Loading..

ভিডিও ক্লাস

০৬ ডিসেম্বর, ২০২০ ০৫:৪২ পূর্বাহ্ণ

ইলমে ফিকাহ এর ইতিহাস || নুরুল আমিন || BY Nidm

“প্রত্যেক জিনিসেরই একটি স্তম্ভ রয়েছে। দ্বীন ইসলামের স্তম্ভ হলো ফিকহ” [হাদীস] ইসলাম মানুষকে তার জীবন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও বুদ্ধিবৃত্তিক একটি আকীদা প্রদান করে যা তাদের সকল চিন্তা, আচরন ও কর্মকাণ্ডের মূলভিত্তি। এরূপ কোন ভিত্তি এমন একটি সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থার অস্তিত্ব দাবী করে যার প্রতিটি অংশ হবে মূল আকীদার অনুগামী ও তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অতএব, ইসলামী জ্ঞানের এমন একটি শাখার আর্বিভাব অনিবার্য ছিল যা ব্যবহারিক জীবনের এই চাহিদাকে সম্পূর্ণ করবে। “ইলমুল ফিকহ” হচ্ছে ইসলামী জ্ঞানের সেই বিশেষ শাখা। ফিকহ এর সংজ্ঞা প্রখ্যাত অভিধান বিশারদ আল্লামা আবুল ফযল জামালুদ্দীন মুহাম্মদ আল মিসরী (রহ) বলেন, العلم بالشيء والفهمُ له “ফিকহ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো, কোন কিছু সম্বন্ধে জানা ও বুঝা।” [লিসানুল আরব] ‘ফিকহ’ শব্দটি আল কুরআনে বিশ স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। (ফাতাওয়া ও মাসাইল. ১ম খন্ড, ইফাবা প্রকাশিত) যেমন, وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ “তাদের (মুমিনদের) প্রত্যেক দল থেকে একটি অংশ কেন বহির্গত হয় না যাতে তারা দ্বীন সম্বন্ধে ফিকহ হাসিল করতে পারে (লি ইয়াতাফাক্বাহু ফিদ-দ্বীন) এবং তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে যখন তারা তাদের নিকট ফিরে আসবে- যাতে তারা সতর্ক হয়”। (সূরা তওবা : ১২২) হাদীসেও এই শব্দটি বহুল ব্যবহৃত যেমন- مَنْ يُرِدْ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِ “আল্লাহ যার কল্যান চান, তাকে তিনি দ্বীনের ফিকহ (তাফাক্কুহ ফিদ-দ্বীন) দান করেন”। (বুখারী, মুসলিম) فَقِيهٌ أَشَدُّ عَلَى الشَّيْطَانِ مِنْ أَلْفِ عَابِدٍ “একজন ফকীহ শয়তানের জন্য হাজার (মূর্খ) আবেদ অপেক্ষা ভয়ংকর” (তিরমিযি) ইত্যাদি। অতএব, আভিধানিক অর্থে ‘ফিকহ’ বলতে যে কোন বিষয়ের গভীর জ্ঞানকে বোঝালেও কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে ও বিভিন্ন হাদীসে ‘ফিকহ’ বলতে সুনির্দিষ্ট ভাবে দ্বীনের গভীর জ্ঞানকেই বোঝানো হয়েছে। প্রথম যুগে ‘ফিকহ’ বলতে তাই ইসলামী জ্ঞানের বিশেষ কোন শাখাকে বোঝানো হতো না বরং সামগ্রিক ভাবে গোটা দ্বীন সম্পর্কিত গভীর জ্ঞানকে বোঝানো হতো। কিন্তু পরবর্তীতে দ্বীনের প্রতিটি শাখা স্বতন্ত্র ভাবে বিস্তৃত ও বিকশিত হতে থাকলে ‘ফিকহ’ শব্দটি কুরআন-সুন্নাহ থেকে মানুষের ব্যবহারিক জীবনের হুকুম আগরনের যে বিজ্ঞান কেবল তার জন্যই সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়। অতএব, ইসলামী শরীয়াই’র পরিভাষায় ‘ফিকহ’ হচ্ছে ইসলামী জ্ঞানের সেই বিশেষ শাখা যা শরীয়াহ’র প্রামান্য উৎস থেকে শরীয়াহ’র শাখা-প্রশাখা সম্পর্কিত বিধি বিধান আহরন বা ইস্তিম্বাত (إستنباط) করে। তাই ইমাম শাফিঈ (রহ) ফিকহের সংজ্ঞায় বলেন, العلم بالأحكام الشرعية العملية المكتسب من أدلتها التفصيلية “শরীয়াহ’র বিস্তারিত প্রামাণাদি থেকে ব্যবহারিক শরীয়াহ’র বিধি-বিধান সম্পন্ধে জ্ঞাত হওয়াকে ফিকহ বলা হয়” [আল ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু] সংক্ষেপে বলা যায় ‘ফিকহ’ হচ্ছে ইসলামী আইন কানুন এবং এ সম্পর্কিত বিজ্ঞান। এই হচ্ছে ফিকহের সংজ্ঞা। আর এ ইলমের লক্ষ্য উদ্দেশ্য যা তা হলো দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতে সাফল্য অর্জন। এ অর্থেই ইমাম আবু হানীফা (রহ) বলেছেন, معرفة النفس مالها وما عليها “ফিকহ হচ্ছে নফস এর পরিচলয় লাভ করা তথা কি কি তার অনুকূলে (কল্যাণকর) এবং কি কি তার প্রতিকূল (ক্ষতিকর) সে সম্বন্ধে জ্ঞান”। এখানে জ্ঞানীগণ নফসের অনুকূলে ও প্রতিকূলের অর্থ করেছেন “যার সাহায্যে মানুষ দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ অর্জন করে আর যার কারণে দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। [ঐ] শীর্ষস্থানীয় ইমামদের মতে এই হলো ’ফিকহ’ এর সংজ্ঞা আর এই হলো তার উদ্দেশ্য। ফিকহ এর আলোচ্য বিষয়গুলোকে নিম্নোক্ত বিভাগগুলোর অধীনে বিবেচনা করা যায়: ইবাদত : যা আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্কের নিয়ম কানুন বলে দেয়। যেমন- সালাত, সওম, হজ্জ্ব ইত্যাদি। মু'আমালাত : সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিধিবিধান। যেমন- কেনাবেচা, ঋণ, ভাড়া, আমানত, জামানত ইত্যাদি। মানাকিহাত : মানবের বংশ রক্ষা সংক্রান্ত বিধিবিধান। যেমন- বিয়ে, তালাক, ইদ্দত, অভিভাবকত্ব, উত্তরাধিকার ইত্যাদি। উকুবাত : বিভিন্ন অপরাধ। যেমন- চুরি, ব্যভিচার, হত্যা, অপবাদ ইত্যাদির শাস্তি, যেমন- মৃত্যুদন্ড, রক্তপণ ইত্যাদি। মুখাসামাত : আদালতি বিষয়ে। যেমন- অভিযোগ, বিচারবিধি, স্বাক্ষ্য প্রমাণ ইত্যাদি। হুকুমাত ও খিলাফত : শাসক নির্বাচন, বিদ্রোহ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, জিহাদ, সন্ধি, চুক্তি, কর আরোপ ইত্যাদি। ‘ফিকহ’ এর উৎপত্তি যেহেতু ‘ফিকহ’ এর মূল উৎস হচ্ছে মানুষের প্রতি শরীয়ত প্রনেতা (অর্থাৎ আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা)’র আদেশ নিষেধ সম্বলিত বাণী, অতএব তাত্ত্বিকভাবে বলা যায় যে, নবুয়্যত প্রাপ্তির পর রাসূলুল্লাহ (সা) এর মক্কী জীবন থেকেই ফিকহ এর যাত্রা শুরু। কিন্তু বস্তুতঃ, মক্কী জীবনে পবিত্র কুরআনের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ নাযিল হলেও তার খুব সামান্য অংশই ছিল বিধি বিধান সম্বলিত, এবং প্রায় সবটুকুই ছিলো দ্বীনের মৌলিক বিষয় বা আকীদা অর্থাৎ আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ব, পরকাল, জান্নান, জাহান্নাম এবং দ্বীনের প্রচার সৎগুনাবলীর বিকাশ, সামাজিক কু-প্রথাগুলোর নিন্দা ইত্যাদি বিষয়ে। আহকাম সম্পর্কিত প্রায় সমস্ত আয়াতই তাঁর (সা) মদীনায় হিজরত করার পর থেকে নাযিল হতে থাকে এবং মাদানী জীবনের দশ বছর ব্যাপী তা চলতে থাকে। অতএব, আমাদের জন্য এটা বলাই অধিকতর যথার্থ হবে যে, ফিকহের শুরু বা উৎপত্তি হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সা) এর মাদানী জীবনের শুরু থেকে অর্থাৎ প্রথম হিজরী সন হতে। [আস-শাকসিয়্যাহ আল-ইসলামিয়্যা