Loading..

প্রকাশনা

১৭ অক্টোবর, ২০২০ ১২:৩৭ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষক নেতৃত্বের দক্ষতা উন্নয়ন

শিক্ষক নেতৃত্বের দক্ষতা উন্নয়ন

 

একজন শিক্ষক বিদ্যালয়ে একজন নেতা হিসেবে আবির্ভূত। তিনি বিদ্যালয় তথা সমাজে নানাবিধ ভূমিকা পালন করে থাকেন। এটা প্রথাগত (Traditional)। কর্তব্য বা পেশার খাতিরে তাকে এসব করতে হলেও বর্তমান তথ্য প্রযুক্তি উৎকর্ষতার যুগে তাকে প্রথাগত নেতৃত্বের পাশাপাশি নতুন অগ্রসরমান চিন্তা চেতনার প্রতিফলন ঘটিয়ে সমাজের আলোকবর্তিকা (Luminaire) হিসেবে অবতীর্ণ হতে হবে।

 

আমরা উন্নত দেশগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলে তাদের অগ্রগতির মূল কারণ হিসেবে দেখতে পাই জনসাধারণের নীতিবোধ ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা। আমাদের দেশে দুনীর্তি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। এর বিষবৃক্ষ মহীরুহ আকার ধারণ করেছে। সমাজ আজ কলুষিত। নৈতিক শিক্ষার অভাববোধ থেকেই এ অবস্থার সৃষ্টি। শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর" এ কথাটির যথার্থতা প্রমান করতে হলে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং নীতিবান একটি আদর্শ শিক্ষক সমাজ গড়ে তোলা প্রয়োজন। আমরা জানি, শিক্ষক আদর্শ। শিক্ষক একজন নেতা, শিক্ষার্থীরা তার অনুসারী। শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে, শ্রেণিকক্ষের বাহিরে, এমনকি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনেও কিরূপ আচরণ করে থাকেন এবং কোন পন্থা অবলম্বন করেন তা শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক কখনও কখনও রাজনৈতিক জীবনেও প্রভাব বিস্তার করে থাকে। একটি পরিচ্ছন্ন আদর্শ সমাজ বিনির্মানের প্রধান নিয়ামক দেশের যুব সমাজকে গড়ে তুলতে হলে সর্ব প্রথমে নৈতিক শিক্ষা বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষক সমাজকে গড়ে তুলতে হবে। এটা সম্ভব। যখন একদল আনকোড়া যুবককে দক্ষ ও কঠোর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সামরিক বাহিনীতে চৌকস সদস্য হিসেবে গড়ে তোলা যায় তখন শিক্ষিত ও অন্য গুনে গুনান্বিত শিক্ষকদিগকেও আত্নপ্রত্যয়ী ও নীতিবান করে তুলতে নৈতিক প্রশিক্ষণের উপর গুরুত্ব আরোপ করা যেতে পারে।

 

শিক্ষকদের বিদ্যালয় নেতৃত্বের গুনাবলীর বিভিন্ন স্তর রয়েছে। এর মধ্যে কিছু তারা শিক্ষার মাধ্যমে অর্জন করে থাকেন। আর কিছু তাদের ব্যক্তিত্বের অংশ। মহৎ শিক্ষকগণ অর্জিত এবং নিজস্ব গুনাবলীর এক অপূর্ব সমন্বয় সাধন করেন যা শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সহকর্মী ও সমাজ কর্তৃক সম্মানীত হয়। তারা এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু কর্ম সম্পাদন করতে পারেন যার ফলে সমাজে নৈতিকতার উৎকর্ষ সাধন হয় এবং এর মাধ্যমে তাদের পেশা ও তাদের সংস্পর্শে থাকা মানুষের মধ্যে এক ধরণের সেতুবন্ধন তৈরী হয়।

 

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সেতুবন্ধনের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অঙ্গিকার। এ অঙ্গিকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের প্রতি উভয়ের। শিক্ষক স্নেহ ভালোবাসা ও আন্তরিকতা দিয়ে শিক্ষার্থীর সহিত সম্পর্ক স্থাপন করে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করবেন এটাই হলো তার অঙ্গিকার। তারা তাদের সর্বোত্তম অবস্থা ও জ্ঞান ব্যবহার করে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে পাঠদানে উৎসর্গীকৃত থাকবেন। তারা হোমভিজিটের মাধ্যমে শিখনক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সমস্যাসমূহ নিয়ে অভিভাবকদের সাথে এককভাবে আলোচনা করবেন এবং সমাধানের কৌশলসমূহ নির্ধারণ করবেন। একজন উত্তম শিক্ষক হওয়ার জন্য একটি সুষ্ঠু পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সুন্দর শিখন শৈলীর মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে উত্তম পাঠদানের প্রয়োজনে সহকর্মীদের সহযোগিতা নিবেন।

