Loading..

ম্যাগাজিন

০৪ জুন, ২০২০ ০১:১০ অপরাহ্ণ

করোনা ও আম্পান: যেভাবে লাখো মানুষকে নিরাপদে রেখেছে বাংলাদেশ

শেখ হাসিনা এবং প্যাট্রিক ভারকুইজেন                                                                                                                           গত মে মাসে ভারত মহাসাগরে যখন ঘূর্ণিঝড় আম্পান উৎপন্ন হচ্ছিল, তখন নষ্ট করার মত সময় হাতে ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের যে আশ্রয়কেন্দ্রগুলো, সেগুলো সামাজিক দূরত্বের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়নি। ফলে করোনাভাইরাসের মহাবিপদের সামনে না ফেলেও কিভাবে ২৪ লাখ মানুষকে ঝড়ের ধ্বংসাত্মক পথ থেকে সরিয়ে রাখা যায়— সেটা ছিল নতুন একটি চ্যালেঞ্জ।                             ওই সময়ে বিপুলসংখ্যক মানুষকে সরিয়ে নেওয়াটাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। এরকম সময়ে সাধারণ মানুষ তাদের নিজ বাড়িঘর অরক্ষিত রেখে কোথায়ও যেতে চায় না। এবারে চ্যালেঞ্জটি আরও জটিল। মানুষ ভাইরাসের ভয়ে এবার আশ্রয়কেন্দ্রে যাতে চাইল না। মানুষকে আশ্বস্ত করতে হয়েছিল যে আশ্রয়কেন্দ্রে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি নেই।

ওই কয়েকদিনের মধ্যেই সামাজিক দূরত্বের জন্য বাংলাদেশ ৪ হাজার ১৭১টি আশ্রয় কেন্দ্রের পাশাপাশি আরও ১০ হাজার ৫০০ আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করে। উপকূলীয় অঞ্চলের ৭০ হাজারের বেশি ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি’ স্বেচ্ছাসেবীদের একত্রিত করা হয়। মাস্ক, পানি, সাবান ও স্যানিটাইজার সরবরাহ করা হয়। যেসব পোশাক কারখানায় বৈদেশিক রফতানি আদেশ বাতিল হয়েছে, সেগুলোকে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী তৈরিতে উৎসাহিত করা হয়।                                                                                                                               করোনাভাইরাসের মতো একটি বৈশ্বিক মহামারির মধ্যে যখন ঘূর্ণিঝড় আম্পান এসে হাজির হলো, এটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো—  জলবায়ুর পাশাপাশি কতটা স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে মানবজাতি রয়েছে, আর দুইটি ঝুঁকিই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাসাগর ও বায়ুমণ্ডল বিষয়ক সংস্থার পূর্বাভাস মতে, এ বছরের হারিকনের মৌসুমটি একটি রেকর্ড সৃষ্টিকারী মৌসুম হতে যাচ্ছে। এর কারণ হলো আটলান্টিক ও ক্যারবীয় অঞ্চলে জলের অস্বাভাবিক তাপমাত্রা। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতোই দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলেও মানুষকে সুরক্ষিত রাখার কাজটি কোভিড -১৯-এর কারণে অত্যন্ত জটিল হয়ে উঠবে।

৫৫ হাজার জনের একটি ফার্স্ট রেসপন্ডারসহ বাংলাদেশের দুর্যোগ প্রস্তুতির কারণে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ভারত এবং বাংলাদেশ ১০০ জনেরও কম মানুষ মারা গেছে। প্রত্যেকটি মৃত্যুই দুঃখজনক। তবে দেশের প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা ও উন্নত পুনরুদ্ধার ব্যবস্থার কারণে কয়েক বছর ধরে লাখ লাখ জীবন বাঁচানো গেছে।

পরিকাঠামো পুনঃর্নির্মাণ ও জীবিকা নির্বাহ চালু করা অবশ্য অন্য বিষয়। এর আগে বহুবার ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে বাংলাদেশ, সে অবস্থা থেকে বাংলাদেশ ঘুরেও দাঁড়িয়েছে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়ের ঝুঁকির দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ঝুঁকিতে থাকা দেশ বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫ মিটার উচ্চতারও নিচে। ফলে পুনঃর্নির্মাণ এখানে একটি সবসময়ের জন্য চলমান কার্যক্রম। জলবায়ু সংকট এটিকে আরও কঠিন করে তুলেছে। ঘূর্ণিঝড়গুলো আরও ঘন ঘন ও তীব্রও হয়ে উঠছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাবে কৃষিজমি ও পানির কূপ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মহামারি ও এর ফলে গভীর অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণে সরকারকে এখন একই সঙ্গে স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও অবকাঠামো সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

উত্তর ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আম্পান সবচেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ হয়েছে। এর ফলে প্রায় ১৩০০ কোটি ডলারের ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশে এটি ৪১৫ কিলোমিটার রাস্তা, ২০০টি সেতু, কয়েক হাজার ঘরবাড়ি, বিশাল আবাদি জমি এবং মৎস্যজীবীর ক্ষতি করেছে। ঝড়ের তীব্রতায় ১৫০ কিলোমিটারের বেশি বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় আম্পান মহাবিপর্যয় হয়ে এসেছিল। তা সত্ত্বেও পরিকল্পনার ফলে দুর্যোগের সময় দেশকে ভালোভাবে প্রস্তুত করা গেছে। তবে শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগের তাৎক্ষণিক প্রভাব মোকাবিলা করাই যথেষ্ট নয়, সমাজকে পরবর্তী ঝড়ের মোকাবিলার জন্যও আরও ভালোভাবে প্রস্তুত করাও জরুরি।

২০১৪ সালে পুনর্গঠন সংক্রান্ত কাজগুলো আরও ভালোভাবে করার জন্য জলবায়ু আর্থিক কাঠামো কার্যকর করতে হয় বাংলাদেশকে। এতে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বহুবর্ষ পরিকল্পনা ও একাধিক বিভাগের সমন্বয়ে জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা অর্জনে তহবিল গঠনের কাজ শুরু করে। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে সৃষ্ট কৃষি, বাসস্থান ও জ্বালানি সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে, প্রতি বছরের বাজেটে বরাদ্দ এবং স্তরে স্তরে পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে; যেখানে সমন্বয় করা হয়েছে সরকারের ২০ মন্ত্রণালয়কে।

এর ধারাবাহিকতায় ব-দ্বীপ অঞ্চলের তিন কোটি মানুষের জন্য ৮ দশকের জন্য এক জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ নামের ওই পরিকল্পনার প্রথম দশকে জোর দেওয়া হয়েছে- অবকাঠামো শক্তিশালীকরণের ওপর। যেমন ঝড়ের ফলে জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা রোধে উচ্চতর বাঁধ নির্মাণ করা। এবার আম্পানের পরে স্কুল, হাসপাতাল ও ঘরবাড়ি আবারও শক্তিশালী করে নির্মাণ করতে হবে, যেন আরও বেশি স্থিতিস্থাপক ও ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধে সক্ষম হয়, যেন উপকূলীয় অঞ্চলে পরবর্তী ঝড়ে আশ্রয় কেন্দ্রের অভাব না হয়।

কোভিড-১৯ বিশ্বজুড়ে সরকারি অর্থায়নে বিশাল ঘাটতি তৈরি করেছে। তবে আমরা বিশ্বাস করি দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক কাঠামো ও জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনা দেশগুলোকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভালো সহায়তা করবে।

স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং জলবায়ু সক্ষমতা একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই ডেল্টা প্ল্যানে জমি ও সেচ প্রকল্প এবং জনগোষ্ঠীগুলোকে স্বাস্থ্যকর ও আরও বেশি স্থিতিশীল করার ব্যবস্থাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিটি ধ্বংসাত্মক ঝড়ের পরে রোগ প্রতিরোধ করতে দূষিত জল ফিল্টারের কাজে  সৌর হোম কিট ব্যবহার করা যায়।

এ বছরে স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক ও জলবায়ু ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলাদেশই এমন একমাত্র দেশ নয়। তাই আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ: দেশ হিসাবে আমরা বিশ্বজুড়ে সাফল্য থেকে শিখতে পারি এবং একে অপরকে সহযোগিতা করতে পারি। একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমেই আমরা আরও শক্তিশালী ও স্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশনের সিইও প্যাট্রিক ভারকুইজেনের যৌথ এ নিবন্ধটি প্রভাবশালী ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত হয়েছে।

সারাবাংলা/আইই/টিআর

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি