Loading..

ম্যাগাজিন

০৫ জুলাই, ২০২০ ০৪:০৫ অপরাহ্ণ

কাক-কথন

কাক কথন
--
কাকভোরে কেকা কাঁকন কাকার কাছে কইল, " কাকা, কাক কা-কা করে কেন?"
কাঁকন কইল, " কেকা, কাকভোরে কা-কা করিস কেন, কাকের মত!"
এটা হল প্রারম্ভ, কাক নিয়ে লিখতে মন চাইল, তার সূচনা।
কাক আমাদের অতি পরিচিত, অতি চেনা পাখী। কাকের সাথে আমাদের জীবনও কাকময় হয়ে গেছে কবে, কে তার খোঁজ রাখে! এই যে উপকারী পাখীটি আমাদের কত উপকার করে, বিনিময়ে আমাদের কাছে সে চির উপেক্ষিত হয়ে রইল, অনাদৃত আর অবহেলিত হয়েই রইল। আমরা তাকে কেবল দূর দূর দূর করে তাড়িয়ে দিই।
কা কা করে শব্দ করে বলেই তো সে কাক। কই? কী বানিয়েছ? দাও। সে কেবল কা কা করে, দাও দাও বলে।
কাক= √কৈ( শব্দ কর ) + ক (কন্ ) - কর্তৃবাচ্যে। (ব.শ)।  ( কা কৃত্য )  কী করেছ ( বানিয়েছ )  এই কথা বলে যে, কাক পক্ষী।
মনুষ্য,সমাজে ছিঁচকে চোরদের কাক বলা হত, কারণ কা + কাকুতি বা কা-কা রূপ আকুতি করত, কাতর বচন করে ( কাকুতি )  যা পেত তা অন্যত্র আবার কাতর বচনে বিক্রি করত যাকে বলতে পারি কাকুতি-মিনতি করে যা পেত এবং তা কাকুতি-মিনতি বিক্রি করত। এজন্যই কাক হল আদি ফেরিওয়ালা।  পক্ষীদের পক্ষ থাকে। মানুষের সমাজেও পক্ষ থাকে। ক্রেতাপক্ষ - বিক্রেতাপক্ষ, বাদীপক্ষ - বিবাদীপক্ষ। ক্রমান্বয়ে মানুষের সমাজে আরও বহু রকমের পক্ষী বা দোকানদারের আভির্ভাব ঘটে।
কাক-কে বায়স বলা হয়। বয়স থেকে জাত শব্দ বায়স। বয়স আশ্রিত থাকে বায়সে। প্রাচীনকালে আমাদের ঐতিহাসিক ছিলেন না। এই ধারণাই ছিল না আমাদের ভাষার জগতে তাই, ইংরেজি thank you শব্দের মত ঐতিহাসিক শব্দটিও ছিল না। আমাদের ছিল বায়স। কিন্তু এটাই  সত্য আমাদের সংস্কৃতি সবচেয়ে প্রাচীন, এবং ঋদ্ধিসম্পন্ন। সেকালে ঐতিহাসিকগণ বায়সরূপে পরিচিত ছিলেন। বয়স হয়ে গেলে মানুষের মনে বিগত ঘটনা একের পর এক ছায়াপাত করতে থাকে। প্রাচীনকালে কারো বয়স বাড়লে বায়সরূপে সক্রিয় থেকে পুরাণাদি লিখতেন যিনি ছিলেন বায়স। সেজন্য আদি পুরাণ রচয়িতার নাম কাকভুষুণ্ড। কাকভুষুণ্ড - যে কাকের ভুষুণ্ড আছে, অমর জ্ঞানী, রামায়ণ রচয়িতা। কাককে বায়স বলা হয়, বায়সদের মত কাকেরও বয়স বোঝা যায় না,কারণ তার সে বয়স অর্থাৎ কালকৃত মহূর্তক্ষণগতিকে পরিণত করে যে বার্ধক্য দশা তা থেকে রক্ষা করে।
কাকের চরিত্র বোঝা যায়? আগের দিনে একদল মানুষ ছিল যারা  গ্রামে শহরে  ঘুরে বেড়াত, ভূত ভবিষ্যৎ বলে দিত, বিনিময়ে চাল-ডাল টাকাকড়ি নিত। এরা হল কাকচরিত্র বা কাকচারা। বর্ত্তমানে কেবল বেদে সম্প্রদায়ের মধ্যে কাকাচারাদের দু-চারজন এই শ্রেণির মানুষ আছেন।
" কাকের স্বভাব বড়ই বিচিত্র, অন্য জিনিস ছড়িয়ে খায়, মধু পেলে ঠোঁট দিয়ে জড় করে খায়। তাই তার আরেক নাম মৌকুলি। কাক অশুভ দূর করার সঙ্কেত করে বলে তার আর একটি নাম অরিষ্ট।  - মিজানুর রহমান, পক্ষী। "
কাককে দেয় যে অন্নাদি, কাককে দেয় নবান্নের অংশ, কাককে দিতে হয় যে বলি - কাকবলি। আগের যুগে দ্বারে দ্বারে যে ফেরিওয়ালাকে কিছু পরিমাণ উৎপন্ন মানুষ এমনি অথবা সামান্য কিছুর বিনিময়ে দিয়ে দিত। সেই প্রদত্ত অন্ন হল কাকবলি। এই কাকবলি চুরি ঠেকানোর জন্য দেওয়া হত। ভারতসমাজে বছরের বিশেষ দিনে কাকের উদ্দেশ্যে রুটি পিঠা বানিয়ে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিয়ে আসা হত, উদ্দেশ্য অশুভ নাশ। একেও কাকবলি বলা হয়। এই কাকবলির দিনে বাচ্চারা নানারকম ছড়া কেটে কাকদের খেতে ডাকত।
কাক অল্প পরিমাণ জল থাকলেও পান করে নিঃশেষ করতে পারে বলে যে জল কাক পান করতে পারে সেই জলকে বলে কাকপেয় জল। করণ বিষয়ক মূল শক্তিটিকে কাজে রূপায়িত করে বা করার ক্ষমতা ধরে যে, সেই কঙ্ক। পাখিদের সমাজে এ হল কাঁকপাখি, মানুষের সমাজে ছদ্মবেশী যোদ্ধা।
কবি জসীম উদদীন তাঁর নিমন্ত্রণ কবিতায় লিখেছিলেন
" কালো জল তার মাজিয়াছে কেবা কাকের চক্ষু নিয়া"
কাকের চোখ স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল সেজন্য টলটলে স্বচ্ছ জলকে কাকচক্ষু জল বলা হয়। কাক অতিশয় কালো বলে, গাত্র বর্ণ কালো হলে অনেকে কাউয়ার মত দেখতে বলে। আর সেই গল্পটাতো জানা আছে সবার - এক মায়ের কালো বাচ্চা হয়, লোকমুখে ছড়াতে ছড়াতে সেটা কাউয়া হয়ে যায়। কাকের ঠ্যাং দুটি কুৎসিত, তাই কারও লেখা সুন্দর না হলে বলে "কাকের ঠ্যাং, বকের ঠ্যাং", হাতের লেখার সময় দুই শব্দের মাঝখানে কিছু বাদ গেলে যে চিহ্ন ব্যবহার করে লাইনের উপরে যোগ করে দিই, তাকে বলে " কাকপদ" চিহ্ন।
কবি প্রেমিকার চোখকে পাখীর বাসার সাথে তুলনা করেন, আর এলোমেলো চুল হলে কাকের বাসার সাথে তুলনা করেন। কাকের বাসায় হেন কোনও জিনিস নাই যে কাক জড়ো করে রাখেনা, ফল হয় তার বাসাটা হয়ে যায় এলোমেলো।
কাক কিন্তু খুব ভোরে সূর্য্য ওঠার আগেই কা কা করে ডাকতে থাকে, গ্রামের লোকজন তখন ঘুম থেকে উঠে কাজে যাবার প্রস্তুতি নেয়। সেই ভোরকে তাই কাকভোর বলে। অনেক সময় জ্যোৎস্না রাতে জ্যোৎস্না মিইয়ে গেলে, কাক ভোর হয়েছে ভেবে ডেকে ওঠে, সেই জোছনাকে বলে কাকজ্যোৎস্না।
ফসলের ক্ষেতে, ফলের বাগানে কাকতাড়ুয়া পুঁতে রাখা হয়, যেন কোনও পাখী সেসব খেয়ে নষ্ট না করে, কেবল কাকই যে তা নষ্ট করে তা কিন্তু নয়, কিন্তু ওটার নাম কাকতাড়ুয়া। কাকের ডাক কখনও অশুভ, কখনও শুভ বলে আগের দিনের মানুষ মনে করত, কাক গাছের বা ঘরের চালে বসে কা কা ডাকলে অতিথি আসছে বলা হত। যাত্রাকালে কাকের ডাক অশুভ, কাক মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেলে অশুভ, আবার ক্বর্র্ ক্বর্র্ ডাক শুনলে শুভ। কাকের ডাককে বলে "কাকরুত"।
কাক অল্প পানিতে পাখা ঝাপটে স্নান করতে পারে, সেজন্য কেউ খুব দ্রুত বা স্বল্প পানিতে স্নান করলে বলে কাকস্নান, কাক কপট পাখী বলে চিহ্নিত, তাই কেউ ঘুমের ভান করলে বলে " কপটনিদ্রা"।
যে নারী জীবনে একটি সন্তান প্রসব করেন, তাকে বলে "কাকবন্ধ্যা"। আবার কাক এতটাই বোকা যে কোকিল এসে তার বাসায় ডিম পাড়ে, সে তা দিয়ে বাচ্ছা ফোটায়, টের পায় না। কাকের দ্বারা পালিত হয় বলে কোকিলকে বলে " কাকপুষ্ট"।
কেউ যা নয়, তা নিজেকে দেখাতে চাইলে বলে, কাক হয়ে ময়ূরপুচ্ছ ধারণ করে।
তীর্থস্থানে অনেক খাবারের আয়োজন থাকে, সেই খাবারের উচ্ছিষ্ট খাওয়ার লোভে কাকের দল তীর্থস্থানে বেশী দেখা যায়। তারা খাবারের অপেক্ষায় থাকে, সেজন্য কোনও কিছু পাবার অধীর আগ্রহে অপেক্ষাকারীকে তীর্থের কাকের সাথে তুলনা করা হয়।
নিম কাকের প্রিয় ফল তাই নিমফল ও নিমগাছকে "কাকফল" বলে। ক্ষুদ্র ও গোলাকার এক ধরণের গাছ আছে, যার পাতা পানের মত, তাকে বলে কাকমারি গাছ। যে ধানে চাল থাকে থাকে না, তাকে বলে "কাকযব", কাকবাহিত ফলের বীজ থেকে উৎপন্ন গাছকে বলে "কাজরুহা", বক ফুল দেখতে কাকের মাথার মত তাই ওই গাছকে "কাকশীর্ষ" বলে।
দুটো ঘটনা যদি এমনভাবে ঘটে যে মনে হয়, একটির কারণে আরেকটি ঘটেছে ; কিন্তু আসলে তা নয়। তখন তাকে বলে "কাকতালীয় ঘটনা"। একবার তালগাছে একটি কাক বসেছিল, ঠিক তখনই গাছ থেকে একটি তাল মাটিতে পড়ে। কাক বসেছে বলে তাল পড়েছে, ঘটনা কিন্তু এমন নয়, কারণ কাকের ভারে তাল পড়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ, দুটো পরস্পর সম্পর্কহীন ঘটনা একই সাথে ঘটলে বলে "কাকতাকীয় ঘটনা"।
কাক বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে, এটা বলাই যায়। কাক নিয়ে কত শব্দ আছে। আছে কত প্রবাদ প্রবচন।
একের দোষ অন্যকে চাপালে বলে " কাকে খায় কাঁঠাল, বকের মুখে আঠা "।
অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে কাজ করলে বলা হয় " কাক নিয়ে গেল কান, কাকের পিছে ধাবমান "।
স্বজাতির অনিষ্ট কেউ করে না বুঝাতে বলা হয় " কাকের মাংস কাকে খায় না"।
কেউ কাউকে উত্যক্ত করলে বলে " কাকের পিছে ফিঙ্গে লাগা "।
এমনতর অসংখ্য কাক সম্পর্কিত প্রবাদ আছে।
কাক দেখতে কর্কশ, কাক অপরিচ্ছন্ন নোংরা পাখী, কিন্তু কাক আমাদের নোংরা আবর্জনা খেয়ে পরিবেশ পরিষ্কার রাখে। কাকের প্রতি যতই অবহেলা আর তাচ্ছিল্য থাকুক না কেন, আমাদের জীবনে কাকের অবদান অন্য যে কোনও পাখীর চেয়ে কোনও অংশে কম নয়, বরং বেশী, একথা অনস্বীকার্য।
--- কৃতজ্ঞতা: বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, বাঙালা ভাষার অভিধান, বঙ্গীয় শব্দকোষ, নেট।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি