Loading..

খবর-দার

০৯ নভেম্বর, ২০২০ ০৭:২৮ অপরাহ্ণ

মতামত: প্রায় ডিজিটাল বাংলাদেশে আপনাকে স্বাগতম

আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি এবং আমাদের দেশে অনেক কর্মকাণ্ড ডিজিটালাইজড করার মধ্য দিয়ে অসাধারণ সাফল্য পেয়েছি। তাহলে, আমাদের অ্যাম্বাসিগুলোতে এমন অদক্ষতা কেন

এটি একটি মতামত, আর অন্য অনেক মতামতের মতোই এখানে একটি অভিযোগের কথা বলা হয়েছে। অভিযোগটি, অন্য অনেক অভিযোগের মতোই শুরু হয়েছে বিদেশে অবস্থানকারী এক বাংলাদেশির (এনআরবি) নিজ দেশ ভ্রমণের আকাঙ্ক্ষা থেকে। 

ভিসা প্রক্রিয়া নিয়ে নানা অভিযোগ নতুন নয়। তবে লন্ডনে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন হয়রানির এমন সব উপায় সৃষ্টি করেছে যা নিয়ে না লিখলেই নয়। তারা যে বিশৃঙ্খল পদ্ধতিতে কাজ করছে, তা পুরোপুরি ডিজিটাল বাংলাদেশকে উপহাস করা।   

আমার আগ্নিপরীক্ষা শুরু হয়েছিল যুক্তরাজ্যের জন্য বাংলাদেশ হাইকমিশনের ওয়েবসাইট থেকে আবেদন ফরম সংগ্রহ করা থেকে। আমার যুক্তরাজ্যের পাসপোর্টে “ভিসা” অথবা “নো ভিসা” স্ট্যাম্পের প্রয়োজন ছিল। এদিকে কোভিডের কারণে অন অ্যারাইভাল ভিসাও বন্ধ। তাই আমাকে একাবিংশ শতাব্দীর সঙ্গে চলনসই নতুনভাবে তৈরি, পুরোপুরি ডিজিটাল আবেদন ফরমের দিকে যেতে হয়। 


ধাপ ১: আবেদন ফরম

অজানা কোনো কারণে, ম্যাক থেকে অনলাইনে আবেদন ফরম পূরণ করা যায় না। এটা হতে পারে এমন, যেন আমরা একটি বিবৃতি দিচ্ছি। বিবৃতিটি যেন অ্যাপলের যুগের বিরুদ্ধে। বিবৃতিটি যেন ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাপলের ঝলমলে হেডকোয়ার্টারে পণ্য সরবরাহকারী মিটমিটে আলো জ্বলা, নীরস পরিবেশের চীনা কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে।  

এরপর আবার সব ব্রাউজারে আমাদের মিশনের ওইয়েবসাইট কাজ করে না। ঠিক ব্রাউজারটি খুঁজে পেতে পেতে, আমি যেমন করেছিলাম, আপনার অনলাইন ফরমটির সর্বশেষ পেজে পৌঁছানোর আগেই ভরাডুবি হতে পারে। দুঃখিত, প্রয়োজনীয় সব দিকে মনোযোগ না দেওয়ার জন্য –সব ওয়েবসাইট সব ব্রাউজারে কাজ করবে এমন দিন চলে গেছে। এটা যেন অতীতে ফিরে যাওয়ার মতো এবং আরও গুরুতরভাবে, কীভাবে কী করতে হবে তার একটি আদেশ।   

অনলাইন ফরমটিকে “অনলাইন” বলা হয়, কারণ এটি অনলাইনে পূরণ করা হয়। বেশ যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু আপনি যখন “সাবমিট”এ চাপ দিবেন, তখন ফরমটি কোথাও যায় না--বরং আপনাকে সদ্য সম্পন্ন করা ফরমটি প্রিন্ট করতে বলা হয়। এরপর সেটিকে আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময়ে সঙ্গে করে বাংলাদেশ হাই কমিশনে নিয়ে যেতে হবে। সেই সময়টিও আপনাকে আগে থেকে ঠিক করে নিতে হবে। টাকাও অনলাইনে পরিশোধ করা যায় না এবং এটা সাবমিটে চাপ দেওয়ার পর অনলাইন ফরম পূরণ শেষ না হওয়ার কারণ হতে পারে। প্রিন্ট করা অনলাইন আবেদনের কপি ও ব্যাংক কার্ড সঙ্গে নিয়ে পুরোনো ধাঁচে সামনাসামনি কাজটি শেষ করতে হয়।     


ধাপ ২: ২৮ কুইন্স গেটে অ্যাপয়েন্টমেন্ট

সকাল ১০টা থেকে অ্যাপয়েন্ট নেওয়া শুরু হয় এবং ওয়েবসাইটে স্পষ্ট করে বলা আছে প্রত্যেক অ্যাপয়েন্টের সময় ১৫ মিনিট করে। আমি আমার অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময় পাই দুপুর সোয়া ১২টায় এবং আমার ইমেইলে কনফার্মেশনের একটি প্রিন্ট করা কপিও দরকার ছিলো। ডিজিটাল বাংলাদেশ হওয়া সত্ত্বেও আমরা হার্ডকপি ভালোবাসি।

হাইকমিশনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট প্রত্যাশীদের লাইন এতো লম্বা ছিলো যে কুইনস গেটে উল্টোদিক থেকে আরেকটি লাইন করতে হয়। লাইনে থাকা লোকজন নিজেদের বাংলাদেশ হাই কমিশনের কর্মকর্তাদের করুণার পাত্র মনে করছিলেন: অপেক্ষা, আশা, হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসটাইমে প্রিয়জনকে আশ্বস্ত করা যে, তারা বাড়ি যেতে সব দরকারি স্ট্যাম্পগুলো পেয়ে যাচ্ছেন।

মধ্যাহ্নের সময়, তখনও সেখানে সকাল সাড়ে ১০টার বাকি থাকা আবেদনকারীরা ছিলেন। তাদের কাছেও কনফার্মেশনের প্রিন্ট করা কপি ছিলো। আমি সবার ধৈর্য্য দেখে আশ্চার্য হয়েছিলাম। অ্যাপয়েন্টমেন্টের কারণ সম্পর্কে কেউ কোনো প্রশ্ন তুললো না।    

মধ্যবয়সী একজন, মনে হয় ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের, জানতে চাইলেন এই লাইন থাই অ্যাম্বাসির কিনা। এরপর বাংলাদেশ হাই কমিশনের ভেতর থেকে একজন বের হয়ে আমাদের প্রিন্ট করা কপিগুলো পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন। একসময় তিনি খুঁজে পেলেন এক এনআরবি তার অনলাইন ফরমের হার্ড কপি ছাড়াই চলে এসেছেন।ওই আবেদনকারী তার ফোনের দিকে আঙুল দিয়ে বলতে লাগলেন, “আমি ফরম অনলাইনে পূরণ করেছি।” এ নিয়ে বিতণ্ডা শুরু হলো। আইন ভঙ্গকারীর জন্য কোনো সহানুভূতি নেই। “প্রিন্টআউট, প্রিন্টআউট,” বাংলাদেশ হাই কমিশনের লোকটি চিৎকার করতে লাগলেন এবং তার হতাশায় আমার মধ্যেও সহানুভূতি জাগলো। 

মিশনের বাইরে ফুটপাথে লাইনের সবাইকে এক মিটার দূরে রাখতে চিহ্ন দেওয়া ছিলো, কিন্তু যে কোনোভাবেই হোক তা আর মানা হচ্ছিলো না। অন্তত, বেশিরভাগ বাঙালি এই কর্মীরা সযত্নে মাস্ক পরে ছিলেন।  

লাইন ধীরে ধীরে সামনের দিকে আগাচ্ছিলো এবং মাঝে-মধ্যে কেউ কেউ লাইন থেকে বের হতে অন্যদের থেকে অনুমতি নিচ্ছিলেন। এর কারণ ছিলো দু’টো: হয় বৃদ্ধরা কেউ ফুটপাথের পাশে একটু বসে বিশ্রাম নিতে চাচ্ছিলেন অথবা কেউ বলছিলেন আজ সকালে তারা প্রচুর পানি পান করে ফেলেছেন। ২৮ কুইন্স গেটে গেলে আপনি আপনার মান-সম্মানকে বাড়িতে রেখে যাবেন। 


ডিজিটাল বাংলাদেশ

ন্যায়সঙ্গতভাবে, আমি লক্ষ্য করলাম বাংলাদেশ হাই কমিশনের কর্মকর্তারা অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তারা প্রার্থনা বা অন্য কোনো কারণে কোনো বিরতি নেননি। কর্মপদ্ধতির কারণেই তাদের সঙ্গে এমন হয়। এই অভিজ্ঞতা আমাদের প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে তুলনা করতে পারি, জিডিপিতে যাদের আমরা সম্প্রতি ছাড়িয়েছি।  গত বছরে আমি ভারতের ভিসার জন্য আবেদন করেছিলাম এবং ভিসার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া অনলাইনে আবেদন করার পর থেকে দুই কার্যদিবস সময় লেগেছিলো। আবেদন করতেও ১৫ মিনিট সময় লেগেছিলো। এছাড়া আমাকে আমার ডেস্ক ছেড়ে যেতে হয়নি, অথবা ম্যাক ছাড়া অন্য কম্পিউটার খুঁজতে হয়নি।

এক দশক হয়ে গেল আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি এবং আমাদের দেশে অনেক কর্মকাণ্ড ডিজিটালাইজড করার মধ্য দিয়ে অসাধারণ সাফল্য পেয়েছি।

সুতরাং, আমাদের অ্যাম্বাসিগুলোতে এমন খারাপ অদক্ষতা কেন? আমি জানি না, এই অভিজ্ঞতা আমাদের অন্য অ্যাম্বাসিগুলোতে ভিসাপ্রার্থীদের জন্য কতোটা আলাদা।  তবে লন্ডন এক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রাধিকার পেতে পারে এবং বিশাল সংখ্যক এনআরবি বাস করার কারণে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে বিষয়টি বিবেচনা করার মতো।

ঢাকা লিট ফেস্টের একজন পরিচালক হিসেবে বছরের পর বছর ধরে আমরা লেখকদের কাছ থেকে অভিযোগের পুনরাবৃত্তি শুনে আসছি। এক সময় আমরা মনে করতাম তারা অনেক বেশি আশা করে! আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পর, আমি স্বীকার করবো, তারা তাদের যন্ত্রণা অনেক ভদ্রতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন।

অনেক ক্ষেত্রে তাদের এই যন্ত্রণা অ্যাম্বাসিতেই শেষ হয় না, বরং তাদের এবং আমরা আয়োজকদের ঢাকায় ইমিগ্রেশন পর্যন্ত তাড়া করে। ঢাকা বিমানবন্দরে হুইলচেয়ারে আবদ্ধ নোবেলজয়ী স্যার ভিএস নাইপলের প্রতি উদাসীনতা আমি কখনোই ভুলবো না। 

আমরা আমাদের অতিথেয়তার জন্য গর্ব করি এবং নিজেদের প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন ভাবি। কিন্তু বাংলাদেশ হাইকমিশনের অভিজ্ঞতা আমাদের ওই দাবির সঙ্গে  মেলে না এবং এমনকি আমাদের সমকক্ষ অন্য দেশগুলোর কাজের সঙ্গেও নয়।  

ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং ভিশন ২০২১’এর জন্য বিশ্বের কাছে আমাদের অবশ্যই একটি ভালো ভাবমূর্তি প্রকাশ করতে হবে।