Loading..

খবর-দার

১০ এপ্রিল, ২০২০ ১২:০৫ অপরাহ্ণ

সিলেট বিভাগের একমাত্র করোনা হাসপাতাল শহীদ ড. শামসুদ্দীন আহমদ হাসপাতাল

করোনা ভাইরাস আক্রমণের পর থেকেই সিলেটের শহীদ ডা. শামসুদ্দীন আহমদ সদর হাসপাতালের নাম সবাই বলছে। সিলেট বিভাগের একমাত্র করোনা হাসপাতাল এটি। যার নামে এই হাসপাতাল, সেই শহীদ ডা. শামসুদ্দীনের শাহাদাত বার্ষিকী ছিল গতকাল। ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল এই মহান মানুষটি হানাদার পাকিস্তানীদের গুলিতে শহীদ হোন। তাঁর জীবনী জানাটা প্রতিটা সিলেটবাসীর নৈতিক দায়িত্ব। 

শামসুদ্দীন আহমদের জন্ম ১৯২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর। তাদের স্থায়ী ঠিকানা ৬৯ হাউজিং এস্টেট, আম্বরখানা, সিলেট। তাঁর বাবার নাম ইমাম উদ্দিন আহমদ, মা রাশেদা বেগম। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। শামসুদ্দীন আহমদ ১৯৩৯ সালে সিলেট সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে বৃত্তি ও লেটার পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক, ১৯৪১ সালে সিলেট মুরারীচাঁদ (এমসি) কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করে ভর্তি হন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে এবং ১৯৪৬ সালে সেখান থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ১৯৬২ সালে ইংল্যান্ডের রয়্যাল কলেজ অব ফিজিশিয়ান অ্যান্ড সার্জন থেকে তিনি এফআরসিএস করেন। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মাধ্যমে। উনসত্তরের গণ-আন্দোলন চলাকালে তিনি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে কর্মরত ছিলেন। তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা হত্যার মিথ্যা সার্টিফিকেট দিতে তিনি রাজি হননি যদিও তাঁর উপর প্রচন্ড চাপ দিচ্ছিলো পাকিস্তানী শাসকরা। 

১৯৭১ সালে সিলেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারী বিভাগের প্রধান ছিলেন ডা. শামসুদ্দীন আহমদ। তিনি ছিলেন প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী, পেশায় অসম্ভব সৎ ও আন্তরিক, কর্তব্যে ছিলেন কঠোর ও একনিষ্ঠ। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নিরাপত্তা নেই বলে মেডিক্যাল কলেজের অনেক অধ্যাপক ও ছাত্র হোস্টেল এবং হাসপাতাল ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকেন। এ সময় বয়োকনিষ্ঠ চিকিৎসক, নার্স ও প্যারামেডিক্যাল কর্মীদের তিনি অনুরোধ করেন আহত ব্যক্তিদের সেবা করতে। যারা চলে যান, তাদের প্রায় সবার হাতে ওষুধ ও চিকিৎসার সরঞ্জাম তুলে দিয়ে তিনি বলেছিলেন ‘বাইরে গিয়ে মানবতার সেবা করো’। চারপাশে হত্যা ও ধ্বংস দেখেও শুধু পেশার প্রতি অঙ্গীকার ও মানবতার কারণে কর্মস্থল ছেড়ে যাননি ডা. শামসুদ্দীন আহমদ। তাঁকে অনেকেই বলেছিলেন হাসপাতাল থেকে চলে যেতে। কিন্তু তাঁর এক কথা- ‘চলে গেলে রোগীকে কে দেখবে’? 

৮ এপ্রিল ইতালীয় সাংবাদিক ও সাহায্যকর্মীর সমন্বয়ে গঠিত একটি দল ভারত থেকে তামাবিল দিয়ে সিলেট শহরে আসে। ডা. শামসুদ্দীন আহমদ তাদেরকে গোটা হাসপাতাল ঘুরিয়ে নিরীহ নাগরিকের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নগ্ন হামলার প্রত্যক্ষ প্রমাণ তুলে ধরেন। এই ঘৃণ্য আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি বক্তব্যও দেন। তাঁর বক্তব্য দলটি রেকর্ড করে যা পরে ইতালিতে প্রচারিত হয়। পরদিন ৯ এপ্রিল মেডিক্যাল কলেজের পাশে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধ হয়। হাসপাতালের অদূরবর্তী টিলা থেকে প্রতিরোধ যোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি কনভয়ে আক্রমণ করে। এতে কনভয়ের সামনের জিপ উল্টে যায় এবং তিনজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এর পরপরই পাকিস্তান সেনাবাহিনী হাসপাতাল এলাকা ঘিরে ফেলে। কিছুক্ষণ পর মেজর রিয়াজের নেতৃত্বে একদল পাকিস্তানী সেনা হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশ করে। আন্তর্জাতিক আইনে চিকিৎসক ও নার্স হত্যা অমার্জনীয় অপরাধ। কিন্তু এই আইন গ্রাহ্য করেনি বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী। হাসপাতালে কোনো প্রতিরোধ যোদ্ধার সন্ধান না পেয়ে তারা যাকেই সামনে পায়, তাকেই বাইরে এনে দাঁড় করাতে থাকে। ডা. শামসুদ্দীন আহমদ ও তাঁর সহকারী ডা. শ্যামল কান্তি লালাকেও তারা টেনেহিঁচড়ে সীমানাপ্রাচীরের কাছে দাঁড় করায়। এ সময় ডা. শামসুদ্দীন আহমদ নিজের পরিচয় দেন কিন্তু পাকিস্তানী সেনারা প্রথমেই তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করে। তিনটি গুলি লাগে তাঁর শরীরে। একটি বাঁ ঊরুতে, দ্বিতীয়টি পেটে ও তৃতীয়টি বুকে। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। কারফিউ থাকায় তাঁর মরদেহ ৪ দিন সেখানেই পড়ে থাকে অযত্নে, অবহেলায়। ১৩ এপ্রিল কিছুক্ষণের জন্য কারফিউ শিথিল হলে কয়েকজন নিকটাত্মীয় এসে তাঁর ক্ষতবিক্ষত মরদেহ হাসপাতাল প্রাঙ্গণে ছোট গর্ত করে দ্রুততার সঙ্গে সমাহিত করেন। কড়া পাহারার কারণে তাঁর জানাজা পড়াও ছিলো মুশকিল। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৫১ বছর। তাঁর দুই ছেলে এবং তিন মেয়ের সকলেই এখন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। 

করোনা ভাইরাসের বিপদেও যে সকল ডাক্তার, পুলিশ সদস্য, সেনাসদস্য, সৎ সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী, যোগ্য জনপ্রতিনিধি, ব্যাংকার, উন্নয়নকর্মী, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, নিরাপত্তারক্ষী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ যে সকল মানুষ আজ অন্যকে ভালো রাখতে গিয়ে নিজের জীবনের নিরাপত্তাকে তু্চ্ছ করছেন- তারাই আজকের দিনের মুক্তিযোদ্ধা। শহীদ ডা. শামসুদ্দীন আহমদের মতো নিজের স্বার্থকে মাটিচাপা দিয়ে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যার ব্যস্ত, মানবসেবায় যারা ব্রত- তাদের আত্মত্যাগকে অন্তর থেকে স্যালুট। এরা আছেন বলেই আমরা সাহস পাই তাই তাঁদের প্রাপ্য সম্মান দিতে আমরা যেনো কার্পন্য না করি...

তথ্যসূত্র: ‘ডা. শামসুদ্দীন আহমদ’- দৈনিক প্রথম আলো, গ্রন্থনা- জনাব রাশেদুর রহমান, প্রকাশ মার্চ, ২০১৫ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ’, বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ, প্রকাশ ২০০৯। প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (ষষ্ঠ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৭)..