Loading..

মুজিব শতবর্ষ

১২ অক্টোবর, ২০২০ ০৫:০৩ অপরাহ্ণ

#### বঙ্গবন্ধুর গবেষণা ভাবনা ও দর্শন..................

বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা নিয়ে সব সময় ভেবেছেন। এ ভাবনার মধ্যে মৌলিকত্ব ছিল, নতুন চিন্তাশীলতা ছিল। দেশে মেধাচর্চাকে এগিয়ে নেয়ার ব্রত ছিল। মানুষকে জীবনসম্পৃক্ত স্বশিক্ষায় প্রভাবিত করার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে শিক্ষিত করার কৌশল ছিল।

কেবল ভাবনার মধ্যে শিক্ষা ও গবেষণার দর্শনতত্ত্ব সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং সেখানে আধুনিক ও অগ্রসরমান চিন্তাধারার প্রতিফলন ছিল। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ও গবেষণার ভাবনায় শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মধ্যে মানবিক ও নৈতিক সম্পর্কের সমীকরণগত মনস্তত্ত্বের প্রভাব ছিল।

শিক্ষার সর্বজনীনতার মাধ্যমে মানুষের উদ্ভাবনী শক্তিকে ব্যবহার করে ভেতরের চিন্তাবোধ ও কল্পনাশক্তিকে বের করে আনার গভীর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণার সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে দেশের দায়বদ্ধতার যোগসূত্র তৈরি করে দেশপ্রেমের মূল্যবোধকে জাগ্রত করতে পেরেছেন।

শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য অর্জনে শিক্ষার সঙ্গে গবেষণার বন্ধন সৃষ্টি করা দরকার বলে বঙ্গবন্ধু মনে করতেন। এ বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে তিনি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে শিক্ষা ও গবেষণা চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের সে দেশে পাঠিয়ে তাদের অর্জিত জ্ঞান ও গবেষণার অভিজ্ঞতাকে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করেছেন, যার সুফল আজও আমাদের দেশ পাচ্ছে।

পরমাণু গবেষণার মাধ্যমে দেশ যাতে উপকৃত হয়, সেটি বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে ভেবেছেন। শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে উন্নত গবেষণার ভাবনাকে প্রাধান্য দিয়ে তিনি সোনার বাংলা গড়ার বিশ্বাসকে ধারণ করেছেন। গবেষণায় গর্ব করার মতো অবকাঠামো গড়ে তুলেছেন। কারণ তিনি জানতেন, আমাদের মেধাবী তরুণদের গবেষণায় সম্পৃক্ত করতে পারলে যে কোনো অসাধ্যকে জয় করা সম্ভব।

আমাদের মেধা ও সম্পদ ব্যবহার করে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পরমাণু গবেষণা থেকে পরমাণু চুল্লি নির্মাণ করেছে, তা বঙ্গবন্ধু ভুলে যাননি; কিন্তু গবেষণার অবকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পাকিস্তানি জান্তারা আমাদের দেশকে বঞ্চিত করেছে। এ বঞ্চনা, শোষণ ও অবহেলার কথা বঙ্গবন্ধু মনে রেখেছেন।

এ প্রেক্ষাপটে তিনি আত্মশক্তি ও স্বনির্ভরতা অর্জনের মানসিক শক্তিকে ধারণ করে বিজ্ঞান গবেষণার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন গঠন করেন। তবে পরমাণু শক্তি কমিশন গঠন করার আগে বঙ্গবন্ধু গবেষণামনস্ক দক্ষ জনগোষ্ঠী গঠনের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু মেধাবী ও গবেষণামনস্ক কয়েকজন বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীকে ভারতের ভাবা পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গবেষণার উদ্দেশে পাঠান। পরবর্তী সময়ে তাদের অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে তিনি বাংলাদেশে পরমাণু গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করেন।

সেসময় আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন এম ইন্নাস আলী। বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়ার উৎসাহ ও আগ্রহে এবং বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতা ও গভীর দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সাভারে ২৬৫ একর জমি পরমাণু গবেষণার জন্য বরাদ্দ প্রদান করা হয়।

পরবর্তী সময়ে সেখানে দেশের বৃহত্তর পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশে পরমাণু গবেষণার নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। বঙ্গবন্ধুর গবেষণাসমৃদ্ধ এ স্বপ্ন ও বিশ্বাসের মূল্যবোধ ও দর্শনকে ধারণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে চলেছে।

দেশ গড়তে শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে গবেষণার বিকল্প যে নেই, তা বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন। গবেষণা যে একটি দেশের মূল শক্তি হিসেবে কাজ করে, তা বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও ভাবনায় প্রভাব ফেলেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে মানবিক গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভর গবেষণার যে নিবিড় মেলবন্ধন দরকার, তা বঙ্গবন্ধু আমাদের শিখিয়েছেন। বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষির উন্নয়নে গবেষণার বিকল্প যে আর কিছু হতে পারে না, তা বঙ্গবন্ধুর গবেষণামনস্ক পরিকল্পনা ও চিন্তাধারায় প্রতিফলন ঘটেছে।

কৃষির প্রতি বঙ্গবন্ধুর কতটা টান ছিল, তা একটি ঘটনা থেকেই ধারণা করা যায়। ১৯৭৪ সালে ফার্মগেটের খামারবাড়িতে পাঁচতারকা হোটেল তৈরির সব ধরনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকেও খামারের এ জমিতে হোটেল নির্মাণের অনুমোদন প্রদান করা হয়েছিল। কাজী এম বদরুদ্দোজা বিষয়টি জানতে পেয়ে ছুটে গেলেন প্রাণের মানুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে।

