনে নেয়া হয়েছে। ঐ সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন এমন লোকজনকে শনাক্ত করতে ভারত জুড়ে পুলিশী অভিযান চলছে।

তাবলিগ জামাতের শীর্ষ নেতা সাদ কান্দালভির বিরুদ্ধে মহামারি রোগ আইন ১৮৯৭ এর কয়েকটি ধারায় মামলা হয়েছে। মি কান্দালভি গা ঢাকা দিয়েছেন।

ভারতে অবশ্য অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা সচেতনভাবে উঠেপড়ে লেগেছেন এটা প্রমাণ করতে যে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের জন্য প্রাধানত মুসলিমরাই দায়ী। তবে তাবলিগ জামাতের সমাবেশের সাথে সংক্রমণের যোগসূত্র রয়েছে, এবং এই সংগঠনটি তাদের প্রায় একশ বছরের ইতিহাসে এমন চাপে আর কখনই পড়েনি।

গত সপ্তাহে ইসরায়েলে বিনেই ব্রাক নামে গোঁড়া ইহুদিদের একটি শহরকে দেশের অন্যান্য অংশের সাথে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। বলা হচ্ছে, প্রায় দুই লাখ মানুষের এই শহরের ৪০ শতাংশ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, কারণ এখানকার গোঁড়া ইহুদিরা সামাজিক বিচ্ছিন্নতার নির্দেশ ঠিকঠাক না মেনে বিভিন্ন সমাবেশে হাজির হয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং এমনকি ইটালিতে অনেক খ্রিষ্টান গির্জার বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ উঠছে।

ভারতে গত সপ্তাহেই পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তরপ্রদেশে হাজার হাজার হিন্দু সরকারের নির্দেশ অমান্য করে রাম-নবমি নামে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে মন্দিরে মন্দিরে ভিড় করেন।

নজিরবিহীন আপোষ
তবে বিচ্ছিন্ন এসব ঘটনার বাইরে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচতে বিশ্ব জুড়ে ধর্ম বিশ্বাসীদের আচার পালন করতে যে মাত্রার আপোষ এখন করতে হচ্ছে তা নজিরবিহীন।

যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশনস বলছে,“কোটি কোটি মানুষের ধর্মীয় রীতি-আচার পালনের ধরন ব্যাপকভাবে বদলে গেছে।"

মুসলিম দেশগুলোতে এখন হাজার হাজার মসজিদে নামাজ হচ্ছে না। গির্জায় প্রার্থনা বন্ধ, মন্দিরে পূজা-পার্বনে সমাগম বন্ধ। সৌদি আরব উমরাহ আপাতত নিষিদ্ধ করেছে, এবং এমনকী মার্চের ২০ তারিখ থেকে মক্কা ও মদিনার মসজিদ সাধারণের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশে আজানের বাণী পরিবর্তন করে মানুষকে ঘরে নামাজ পড়তে বলা হচ্ছে।

তুরস্ক বা পাকিস্তানের মতো দেশেও মসজিদে গিয়ে জামাতে নামাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এবছর হজ হবে কিনা তা নিয়ে সন্দোহ প্রবল। তবে হজ স্থগিত করার ঘটনা নতুন কিছু নয়। হজ প্রথা চালুর পর এখন পর্যন্ত প্লেগ বা কলেরার মতো মহামারি বা অন্যান্য কারণে ৪০ বারের মতো হজ স্থগিত হয়েছে।

ইটালির মত কড়া ক্যাথলিক দেশেও শত শত গির্জায় এখন তালা। পোপ এখন প্রতিদিন অনলাইনে বাণী দিচ্ছেন।

কতদিন সহ্য করবেন ধর্মবিশ্বাসীরা?
কিন্তু আর কতদিন আচার পালনের ওপর এসব বিধিনিষেধ নীরবে মেনে নিবেন ধর্মবিশ্বাসীরা - তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।

এপ্রিল মাস তিনটি ধর্মের -ইসলাম, খ্রিষ্টান এবং ইহুদি- কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। এ সপ্তাহেই ইহুদিদের পাসওভার উৎসব। এপ্রিলের ১০ তারিখ থেকে ইস্টার যেটি খ্রিষ্টানদের কাছে খুবই পবিত্র একটি উৎসব, এবং তারপর এপ্রিলের ২৩ তারিখ থেকে রোজা শুরু হচ্ছে। এই সময়ে কি সব ধার্মিক মানুষ মেলামেশার ওপর বিধিনিষেধ মানবেন?

বিদ্রোহের ইঙ্গিত যে একেবারে নেই তা বলা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রে ইস্টারের আগে ফ্লোরিডা এবং টেক্সাসসহ বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে গির্জা বন্ধ রাখার বিরুদ্ধে খোলাখুলি বিদ্রোহ করতে শুরু করেছেন কিছু যাজক, এবং স্থানীয় রাজনীতিকরাও তাদের সমর্থনে কথা বলতে শুরু করেছেন।

যেমন ফ্লোরিডা এবং টেক্সাসের গভর্নররা এখন গির্জায় গিয়ে প্রার্থনাকে 'অত্যাবশ্যকীয়' একটি কাজ বলে ডিক্রি জারি করেছেন যাতে গির্জায় যাওয়ার জন্য কাউকে গ্রেফতার করে মামলা দেয়া না যায়।

রমজানে সবাই কি তারাবির নামাজ ঘরে বসে পড়তে রাজি হবেন?

জোর দিয়ে বলা মুশকিল। কারণ পাকিস্তানের করাচিতে গত শুক্রবারও নিষেধাজ্ঞা ভেঙ্গে শতশত মানুষ জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে নিয়ে হাজির হয়। পুলিশ বাধা দিতে গেলে পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে। বাংলাদেশেও এখনও সরকারের পরামর্শ উপেক্ষা করে বহু মানুষ প্রতিদিনিই মসজিদে যাচ্ছেন, বিশেষ করে গ্রামে-গঞ্জে।

সন্দেহ নেই করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে ধর্মীয় আচার পালনে বিশ্বাসীদের যে ধরনের আপোষ এখন করতে হচ্ছে, ইতিহাসেই তার নজির বিরল।