Loading..

প্রেজেন্টেশন

১৪ আগস্ট, ২০২০ ০৯:৫৬ অপরাহ্ণ

ছোটদের বড়দের সকলের বঙ্গবন্ধু

ফাল্গুন মাসের দুপুর, শীত যাই যাই করেও যাচ্ছে না। সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক গৃহবধু, হাতের কাজ সেরে বাড়ির আমবাগানের ছায়ার এসে দাঁড়ালেন। সূর্য তখন মাথার ওপর, সূর্যমামার শানদার উত্তাপেই যেন লজ্জা পেয়ে আমগাছের ছায়া কুঁকড়ে সংকুচিত হয়ে ঠিক গাছ বরাবর চলে এসেছে। ওই এক চিলতে ছায়ায় দাঁড়িয়ে মা তাকিয়ে আছেন দূর পথের দিকে। স্কুল ছুটির পর খোকা প্রতিদিন এই সময়ই আসে। সম্ভ্রান্ত বংশের বড় ছেলে, সবার আদরের দুলাল; চকিতে মা দেখলেন কে যেন হেঁটে আসছে। হাঁটার ধাঁচ বলে এ তারই খোকা। কিন্তু পুরো শরীর চাদর মুড়ি দেওয়া কেন? এগিয়ে গেলেন মা, এ যে খোকাই। কি হয়েছে বাবা? মায়ের উদ্বিগ্ন প্রশ্ন। কই কিছু হয়নি তো! ছেলের ভাবলেশহীন উত্তর। তোমার জামা পায়জামা কই।

ও এই কথা? স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখলাম একটি ছেলের গায়ে কোনো জামা কাপড় নেই। আমারই সমান; এই শীতে ওর কাটে কি করে বলো তো মা?  তাই আমার জামা পায়জামা খুলে ওকে পরিয়ে দিয়ে এসেছি। ছেলেটা কি যে খুশি হয়েছে! মা একটু চিন্তিত হলেন ছেলের কাণ্ড দেখে। আবার পরক্ষণেই গর্বে বুক ফুলে উঠলো, কত উদার হয়েছে তার ছেলেটা।

এই হলো বঙ্গবন্ধু। দশ বছর বয়সেই যিনি নিজের গায়ের কাপড় খুলে অন্যকে দান করে দিতে পেরেছিলেন। মধুমতি আর ঘাগোর নদীর তীরে এবং হাওড়-বাওড়ের মিলনে গড়ে ওঠা বাংলার অবারিত প্রাকৃতিক পরিবেশ টুঙ্গিপাড়া গ্রামটি অবস্থিত। জেলার নাম ফরিদপুর (আজকের গোপালগঞ্জ)। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে সারি সারি গাছগুলো ছিল ছবির মতো সাজানো। নদীতে তখন বড় বড় পালতোলা পানশি, কেরায়া নৌকা, লঞ্চ ও স্টিমার চলতো। বর্ষায় গ্রামটিকে মনে হতো যেন শিল্পীর আঁকা জলে ডোবা একখণ্ড ছবি। এই টুঙ্গিপাড়ারই একটি বনেদী পরিবারের নাম শেখ পরিবার।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। এদিন শেখ লুৎফর রহমান ও তার সহধর্মিনী সায়রা খাতুনের ঘরে জন্ম নিলো একটি ফুটফুটে চেহারার শিশু। বাবা-মা আদর করে নাম রাখলেন খোকা। এই খোকাই হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জগৎ স্বীকৃত সমগ্র বাঙালির প্রিয় মানুষ।

তিনি ছিলেন একজন মাতৃভক্ত সন্তান। শৈশব-কৈশোরে বাবা-মা তাকে আদর করে খোকা বলে ডাকতেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাদের তৃতীয় সন্তান। স্বভাবের দিক দিয়ে ছিলেন একটু জেদি, চঞ্চল ও একগুঁয়ে।

বঙ্গবন্ধুর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সুষমামণ্ডিত এ টুঙ্গিপাড়াতেই। পুষ্পভরা শস্য শ্যামলা রূপসী বাংলাকে দেখেছেন। তিনি আবহমান বাংলার আলো-বাতাসে লালিত ও বর্ধিত হয়েছেন।

দোয়েল ও বাবুই পাখি ভীষণ ভালোবাসতেন। বাড়িতে শালিক ও ময়না পুষতেন। আবার নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটতেন। বানর ও কুকুর পুষতেন বোনদের নিয়ে। পাখি আর জীবজন্তুর প্রতি ছিল গভীর মমতা। মাছরাঙা ডুব দিয়ে কীভাবে মাছ ধরে তাও তিনি খেয়াল করতেন খালের পাড়ে বসে বসে। ফুটবল ছিল তার প্রিয় খেলা। এভাবে তার শৈশব কেটেছে মেঠো পথের ধুলোবালি মেখে আর বর্ষার কাদা পানিতে ভিজে।

গ্রামের মাটি আর মানুষ তাকে প্রবলভাবে আর্কষণ করতো। তিনি শাশ্বত গ্রামীণ সমাজের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ছেলেবেলা থেকে গভীরভাবে প্রত্যেক্ষ করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান আদালতে চাকরি করতেন । তার মাতা সায়েরা খাতুন ছিলেন গৃহিনী। পিতা-মাতার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে তিনি একজন বিজ্ঞ আইনজীবী হবেন। টুঙ্গিপাড়ার সেই শেখ বাড়ির দক্ষিণে ছিল কাছারি ঘর। এখানেই মাস্টার পতি ও মৌলভী সাহেবদের কাছে ছোট্ট মুজিবের হাতেখড়ি। একটু বড় হলে তাদের পূর্ব পুররুষদের গড়া গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার লেখাপড়া শুরু হয়।  এরপর পিতার কর্মস্থল মাদারীপুরের ইসলামিয়া হাইস্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে কিছুদিন লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে তার পিতা বদলি হয়ে গোপালগঞ্জে যোগদান করলে তিনি গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। বিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতেন তিনি।