তিনি অনেকটা অভিমান নিয়ে বললেন, কৃষি গবেষণার জমিতে হোটেল বানানোটা তিনি মানতে পারছেন না। বঙ্গবন্ধু এর কারণ জানতে চাইলেন। কাজী বদরুদ্দোজা বললেন, ‘এটা হলে কৃষির মস্ত বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। এ জমিতে হতে হবে কৃষি গবেষণার জন্য প্রশাসনিক সমন্বয়ের প্রধান কার্যালয়।’

বঙ্গবন্ধু কথাটা শুনে আনন্দিত হলেন। এমন একটা আবেদনের অপেক্ষায় তিনি যেন বসেছিলেন। কৃষির গবেষণা বলে কথা। কাজী বদরুদ্দোজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তুই ঠিক কী চাস, আমার কাছে লিখে নিয়ে আয়।’ বঙ্গবন্ধুর সহকারীর কক্ষে গিয়ে কাজী বদরুদ্দোজা ‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল’-এর গঠন কাঠামো ও কার্যপরিধি এবং এর প্রস্তাব লিখে নিয়ে এলেন।

বঙ্গবন্ধু প্রসন্নচিত্তে তাতেই স্বাক্ষর করে অনুমোদন দিয়ে দিলেন। মুহূর্ত্বেই জন্ম নিল বাংলাদেশের কৃষিবিষয়ক সব সংস্থার সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল’। গবেষণার ধারণাকে প্রাধান্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘খাদ্য বলতে শুধু ধান, চাল, আটা, ময়দা আর ভুট্টাকে বোঝায় না; বরং মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শাকসবজি এসবকে বোঝায়।’

এর মাধ্যমে তিনি গবেষকদের কৃষির উন্নয়নে সুষম ও সমন্বিত খাদ্য গবেষণার নতুন ধারণা দ্বারা প্রভাবিত করেছেন। খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিকে গবেষণার উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করে তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণায় নিজেদের আত্মনিয়োগে প্রেরণা জুগিয়েছেন। কৃষি গবেষণার মাধ্যমে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনে তিনি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনসহ অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন। এগুলো তৈরির পেছনে বঙ্গবন্ধুর গবেষণার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের দর্শন ও চিন্তা কাজ করেছে।

দেশে ধান গবেষণার গুরুত্ব অনুধাবন করেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে আইন পাসের মাধ্যমে ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন এবং ধানের ওপর নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা তখন থেকেই শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর গবেষণার ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গবেষকরা ১৯৭৫ সালে বিনাশাইল, ইরাটম ২৪ এবং ইরাটম ৩৮সহ নতুন নতুন জাতের ধানের উদ্ভাবন করেন।

এর আগে ১৯৭৪ সালে গমের উচ্চফলনশীল জাতের নতুন নতুন গম উদ্ভাবনে বিজ্ঞানীরা সফল হন। এর মধ্যে সোনালিকা জাতটি এদেশে গম উৎপাদনে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। তুলার ৩টি উন্নতমানের জাত বঙ্গবন্ধুর সময়েই উদ্ভাবিত হয়। বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনার মাধ্যমে নতুন নতুন জাতের খাদ্যশস্য উদ্ভাবনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তা আজও গবেষকদের অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করছে।

বঙ্গবন্ধু পাটের সম্ভাবনা নিয়ে যেভাবে ভেবেছেন, তা বিশ্বের আর কেউ সেসময়ে ভাবতে পারেনি। এ ভাবনাটি ছিল বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তি থেকে উত্থিত গবেষণা ভাবনা। সে ভাবনা যে কতটা বাস্তবসম্মত ছিল, তা এখন আমরা বুঝতে পারছি। বর্তমানে পাটের ফাইবার বা আঁশ নিয়ে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে গবেষণা অব্যাহত রয়েছে।

পাটের ফাইবার ব্যবহার করে কম্পোজিট ম্যাটেরিয়ালসহ নানা গবেষণালব্ধ উপাদান পৃথিবীর প্রযুক্তির অগ্রযাত্রায় মুখ্য ভূমিকা রেখে চলেছে। বঙ্গবন্ধু দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে গবেষণাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি রফতানিমুখী শিল্পধারণা সৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর গবেষণা ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সেসময়ে ড. কুদরাত-ই-খুদাসহ অন্য গবেষকরা দেশীয় উপাদানগুলোকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে নতুন ধারার গবেষণা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে এ কুদরাত-ই-খুদার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু গবেষণামনস্ক ও উন্নত ধারণা দ্বারা প্রভাবিত শিক্ষানীতি প্রণয়নে উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

বঙ্গবন্ধু সব সময় বিশ্বাস করতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শুধু শিক্ষাদানের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখবেন না; বরং গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা রাখবেন। এর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কর্মমুখী শিক্ষার উন্নয়নে গবেষণার ধারণাকে প্রাধান্য দিয়ে কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করেছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেবল সফল রাজনীতিবিদ ছিলেন না; বরং বহুমাত্রিক নতুন ধারণা উদ্ভাবনের মাধ্যমে সর্বজনীন দর্শন ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মূল শক্তিও ছিলেন। তিনি নিজে বিজ্ঞানী না হলেও বিজ্ঞান ও গবেষণার নতুন ধারণা সৃষ্টিতে যেমন নিজের ভাবনাকে কাজে লাগিয়েছেন, তেমনি তার গবেষণার ভাবনা দ্বারা মানুষকে তাড়িত করে নতুন নতুন গবেষক তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর এ গবেষণা দর্শনকে ধারণ করে যদি আমরা নিজেদের গড়ে তুলতে পারি, তবেই দেশ এগিয়ে যাবে।

Copied from.......

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
যুগান্তর, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, লিঙ্ক

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি