Loading..

ম্যাগাজিন

৩০ এপ্রিল, ২০২০ ১০:০৫ পূর্বাহ্ণ

মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে মানুষ, দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে
  • করোনার দুঃসহকালে অন্যরকম পাওয়া

মোরসালিন মিজান ॥ যারা কথা বলার, বরাবরের মতোই সরব তারা। শুধু কি কথা? আলোচনায়, ততধিক সমালোচনায় মুখর। সরকার, প্রশাসন, প্রতিবেশী, এমনকি সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে যে দেশ, সেই আমেরিকার প্রেসিডেন্টের মুন্ডুপাত করা হচ্ছে ঢাকায় বসে! করোনাভাইরাস মোকাবেলায় কী করা উচিত, কী করা উচিত নয়Ñ মুহূর্তেই বাতলে দিচ্ছেন তারা। এভাবে কথার মানুষেরা সামনে থাকার জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

তাই বলে কাজের মানুষ নেই, না, এমনটি নয়। বরং এবার এই করোনা সঙ্কটের কালে কাজের মানুষ, সাহসী এবং মানবিক মানুষ এত দেখা যাচ্ছে যে, মন বড় আশাবাদী হয়ে উঠছে। অনেক তরুণ এখন নিজের ঘরে নেই। যেটুকু সম্ভব, নিজেকে সুরক্ষিত রেখে অন্য মানুষের বাড়ি ছুটে যাচ্ছেন। ত্রাণ বিতরণ করছেন। নিজের শেষ সম্বলটুকু নিয়ে কর্মহীন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ছেন কেউ কেউ। পাশে থাকার চেষ্টা করছেন। সংবেদনশীল সাহসী মানুষেরা করোনা বা করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত ব্যক্তির স্বজন হয়ে উঠছেন। অপরিচিত ব্যক্তির মরদেহ নামাচ্ছেন কবরে। এমনকি মুসলমান হয়ে হিন্দুর কিংবা হিন্দু হয়ে মুসলমানের সৎকারে অংশ নিতে তাদের বাধছে না। এভাবে জাত-পাতের উর্ধে ওঠে মানুষের জয়গান করছে মানুষ। করোনার দুঃসহকালে এ যেন অন্য রকম পাওয়া। শ্রেষ্ঠ অর্জন।

বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমানে মহাসঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। গোটা বিশে^ ছড়িয়ে পড়েছে কোভিড-১৯। ওষুধ নেই। ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি। সংক্রমণ ঠেকাতে সবচেয়ে সক্ষম দেশগুলোও লকডাউনে যেতে বাধ্য হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ঘরবন্দী মানুষ। তবুও রেহাই মিলছে না। প্রতিদিন মরছে মানুষ। সংক্রমণ বাড়ছে। বড় হুমকির মুখে বাংলাদেশও। এখানেও প্রতিদিন শ’য়ে শ’য়ে করোনা পজিটিভ শনাক্ত হচ্ছে। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। সব দেখে যথেষ্ট আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ। স্বার্থপরতার, নিষ্ঠুর আচরণের অনেক খবর পাওয়া যাচ্ছে।

তবে প্রকৃত পথটি দেখিয়ে চলেছেন ভয়কে জয় করা সাহসী মানবিক মানুষেরা। সবাইকে নিয়ে বাঁচার স্বপ্নকে সত্য করে তুলছেন তারা। হয়ে উঠছেন অনুপ্রেরণার অনন্ত উৎস।