 

মহৎ শিক্ষকগণ সহযোগী শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ গুণগত শিক্ষার সুযোগ দিতে শুধু প্রতিষ্ঠানের সহিত আষ্টেপিষ্ঠে জড়িয়েই থাকেন না, তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধও থাকেন। শিক্ষার্থীদের শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতকল্পে নিজেকে আজীবন শিক্ষানবিশ হওয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধও থাকেন। একজন শিক্ষক শিক্ষানবিশ হিসেবে জ্ঞানের বিভিন্ন উৎস থেকে শিখতে পারেন। অনুশীলন থেকে (Exercise), ভুল করে (Trial and Error Method), শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে, অন্যান্য শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসকদের কাছ থেকেও শেখার সুযোগ রয়েছে। শিক্ষার সুযোগ শুধু শ্রেণিকক্ষেই নয়, বিদ্যালয়ের আশেপাশেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। প্রতিটি নতুন শিক্ষার্থী এক একটি চ্যালেঞ্জ এবং এই চ্যালেঞ্জের সাথে রয়েছে শেখার এক একটি নতুন সুযোগ। পেশাগত কর্মশালা ও সম্মেলনে অংশগ্রহণ শিক্ষকের জ্ঞান অর্জন ও দক্ষতা বিকাশের আরও একটি সুযোগ। শিক্ষক যখন শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদানকারীর পাশাপাশি অনুশীলনকারী হন তখন শিখন-শেখানো কার্যক্রমটি হয় একেবারেই আলাদা, দারুন উপভোগ্য। এটা শুধু শিক্ষক নেতৃত্বের দক্ষতা উন্নয়নের জন্যই নয়, এটা যুগের চাহিদা।

 

একজন নেতা হিসেবে শিক্ষকগণ সর্বদা তাদের শিল্প কলা চর্চা করবেন এবং তাদের পাঠদানের কৌশলসমূহ কিভাবে উন্নয়ন করা যায় তা শিখবেন। শিক্ষকগণকে তাদের সহকর্মীদের পাঠ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের শিখন শৈলী থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজের শিখন বিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞান সমৃদ্ধ করবেন। শ্রেণিকক্ষে বেশি পরিমানে শিক্ষার সুযোগ তৈরী করতে বেশি পরিমানে শিক্ষার্থীদের কথা শুনতে অভ্যস্ত হবেন। একজন শিক্ষার্থীর প্রশ্ন সম্পূর্ণ পাঠ পরিকল্পনাকে চালিত করতে পারে যা দ্বারা সমস্ত শিক্ষার্থীরা উপকৃত হতে পারে। পাঠকে শিক্ষার্থীদের নিকট সাবলীলভাবে উপস্থাপন করতে হবে। শিক্ষার্থীদেরকে পাঠের প্রতি কৌতুহলী করতে পারলে শিখন প্রক্রিয়া সহজ হয় এবং শিখনফল দীর্ঘস্থায়ী হয়।  শিক্ষকগণকে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর দানের রীতি পরিহার করে শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী উত্তর দান এবং Frequently Asked Questions (FAQs) বা সচরাচর জিজ্ঞাসা পদ্ধতি প্রয়োগ এবং শিক্ষার্থীদেরকে অভ্যস্ত করা যেতে পারে।

 

দক্ষ শিক্ষকগণ দক্ষ যোগাযোগ রক্ষাকারীও বটে। তারা শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং সহকর্মীদের সহিত সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার সর্বোত্তম পন্থাগুলো জানেন। তারা অন্যের চিন্তাধারা ও মতামত গ্রহণে অত্যন্ত দক্ষ এবং সম্মান করে থাকেন। মহান শিক্ষকগণ মহান যোগাযোগ রক্ষাকারীও বটে। তারা শিক্ষার্থী, অভিভাবক, অংশীজন, সহকর্মী ও প্রশাসকগণের সাথে যোগাযোগের সর্বোত্তম উপায়গুলি জানেন। তারা অন্যের মতামত এবং ধারণাসমূহ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করেন এবং শ্রদ্ধার সহিত গ্রহণ করে থাকেন। উত্তম যোগাযোগের মাধ্যমে সকলের সহিত উত্তম সম্পর্ক স্থাপিত হয়। বিশেষ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে উত্তম সম্পর্ক স্থাপিত হলে শিখন-শেখানো কার্য সম্পাদনে চরম উৎকর্ষতা সাধিত হয়।

 

শিক্ষকের আরও একটি পবিত্র দায়িত্ব হলো শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন। আমাদের দেশের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম অত্যন্ত সু-সংগঠিত। যার একটি আন্তর্জাতিক মানদন্ড রয়েছে। জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ইউনেস্কো’র মতে বাংলাদেশের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রমের মানদন্ড কোথাও কোথাও আন্তর্জাতিক মানদন্ড ছাপিয়ে গেছে। যাই হোক, এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের গুরুদায়িত্ব যখন শিক্ষকের উপর তখন তাকে একটি বাস্তবমূখী বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা দরকার। শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য শুধু শিখন-শেখানো কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই হয় না, থাকা দরকার শিক্ষার্থীর পাঠের অগ্রগতি পরিমাপের সর্বোত্তম ব্যবস্থা।

 

জগতের সবকিছুই পরিবর্তনশীল। শিক্ষকের ক্যারিয়ার জুড়েও অনেক পরিবর্তন ঘটতে পারে। ক্লাস প্রোফাইল বছরের পর বছর আলাদা হতে পারে। পরিবর্তিত হয় শিক্ষাক্রম, পাঠ্যবই। শ্রেণিকক্ষে ব্যবহৃত উপকরণগুলিও পরিবর্তিত হতে পারে। প্রশাসন এবং নীতিও পরিবর্তন হয়। একজন প্রগতিশীল শিক্ষক এটি জানেন এবং পরিবর্তন প্রত্যাশা করেন। তিনি পরিবর্তনগুলোকে আলিঙ্গন করেন। তারা সর্বদাই ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। আগত পরিবর্তনগুলোর সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনে অগ্রসর হন।

 

আমরা  জানি, ব্র্যাক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনষ্টিটিউট সহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করে থাকেন। ফলশ্রুতিতে তাঁদের সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার বাহাদুরের নীতি নির্ধারকগণ শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে থাকেন। কিন্তু যারা এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সাধন করে যাচ্ছেন তারা থেকে যাচ্ছেন গবেষণা কর্মকান্ডের অন্তরালে। যেহেতু শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্যাবলী শিক্ষকগণই মোকাবেলা করে থাকেন। সেহেতু শিক্ষা গবেষণা কাজে শিক্ষকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকা দরকার। এ ব্যাপারে শিক্ষা গবেষক ও শিক্ষা প্রশাসকগণ যথোপযোগী পন্থা গ্রহণ করতে পারেন।

 

পরিশেষে বলা যায়, শিক্ষকদের নেতৃত্বের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে প্রচলিত চলমান পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নের ধ্যান ধারণা থেকে বের হয়ে তথ্য-প্রযুক্তি ও নৈতিক শিক্ষার সমন্বয় সাধন করে প্রশিক্ষণ রীতির প্রচলন করা যেতে পারে। পাশাপাশি বিদ্যালয়ের সকল ক্ষেত্রে শুদ্ধাচার চর্চার প্রচলন ও পরিবীক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করাও আবশ্যক। একাডেমিক সংস্কারের পাশাপাশি প্রশাসনিক কাজেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারলে আর্থিক বিষয়াদি সর্বদা পরিচ্ছন্ন রাখা যেতে পারে। সেবা প্রদান সহজ থেকে সহজতর করাও সংস্কারের একটি অংশ। এসব বিষয়ের সমন্বয় সাধন করা গেলে অদূর ভবিষ্যতে শিক্ষক দক্ষতার উন্নয়ন ঘটবে বলে আমার বিশ্বাস। এর মাধ্যমেই আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার 4.1.1 এর সেই কাঙ্খিত দ্বার মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারব।

 

লেখক: শিক্ষক, গবেষক।

 

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি