Loading..

খবর-দার

১৫ জুলাই, ২০২০ ১০:১৩ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষায় বিনিয়োগে বেশি রিটার্ন পাওয়া যায়, এটা বোঝা প্রয়োজন : অধ্যাপক কায়কোবাদ

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ বিষয়ে কথা বলেছেন বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ। বর্তমানে তিনি শিক্ষকতা করছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার সঙ্গে আলোচনায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন দিক। মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে এ তথ্য জানা যায়। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল আমীন। সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত-

বুয়েটে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করে সম্প্রতি আপনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন কেন?

গত এপ্রিলে বুয়েট থেকে অবসর নিয়েছি। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছি জুন মাসে। অবসর নেয়ার পর ব্র্যাকের উপাচার্য ভিনসেন্ট চ্যাং তার প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য আমাকে চিঠি দেন। চিঠিটা এতটাই উৎসাহমূলক ছিল যে আমি তাতে সায় না দিয়ে পারিনি।

বুয়েটে পড়া শিক্ষার্থী বলুন আর ব্র্যাকে, সবাই তো আমাদেরই ছেলে-মেয়ে। বুয়েটে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করার অসাধারণ সুযোগ হয়েছে। অবসর নেয়ার পর তো বসে থাকতাম না। কিছু করতামই। সেই সুযোগ এসেছে ব্র্যাকে শিক্ষকতার মাধ্যমে। এখানে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের যথেষ্ট পরিমাণে উৎসাহ আছে ভালো কিছু করার।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার কতটা অগ্রগতি দেখছেন?

আমাদের দেশে শিক্ষাখাত অবহেলিত। এক সময় কোরিয়া, মালয়েশিয়া থেকে ছেলে-মেয়েরা আমাদের দেশে পড়তে আসত। এখন আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েরা সেসব দেশে পড়তে যায়। অগ্রগতি একটি আপেক্ষিক বিষয়। সবাই যদি ১০ কিলোমিটার বেগে দৌড়ায় আর আমরা যদি পাঁচ কিলোমিটার বেগে দৌড়াই তাহলে তাদের থেকে পিছিয়ে যাব। আমাদের শিক্ষা নিয়ে অনেক কাজ করার সুযোগ আছে। আমাদের সীমিত সম্পদের দেশ। সরকারের হয়তো সদিচ্ছা থাকার পরও অনেক সম্পদ বিনিয়োগ করতে পারে না। তবে, শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে সেখান থেকেই সবচেয়ে বেশি রিটার্ন পাওয়া যায়। এটা আমাদের বুঝতে হবে। আমদের এখনও অনেক দূর যেতে হবে। এর জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞানে আমাদের বিশ্বমানের হতে হবে। শিক্ষা নিয়ে আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে।

সাধারণত সবাই বুয়েটকে দেশের এক নম্বর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ধরে থাকেন।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সেভাবে র‌্যাংকিং করা হয় না। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশসহ আরও অনেক দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং করে। এতে করে একটি সুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। যদি দেখি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এ বছর এক নম্বর হয়েছে, তাহলে পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের টনক নড়বে। আমরা তখন চিন্তা করব, পেছনে পরে গেলাম, সামনে এগোতে হবে। সুস্থ প্রতিযোগিতা দাঁড় করানো খুবই কঠিন। তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে ব্যয় সাশ্রয়ী পদ্ধতি। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি শিক্ষক, অনুষদসহ নানা বিষয়ে র‌্যাংকিং করা হলে সবার মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা তৈরি হতো আরও ভালো করার। এটা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রমের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?

বাংলাদেশে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম আমাদের অনেক আগেই শুরু করা উচিত ছিল। ২০১০ বা তার আগেও হরতালসহ নানা কারণে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে থাকত। এতে  আমাদের অনেক শিক্ষার্থী চার বছরের কোর্স সাত বছরে শেষ করেছে। এটা অনেক বড় একটা ক্ষতি। এরপর আছে যানজটসহ নানা সমস্যা। সেসময়েই যদি অনলাইন পাঠদান শুরু করা যেত তাহলে এই ক্ষতি হতো না। বাসায় বসেই শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা এগিয়ে নিতে পারত।

অনলাইন পাঠদান নিয়মিত করার মাধ্যমে যানজটও কিছুটা নিরসন হতে পারে। আশা করি, খুব শিগগির আমরা কোভিড-১৯ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ পাবো। আমার মতে, তখন পালাক্রমে এলাকাভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইনে ক্লাস নেয়া যেতে পারে। যেমন ধরুন, সপ্তাহে যদি দুই দিন ভিকারুন্নিসা স্কুলের ক্লাস অনলাইনে হয় তাহলে ওই দুই দিন শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের পরিবহনে যে যানবাহনগুলো ব্যবহার হচ্ছে যেগুলো চলবে না। রাস্তায় গাড়ির চাপ কমবে। সেই সঙ্গে জ্বালানি ও সময় বাঁচবে। পরিকল্পনা করে চললে অনেক কিছুই করা সম্ভব।

অনলাইনে ক্লাস নেয়া বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতাও আছে। অনেক শিক্ষার্থীর হাতে প্রয়োজনীয় ডিভাইস এবং ইন্টারনেট সংযোগ নেই। সে বিষয়ে কী করা যেতে পারে?

আমরা সরাসরি শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়িয়ে ক্লাস নিতে অভ্যস্ত। অনলাইনে ক্লাস নিতে প্রথম দিকে কিছু সমস্যা আমাদেরও হবে। অনেক শিক্ষার্থী অনলাইনে ক্লাস করতে বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে পরবে, সে সমস্যাও হবে। আমরা বলি, এতে বৈষম্য তৈরি হবে।

লক্ষ করে দেখেন, যে কোনো প্রযুক্তির শুরুতেই বৈষম্য তৈরি হয়। সেই বৈষম্য নিরসনে কী করা যায় তা আমাদের বের করতে হবে। আমি মনে করি ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইনে ক্লাস করতে পারবে। বাকিরা নানা কারণে পারবে না। এই ১০ থেকে ২০ শতাংশের জন্য যদি বাকিদের বসিয়ে রাখি তাহলে তাদের পিছিয়ে দেয়া হবে।

আমরা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসার ক্ষেত্রে কি সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করতে পারছি? পারছি না। যারা অনলাইনে ক্লাস করতে পিছিয়ে থাকতে পারে তাদের জন্য ইউজিসি বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট সুবিধার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ধরনের বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে অগ্রসর হতে হবে। বসে থাকলে চলবে না।

দরিদ্র শিক্ষার্থীদের এভাবে খুঁজে করা খুব সহজ কাজ না। তারপরও এটা খুঁজে বের করে তাদের সহযোগিতা করা যেতে পারে। এখন তো স্মার্ট ফোনেও ক্লাস করা সম্ভব। আসলে এই মুহূর্তেই ১০০ ভাগ বৈষম্য আমরা নিরসন করতে পারব না। নানা ধরনের প্রতিকূলতা নিয়েই আমাদের প্রাত্যহিক জীবন। বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলা আমাদের কাম্য। সেজন্য আমরা চেষ্টা করব।

কিন্তু, তাই বলে সেই সক্ষমতা আসার আগ পর্যন্ত বসে থাকলে চলবে না। সবাইকে সমান অধিকার দিতে না পেরে যদি অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখি, তাহলে যাদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল তাদেরও পিছিয়ে রাখা হবে। এমনিতেই প্রতিবছর বিশেষজ্ঞ ও পরামর্শ ফি বাবদ ৩৫ হাজার কোটি টাকা অন্যান্য দেশকে দিচ্ছি। আমাদের ছেলে-মেয়েরা এগিয়ে আসতে না পারলে সেটা আরও বাড়বে। তাই, দেশের কল্যাণে আমাদের অনেক কিছুই মেনে নিতে হবে। দেশের কল্যাণটাই সবার আগে।

অনলাইনে পাঠদান সুষ্ঠভাবে সম্পাদন সম্ভব। কিন্তু, পরীক্ষার বিষয়ে সমাধান কীভাবে হতে পারে? ইতোমধ্যেই আমরা দেখছি উচ্চ মাধ্যমিকের কয়েক লাখ শিক্ষার্থী পরীক্ষার জন্য অপেক্ষায় আছে।

পাঠদান শেষে যারা একাডেমিক বর্ষ শেষ করল তারা পরীক্ষার জন্য বছরের পর বছর বসে থাকবে? এটা তো হতে পারে না। দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। প্রয়োজনে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই পাশ করানোর সিদ্ধান্তও নিতে হতে পারে। সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি নিতে বলা হবে। তারা তাদের প্রস্তুতি নিলেই আমাদের মূল লক্ষ্য অর্জিত হয়ে গেল। তাদের শিক্ষাটাই তো আমাদের মূল লক্ষ্য। এরপর পরীক্ষা নিই বা না নিই তারা শিখে ফেলেছে।

পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করার সুযোগ থাকে কার মেধা কেমন। তার ভিত্তিতে ভর্তিসহ নানা কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

যার একটি পা নেই সে তো আর দুটি পা থাকা মানুষের মতো করে দৌড়াতে পারবে না। সে মরে যায় না, কিন্তু সীমাবদ্ধতার মধ্যে বাস করে।

কোভিড-১৯ পরিস্থিতি যদি অনেক বেশি দীর্ঘায়িত হয়ে যায়, তাহলে এই শিক্ষার্থীরা কী করবে? বসে থাকতে থাকতে তারা কি ধীরে ধীরে উচ্ছন্নে যাবে না? তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে কি প্রভাব পরবে না? পরবে। তাদের জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়ায় জড়িত রাখতে হবে। এরপরও পরীক্ষা একটা ব্যাপার আসে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে পরীক্ষাও নেয়া হচ্ছে। নিয়মিত পরীক্ষাতেও তো নানা রকমের সমস্যা থাকে। নকল করা, প্রশ্নফাঁস হওয়াসহ নানা ধরনের প্রতিকূলতা থাকে। অনলাইনে পরীক্ষা নিলেও বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূলতা আসবে। কিন্তু, প্রয়োজনে সেই পথেই যেতে হবে।

ইউনেস্কোর বরাত দিয়ে সেভ দ্য চিলড্রেন বলেছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে সারা বিশ্বে শিক্ষাঙ্গন থেকে ঝরে পড়তে পারে প্রায় ১ কোটি শিশু। এই প্রভাব বাংলাদেশে পড়ার সম্ভাবনা আছে কি?

বাংলাদেশ সরকারের উপবৃত্তি প্রকল্প আছে। এই সুবিধা থাকার কারণে অনেক দরিদ্র অভিভাবক ছেলে-মেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠান। এরপরও কিছু শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। ১০০ ভাগ সমাধান আমরা করতে পারব না। বড় কোনো পরিবর্তন হলে কিছু মানুষ তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। আমরা চেষ্টা করব যতটা কম মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেটা নিশ্চিত করতে