মাকছুদুল আলম খন্দকারের কথাই ধরা যাক। নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার কাউন্সিলর তিনি। করোনায় বা করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত ব্যক্তির দাফনে যখন আত্মীয় পরিজনরাও যেতে চান না, তখন ঠিক উপস্থিত হয়ে যান মাকছুদুল আলম খন্দকার। মৃত ব্যক্তির জানাজা ও কবরের ব্যবস্থা করেন তিনি। অন্য ধর্মাবলম্বীদের সৎকারের কাজও নিজে উপস্থিত থেকে করছেন। জানা যাচ্ছে, যখন মরদেহ যেখানে সেখানে ফেলে পালিয়ে যায় স্বজনেরাও, তখন মাকছুদুল হয়ে উঠেন পরমাত্মীয়। এই কাউন্সিলর সমমনাদের নিয়ে একটি টিম গঠন করেছেন। টিমের সবাই স্বেচ্ছাসেবী। করোনা আক্রান্ত বা সন্দেহে কেউ মারা গেলে তাদের জানাজা দাফনের ব্যবস্থা করছেন তারা। টিমের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত ২২টি লাশ দাফন ও সৎকার করা হয়েছে। মৃতদের কয়েকজন ছিলেন সনাতন ধর্মাবলম্বী। তাদের সৎকার করার লোক পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় মুসলমান ছেলেরাই এ দায়িত্ব পালন করেছেন।

জানা যায়, গায়েত্রী দেবী বৈশাখী নামের এক হিন্দু নারীর করোনায় মৃত্যু হলে পরিবারের আপনজনরা এগিয়ে আসেননি। এগিয়ে যান মাকছুদুল ও তার দলের ভলেন্টিয়াররা। পুরোহিত ডেকে হিন্দু রীতিতে দাহ করেন। সর্বশেষ এক হিন্দু ব্যবসায়ী করেনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যবরণ করলে মাকছুদুল নিজ হাতে তার মুখাগ্নি করেন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকাও প্রশংসা করার মতো। দেশের নানা প্রান্ত থেকে পুলিশ কর্মকর্তাদের ইতিবাচক কর্মকা-ের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এগিয়ে আসছে র‌্যাব। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। ঘটনার বর্ণনায় জানা যাচ্ছে, মধ্যরাতে প্রসব বেদনায় ছটফট করতে থাকা এক অসহায় নারীকে নিজে কোলে করে প্রথমে গাড়িতে, পরে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন শ্রীমঙ্গলের এক র‌্যাব কর্মকর্তা। নাম আনোয়ার হোসেন শামীম। র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটলিয়ান-৯ এর কোম্পানি কমান্ডার তিনি। প্রসূতি নারীর পরিবারের এক সদস্য ঘটনাটি ফেসবুকে উল্লেখ করে লিখেছেন, রাত তখন আনুমানিক সাড়ে এগারোটা। আমার পিসির প্রসব বেদনা ওঠে। রক্ত ভাঙা শুরু হয়। কিন্তু হাসপাতালে নেয়ার জন্য এত রাতে গাড়ি কোথায় পাব? আমরা সবাই খুব টেনশন করছিলাম। অনেক চেষ্টা করেও গাড়ি পাইনি। পরিচিত অনেক সিএনজি ড্রাইভারকে অনুরোধ করে লাভ হয়নি। তারা এত রাতে যেতে পারবে না। এ অবস্থায় একজনের পরামর্শে আমরা শ্রীমঙ্গল র‌্যাবের কমান্ডার আনোয়ার হোসেন শামীমকে ফোন করে সাহায্য চাই। তিনি বলেন ২ মিনিটের মধ্যে রওনা হচ্ছি। বিশ্বাস করিনি তখন। পরে দেখি সময়মতো উপস্থিত তিনি। পিসির হাঁটার অবস্থা ছিল না। উনি (শামীম) মুখে কিছু না বলে পিসিকে কোলে করে নিয়ে গাড়িতে তুলেন। হাসপাতালে পৌঁছার পর রোগীকে কোলে নিয়ে আবার একবারে অপারেশন রুমে দিয়া আসেন। বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি লিখেন, এই রকম মানুষও কি পৃথিবীতে আছে! এভাবে ‘মানুষ’ পরিচয়টি প্রধান হয়ে উঠছে।