পছন্দ করতেন ইতিহাসের বই। এসব কারণে প্রধান শিক্ষক গিরিশ চন্দ্রসহ সকল শিক্ষকের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন শেখ মুজিব। শিশুকাল থেকেই শেখ মুজিব ছিলেন পরোপকারী এবং অন্যায়ের প্রতিবাদী। মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় যেমন সহযোগিতার হাত বাড়াতেন-তেমনি কারো প্রতি অন্যায় আচরণ দেখলে প্রতিবাদ করতেন। মাত্র তের বছর বয়সে প্রতিবাদের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তিনি।

ওই সময় গোপালগঞ্জে স্বদেশি আন্দোলনের এক সমাবেশে জনতার ওপর পুলিশের নির্বিচার লাঠির্চাজ দেখে বিক্ষুব্ধ হয় শিশু মুজিব। ফলে বিক্ষোভকারীরা যখন পুলিশের ওপর চড়াও হয়, তখন তিনিও্ বন্ধুদের নিয়ে যোগ দেন বিক্ষোভকারীর দলে। পুলিশ ফাঁড়িতে শত শত ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে তারা নাজেহাল করে তোলেন পুলিশ সদস্যদের। তার সাহস দেখে অবাক হন থানার বড়কর্তা। তার বয়স যখন চৌদ্দ, তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন তিনি হঠাৎ চক্ষুরোগে আক্রান্ত হন । অনেক চিকিৎসা চলে। কিন্তু অসুখ সারে না। এ কারণে তার লেখাপড়া সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়। তিন বছর পর আবার সুস্থ হয়ে তিনি অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। মনোযোগী হন লেখাপড়ায়। তখন ঘটে আরেক ঘটনা। গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুল পরিদর্শনে আসেন শেরেবাংলা একে ফজলুক হক। তাকে সংবর্ধনা জানানোর ব্যাপারে শহরের হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। বিষয়টি কিশোর মুজিবের ভাল লাগেনি। তাই তিনি আয়োজকদের একজন হয়ে মসজিদ প্রাঙ্গণে সেবার স্কুল ঘর মেরামত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার আদায় করেন। এসময় বিরোধীচক্রের রোষানলে পড়েন শেখ মুজিব। রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে গ্রেফতার করা হয় তাকে। হাজতবাস করতে হয় সাতদিন। এটিই তার জীবনের প্রথম কারাবরণ।

তৎকালীন সমাজের অনেকটা প্রথা হিসেবেই আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ন রাখতে এগার বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুকে বিয়ে দেওয়া হয়। তখন তার প্রিয়তমা স্ত্রী রেণুর বয়স মাত্র তিন কি চার বছর। বিয়ের দু’বছর পর বঙ্গবন্ধুর শ্বশুর মারা গেলে তার স্ত্রী তাদের বাড়িতে স্থায়ীভাবে চলে আসেন এবং এখানেই লালিত পালিত হন। ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪৭ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করেন তিনি। ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। এ সময় শুরু হয় তার রাজনৈতি জীবনের সংগ্রামী অধ্যায়।

শৈশব থেকেই তিনি খুব অধিকার সচেতন ছিলেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ছিল তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয়কর্মী হামিদ মাস্টার ছিলেন তার গৃহ শিক্ষক। তার এক স্যার তখন গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের সাহায্য করার জন্য একটি সংগঠন করেছিলেন। শেখ মুজিব ছিলেন এই সংগঠনের প্রধান কর্মী। বাড়ি বাড়ি ধান চাল সংগ্রহ করে ছাত্রদের সাহায্য করতেন। তিনি ফুটবল খেলতে ভালোবাসতেন। স্কুল টিমের নেতা হয়ে বেশ কয়েকবার জিতে যায় তার দল। শৈশব থেকেই তিনি তৎকালীন সমাজ জীবনের জমিদার, তালুকদার ও মহাজনদের অত্যাচার, শোষণ ও প্রজা নিপীড়ন দেখেছেন। গ্রামের হিন্দু মুসলমানদের সম্মিলিত সামাজিক আবহে তিনি দীক্ষা পান অসম্প্রদায়িকতার। আর পড়শি দরিদ্র মানুষের দুঃখ, কষ্ট তাকে সারাজীবন সাধারণ দুঃখী মানুষের প্রতি ভালবাসায় সিক্ত করে তোলে। বস্তুতপক্ষে সমাজ ও পরিবেশ তাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম করতে শিখিয়েছে। তাই পরবর্তী জীবনে তিনি কোনো শক্তির কাছে সে যত বড়ই হোক আত্মসমর্পণ করেননি; মাথানত করেননি।

টুঙ্গিপাড়ার সেই দুরন্ত কিশোর শেখ মুজিবের নাম শুধু টুঙ্গিপাড়ায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। তার নাম ছড়িয়ে গেছে সারা বাংলায়, সারাবিশ্বে। পরিণত বয়সে তিনি হয়ে উঠেছিলেন শোষিত, বঞ্চিত, গণমানুষের নেতা, স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা। তার সঠিক নেতৃত্বে এবং আহ্বানের কারণেই একাত্তরে বাংলার দামাল ছেলেরা স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপ দেয়, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশ একটি পতাকা ও একটি মানচিত্র নিয়ে গর্ব করার সুযোগ পায়। তার অশেষ অবদান এবং আত্মত্যাগের জন্যই তিনি আজ আমাদের কাছে জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার মহান স্থপতি।

(লেখা নিউজনেক্সটবিডি ডটকম থেকে সংগৃহীত)