Loading..

খবর-দার

০১ জুলাই, ২০২০ ০২:৩৫ অপরাহ্ণ

রংপুরের বিখ্যাত হাড়িভাঙ্গা আম

রংপুরের হাড়িভাঙ্গা আম এখন বেশ জনপ্রিয় ফলের মধ্যে অন্যতম। রঙ্গ রসে ভরপুর-রংপুর এখন ব্রান্ডিং ও পরিচিত পাচ্ছে রংপুরের হাড়িভাঙ্গার মাধ্যমেই। ফলের জগতে খুব অল্পসময়ের মধ্যে সুমিষ্ট, সুস্বাদু, শাঁস-আঁশবিহীন হাড়িভাঙ্গা আম স্থানীয় চাহিদা পুরণ করে দেশ-বিদেশেও বিক্রি হচ্ছে। রংপুরের মিঠাপুকুরে হাড়িভাঙ্গা আমের আদি উৎপত্তি হলেও বর্তমানে রংপুর জেলার তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জ, পীরগাছা এবং পীরগঞ্জ, কাউনিয়া, বদরগঞ্জের উপজেলার কিছু এলাকাতেও ব্যাপকভাবে হাড়িভাঙ্গা উৎপাদন হচ্ছে। চাষের অনূকুল আবহাওয়া ও মাটির কারণে বসতবাড়ি ও বাণিজ্যিকভাবে রংপুরের পাশাপাশি ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, পঞ্চগড় ও গাইবান্ধা জেলার বেশকিছু এলাকায় এখন এই আমের চাষ হচ্ছে।

যে ব্যক্তি এই হাড়িভাঙ্গা আম চাষ, ফলন ও সম্প্রসারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার নাম আলহাজ আব্দুস সালাম সরকার, পাইকার নফল উদ্দিন ও তার ছেলে তমির উদ্দিন। আব্দুস সালাম সরকার ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে চাকুরী জীবনেও বৃক্ষরোপনে অত্যন্ত আগ্রহী ও নিবেদিত ছিলেন। সরকারি চাকুরী থেকে অবসর নিয়ে ১৯৯৩ সালে আব্দুস সালাম সরকার হাড়িভাঙ্গা আমের চারা সংগ্রহে নামে। তিনি মিঠাপুকুর উপজেলার খোরাগাছ ইউনিয়নে তেকানি গ্রামের পাইকার নফল উদ্দিন পাইকারের ছেলে তমির উদ্দিন পাইকারের বাড়িতে যান, যিনি মূলতঃ এই আমটির চারা সংগ্রহ করে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণেরর উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

আব্দুস সালাম সরকার জানান, বালুয়া মাসিমপুর ইউনিয়নের  জমিদার বাড়ির বাগানে উদারমনা ও সৌখিন রাজা তাজ বাহাদুর শিং এর আমলে আমদানিকৃত ও রোপিত বিভিন্ন প্রজাতির সুগন্ধিযুক্ত ফুল ও সুস্বাদু ফলের বাগান ছিল। প্রথমে নফল উদ্দিন ও তারসাথে তার ছেলে তমির উদ্দিন জমিদার ও স্থানীয়দের আম সংগ্রহ করে স্থানীয় হাট-বাজারে বিক্রি করতেন। দেশে ১৯৮৮ সালের বন্যা ও ভাঙ্গনে যমুনেশ্বরী নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায় জমিদার বাড়ির আমের বাগান। বিলীন হওয়ার মুহুর্তে তমির উদ্দিন জমিদারের আমের বাগান থেকে একটি আম গাছের চারা এনে নিজ বাড়িতে রোপন করেন। কিন্তু শুকনো মৌসুম ও বরেন্দ্র প্রকৃতির মাটি হওয়ায় আমের কলম চারাটি একটি হাড়িতে তুলে নিজ জমিতে রোপন করে পরিচর্যা করতে থাকেন। কিন্তু কয়েকদিন পরেই কে বা কারা হাড়িটি ভেঙ্গে ফেলে। তবে হাড়িটি ভাঙ্গলেও গাছটির কোন ক্ষতি হয়নি। ক্রমেই বড় হয়ে ৩ বছরের মধ্যেই ফল দেওয়া শুরু করে। স্থানীয় ও প্রতিবেশিরা এই গাছের আম খেয়ে নফল উদ্দিনকে জাত ও গাছের নাম জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, ভাঙ্গা হাড়ি গাছের আম। নফল উদ্দিনের মূখ থেকে উচ্চারিত হাড়িভাঙ্গা কথা অনুযায়ী পরবর্তীতে “হাড়িভাঙ্গা’’ আমটি নামে পরিচিত লাভ করে।

বর্তমানে শুধুমাত্র রংপুর জেলায় ১৬শ’ ২৩ হেক্টর জমিতে বানিজ্যিকভাবে হাড়িভাঙ্গা আমের চাষ হচ্ছে। আর এ জেলায় হাড়িভাঙ্গা আমের বাগানের সংখ্যা ৪ হাজার ৬শ’ ৮৫টি এবং বসতবাড়িতে গাছের সংখ্যা ৪লাখ ৭৩ হাজার ৩শ’ টি। প্রতি হেক্টরের গড় ফলন ১১ মে.টন।

হাড়িভাঙ্গা আম গাছের চারা আকর্ষণীয়। গাছটির ডগা অত্যন্ত বলিষ্ঠ। গ্রাফটিং করলে বা ডালে জোড়া কলম লাগলে গাছটি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। চারা রোপনের পরবর্তী বছরেই মুকুল আসে। তবে প্রথম বছর মুকুল ভেঙ্গে দিলে ডগার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। গাছটি উচ্চতার চেয়ে বিস্তৃত বেশি হওয়ায় ঝড়-বাতাসে ক্ষতি কম হয়।

আকৃতির দিক থেকে পুর্ণাঙ্গ আমে উপরিভাগ বেশি মোটা ও চওড়া এবং নিচের অংশ অপেক্ষাকৃত চিকন। দেখতে সুঠাম, মাংসল এবং আটি পাতলা। ভেতরে কোন আঁশ নেই। ৩ থেকে ৪টি আম গড়ে ১ কেজি হয়ে থাকে। আবার কোন কোন আম ৬ থেকে ৭শ’ গ্রাম পর্যন্তও হয়। পাকলেও আমটির রং খুব বেশি পরিবর্তন হয় না বা পাকা দেখা যায় না। মাঘ ও ফাল্গুন মাসে মুকুল আসে এবং আষাঢ় মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে পাঁকতে শুরু করে শ্রাবন মাস পর্যন্ত পাওয়া যায়। হাড়িভাঙ্গা কাঁচা থেকে পাকা পর্যন্ত খেলে বিভিন্ন স্তরের স্বাদ পাওয়া যায়। তবে, পাকা খেলে স্বাদ বেশি।

চারা রোপন বাদে হেক্টরপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা উৎপাদন খরচ হলেও ৫ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করা যায়। আমের কেজি রংপুর অঞ্চলে মৌসুমে ৪০ থেকে ৬০ টাকা ধরে বিক্রি হয়ে থাকে। তবে চলতি মৌসুমে শুরুর দিকে কেজির মূল্য ১০-১২ টাকায় নেমে আসলেও বর্তমানে দাম একশ’ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

আম জাতীয় আয় ও স্বাস্থ্য বিনির্মানে অবদানে ভূমিকা রাখছে। আম গাছ পরিবেশবান্ধব। হাড়িভাঙ্গা আমই এখন রংপুর জেলাকে দেশ ও বিদেশে ব্রান্ডিং জেলাতে তুলে ধরছে। অনেক সম্ভাবনাময় আম চাষ ও আম শিল্পকে আরো আধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ গবেষনা ও ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে আসলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে অর্থকরী ফল হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে হাড়িভাঙ্গা আম উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখার দাবী রাখে।  

(সংগৃহিত)