বরিশালের উজিরপুরে রাতভর রাস্তার পাশে পড়ে ছিল মানসিক ভারসাম্যহীন এক ব্যক্তির মরদেহ। করোনা আতঙ্কে কেউ মরদেহটির কাছে যায়নি। পরে সেটি উদ্ধার করে দাফনের ব্যবস্থা করেন ওসি জিয়াউল আহসান ও পৌর কাউন্সিলর বাবুল সিকদার। সুশান্ত হালদার নামের এক ব্যক্তি তার বাড়ির পাশে নিজের জমিতে লাশ দাফনের অনুমতি দিয়ে দৃষ্টান্তস্থাপন করেন।

আর শেরপুরের সেই ভিক্ষুকের কথা তো এখন সবারই জানা। ঝিনাইগাতীর ৮০ বছর বয়সী ভিক্ষুক নজিমুদ্দিন ভিক্ষা করে ১০ হাজার টাকা জমিয়েছিলেন। সে টাকা করোনায় সঙ্কটে পরা কর্মহীন মানুষের সহায়তায় দান করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তিনি। অসহায়দের খাদ্যসহায়তার জন্য উপজেলা প্রশাসনের গঠন করা তহবিলে শেষ সম্বলটুকু দান করে সারাদেশের মানুষের ভালবাসা অর্জন করেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার প্রশংসা করেছেন। মহান ব্যক্তিকে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় আনারও নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

এর বাইরে সামাজিক অনেক সংগঠন করোনা সঙ্কটের কালে বড় ভূমিকা পালন করে চলেছে। এই যেমন, আল মারকাজুল ইসলামী নামের একটি বেসরকারী সংস্থা প্রতিদিনই করোনায় মৃতদের দাফন করছে। একদল স্বেচ্ছাসেবী নির্ভয়ে করে যাচ্ছেন এ কাজ।

আরও একটি বড় উদাহরণ বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। চিকিৎসকদের জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজার প্রস্তুত করা, পিপিই তৈরি ও ত্রাণ বিতরণের কাজ করে চলেছে সংগঠনটি। করোনা সঙ্কটের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে এই স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ শুরু করেন। এখনও অক্লান্ত তারা। তাদের আন্তরিক চেষ্টা দেখে উৎসাহিত হয়ে অনেক সাধারণ মানুষও এগিয়ে এসেছেন। তারা ফাউন্ডেশনকে অর্থ ইত্যাদি দিয়ে সহায়তা করছেন।

তারও আগে থেকে কাজ করছে বিডি ক্লিন নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ‘খাবার আমার একার নয়, ক্ষুধাকে এবার করব জয়’ স্লোগানে কাজ করছেন তারা। সংগঠনের প্রধান মিলন জানান, দেশজুড়ে ৬০ হাজার অসহায় পরিবারের জন্য ৪ মাসের খাদ্য সহায়তা দিতে কাজ করছেন তারা। বিডি ক্লিনের ১১২টি টিম এ কাজে ব্যস্ত রয়েছে। ৮৫ হাজারেরও অধিক অসহায় পরিবারের তালিকা থেকে যাচাই বাছাই শেষে চূড়ান্তভাবে ৬০ হাজার পরিবারকে বেছে নেয়া হয়েছে। বিত্তবানদের অনুদানে তাদের খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে বলে জানান মিলন।

কাজ করছে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছেন। শ্রমিক সঙ্কটে পড়া কৃষকের ধান কেটে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসছেন তারা। ‘ফ্রি সবজি বাজার’ নামে একটি চমৎকার কর্মসূচী চালু করেছে দলের ছাত্র সংগঠনটি।

আরও অনেক, অসংখ্য মানবিক মানুষ নিজের কথা না ভেবে বিপদগ্রস্তদের কথা ভাবছেন। তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করছেন। সবার কথা জানাজানি হবে না। তবে এখন পর্যন্ত যত মানুষের কথা জানা গেছে নিশ্চয়ই তা কম নয়। নিশ্চয়ই তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি