Loading..

মুজিব শতবর্ষ

২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০৭:৪৪ অপরাহ্ণ

বাঙালির বঙ্গবন্ধু চেতনায় ও দর্শনে ছিলেন বিশ্ব মানবতার পরম বন্ধু।
বিশ্ববন্ধু বঙ্গবন্ধু
বাঙালির বঙ্গবন্ধু চেতনায় ও দর্শনে ছিলেন বিশ্ব মানবতার পরম বন্ধু। সে কারণেই তাঁকে বলা হয় বিশ্ববন্ধু। এই অক্ষয় ভালোবাসার কথা বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে সেদিন হৃদয়গ্রাহী এক ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন
বাংলার কাদামাটি থেকে উঠে আসা বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যখন প্রথমবারের মতো দরাজ গলায় বাংলায় তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণটি শুরু করেন, তখন যেন বাঙালির ইতিহাসের আরেকটি দরজা খুলে গেল। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই বাংলা ভাষার মর্যাদার প্রশ্নে ছিলেন আপসহীন। তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবেই শুরু থেকে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। জেল খাটেন। অনশনে তাঁর প্রাণ যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তাঁর মূলধারার রাজনীতিরও কেন্দ্রে ছিল বাংলা ভাষার মর্যাদার ইস্যুটি। স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাই সর্বত্র মাতৃভাষার প্রয়োগে তিনি ছিলেন অগ্রণী। তাই জাতিসংঘে তাঁর মুখ থেকেই প্রথম বাংলা ভাষা উচ্চারিত হবে—সেটাই ছিল স্বাভাবিক। বিশ্বসভায় বাংলা ভাষার এই অধিষ্ঠান তাই বাঙালির গর্বের অংশ। সেদিনও তিনি ‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/ রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে’ বিশ্ব মহাসভায় এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দার্শনিক বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণে যেমন ছিল বাঙালির দুঃখ, বেদনা, সংগ্রাম ও সম্ভাবনার কথা, তেমনি ছিল সারা বিশ্বের অবহেলিত, নির্যাতিত, সংগ্রামরত কোটি মানুষের কথা। সেদিন যেমন তিনি উদ্ভাসিত হচ্ছিলেন ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ হিসেবে, তেমনি সংযুক্ত ছিলেন সারা বিশ্বের দুঃখী মানুষের আশা-ভরসার প্রতীক হিসেবে। ‘বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ বছরের দৈনন্দিন কর্মতালিকা ও কতিপয় দলিল’ গ্রন্থে শাহরিয়ার ইকবাল (উত্তরবঙ্গ প্রকাশনী ২০০০) যে তিনটি লাইন তুলে এনেছেন (পরবর্তী সময়ে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র শুরুতে স্থান পেয়েছে), তাতেই ফুটে উঠেছে তিনি স্বভূমির মাটিতে দাঁড়িয়ে বিপুল বিশ্বের আকাশ থেকে নিঃশ্বাস নিতেন। লাইন তিনটি হচ্ছে ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ বাঙালির বঙ্গবন্ধু চেতনায় ও দর্শনে ছিলেন বিশ্ব মানবতার পরম বন্ধু। সে কারণেই তাঁকে বলা হয় বিশ্ববন্ধু।
এই অক্ষয় ভালোবাসার কথা বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে সেদিন হৃদয়গ্রাহী এক ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তিনি সে সময়ের বিশ্ব পরিস্থিতির কথা জানতেন। নতুন দেশ বাংলাদেশও যে গভীরভাবে বিভাজিত উপমহাদেশ এবং ভূ-রাজনীতির জটিল বাস্তবতা সত্ত্বেও বিশ্বশান্তি ও সমৃদ্ধির পক্ষে অবদান রাখতে পারে, সে কথাও তিনি অনুভব করতেন। এ-ও জানতেন, জাতীয় স্বার্থকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে সব রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্মানজনক সম্পর্ক বজায় রাখার বিচক্ষণ কূটনৈতিক চর্চা করতে হবে। এ-ও জানতেন, সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ পড়শি দেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন অশেষ অবদানকে স্বীকার করে নিয়েও স্বাধীন দেশের যুগোপযোগী পররাষ্ট্রনীতির মৌল নীতিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এমন সুদূরপ্রসারী কূটনৈতিক বিচক্ষণতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা এক দিনেই তাঁর মনে বাসা বাঁধেনি। নিজের রাজনৈতিক জীবনকে তিনি যেমন বাস্তবতার জারক রসে রঞ্জিত করে গড়ে তুলেছিলেন, ঠিক তেমনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরে ঘুরে আত্মস্থ করেছিলেন নিজের বিশ্ব-ভাবনা। স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও তিনি বহু দেশ সফর করেছেন। জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন, কমনওয়েলথ সম্মেলনসহ বহু আন্তর্জাতিক সমাবেশে অংশগ্রহণ করেছেন। তাই জাতিসংঘে যখন তিনি ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন পুরো বিশ্বের ভূ-রাজনীতি, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের গভীরতা—সবই তাঁর মাথায় খেলছিল। তবে সবচেয়ে বেশি করে হয়তো মনে পড়েছিল সারা বিশ্বের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর সুবিচারের আকুতি। বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির লড়াই এবং বেঁচে থাকার সংগ্রামের শিক্ষাকে তিনি সহজেই বিশ্বপর্যায়ের শান্তি ও সমৃদ্ধির আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মেলাতে পেরেছিলেন। পাশাপাশি তাত্ক্ষণিক চাওয়া-পাওয়ার গণ্ডি পেরিয়ে সুদূরপ্রসারী ভাবনা-চিন্তার সঞ্চার করেছিলেন সেদিন। শীতল যুদ্ধের কঠিন বাস্তবতায় সেদিন তিনি খুবই সতর্কতার সঙ্গে পা ফেলেছিলেন। আর তাই হৃদয়ের গহিন তল থেকে উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন—মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শান্তি একান্ত দরকার। তিনি বলেছিলেন, ‘ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত না হলে শান্তি কখনো স্থায়ী হতে পারে না।’ উপমহাদেশের শান্তির কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে এ অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ‘কারো প্রতি শত্রুতা নয়, সকলের প্রতি বন্ধুত্বের’ আহ্বানের মধ্য দিয়ে তাঁর শান্তির অন্বেষার কূটনৈতিক নির্দেশনা রেখে গেছেন।
জাতিসংঘ সনদে মানবাধিকারসহ যেসব মহান আদর্শের কথা বলা হয়েছে, সেসবের উল্লেখ করে তিনি সেদিন বলেছিলেন—এ সবই বাংলাদেশের জনগণের আদর্শ। তাই বাঙালি জাতি এমন এক বিশ্বব্যবস্থা গঠনে উৎসর্গীকৃত, ‘যে ব্যবস্থায় মানুষের শান্তি ও ন্যায়বিচার লাভের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হবে ...।’ এরপর আগামীর পৃথিবীর এগিয়ে চলার পথরেখা আঁকতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘অনাহার, দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও বুভুক্ষার তাড়নায় জর্জরিত, পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারা সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়ার শঙ্কায় শিহরিত বিভীষিকাময় জগতের দিকে আমরা এগোবো না, আমরা তাকাব এমন এক পৃথিবীর দিকে, যেখানে বিজ্ঞান ও কারিগরি জ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতির যুগে মানুষের সৃষ্টি ক্ষমতা ও বিরাট সাফল্য আমাদের জন্য এক শঙ্কামুক্ত উন্নত ভবিষ্যৎ গঠনে সক্ষম।’ আজকের ডিজিটাল পৃথিবীর দিকে তাকালে আমরা সহজেই অনুভব করতে পারি কতটা যথার্থ ছিল তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী। এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জোরেই যে ‘প্রত্যেক মানুষ সুখী ও সম্মানজনক জীবনের ন্যূনতম নিশ্চয়তা লাভ করবে’ সে আভাস দিতেও তিনি ভুল করেননি।
বিশ্ব অর্থনীতির নানা দিক নিয়েও সেদিন তিনি কথা বলেছিলেন। বাড়ন্ত মুদ্রাস্ফীতির কারণে অনেক দেশের দায় পরিশোধের ক্ষমতা সে সময় কমে গিয়েছিল, উন্নয়ন ব্যয় কাটছাঁট করতে হয়েছিল এবং সে কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গিয়ে জীবনের মানও পড়ে গিয়েছিল—এসব কথা তিনি প্রাঞ্জল ভাষায় বলেছিলেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি, নজিরবিহীন বন্যা, খাদ্যসংকট মোকাবেলায় জাতিসংঘসহ সারা বিশ্বকে এগিয়ে আসার আহ্বানও জানিয়েছিলেন সেদিন। তিনি বলেছিলেন যে একটি ন্যায়সংগত আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পরিবেশ এবং স্থিতিশীল ও ন্যায়সংগত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তোলা উচিত, যাতে সব দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থের স্বীকৃতি মেলে। অস্ত্র প্রতিযোগিতার অবসান চেয়ে তিনি বলেন, ‘একমাত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই আমরা আমাদের কষ্টার্জিত জাতীয় স্বাধীনতার ফল আস্বাদন করতে পারব এবং ক্ষুধা, রোগশোক, অশিক্ষা ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য আমাদের সকল সম্পদ ও শক্তি নিয়োগ করতে সক্ষম হবো।’ জাতিসংঘই যে মানুষের ভবিষ্যৎ আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রস্থল সে কথাটি মনে করিয়ে দিতে তিনি দ্বিধা করেননি। সবশেষে তিনি বলেন, ‘আমি মানুষের অসাধ্য সাধন ও দুরূহ বাধা অতিক্রমের অদম্য শক্তির প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থার কথা আবার ঘোষণা করতে চাই।’ এই আদর্শের বিশ্বাসেই নতুন করে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলোকে বাঁচিয়ে রাখবে বলে তিনি তাঁর স্বপ্নের কথা বলেন। এ পথে চলা খুব কষ্টকর হবে। তবু তিনি বলেন, ‘... আমাদের ধ্বংস নাই। এই জীবনযুদ্ধে মোকাবেলায় জনগণের প্রতিরোধ ক্ষমতা ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞাই শেষ কথা। আত্মনির্ভরশীলতাই আমাদের লক্ষ্য। জনগণের ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগই আমাদের নির্ধারিত কর্মধারা।’
বঙ্গবন্ধুর এই কালজয়ী ভাষণে প্রস্ফুটিত প্রতিটি শব্দ ও প্রতিটি স্বপ্নই হোক আমাদের আগামীর পথচলার কাঙ্ক্ষিত দিকনির্দেশনা। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই এগিয়ে চলুক তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুকন্যার হাত ধরে—সেই প্রত্যাশাই করছি।
(Collected from BONGOBONDHU ONLINE ARCHIVE)

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি