চার দিন আগেও এই পথ ছিল কর্মমুখর। যানজটে একাকার ছিল সড়ক। রাজধানীর মিরপুরের ব্যস্ত চিড়িয়াখানা সড়কে এখন গুমোট নিস্তব্ধতা। যে চিড়িয়াখানাকে ঘিরে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের আনাগোনা ছিল, সেখানে এখন সুনসান নীরবতা। মানুষের কোলাহল নেই। আবার করোনার ঊর্ধ্বগতি, আবার লকডাউন। আবার নিভৃত যাপনে চিড়িয়াখানার প্রাণীরা।

গত শুক্রবার রাজধানীর বড় বিনোদন কেন্দ্র চিড়িয়াখানায় গিয়ে দেখা গেছে, আগের সেই চিরচেনা পরিবেশ বদলে গেছে। যানবাহন নেই। নেই হকারের হাঁকডাক। দোকানপাট বন্ধ। সবুজ-শ্যামল পরিবেশে পাখির কিচিরমিচির ডাকে মুখর পুরো এলাকা। সড়ক পেরিয়ে চিড়িয়াখানায় প্রবেশ করতেই ভিন্ন এক পরিবেশ। করোনাভাইরাস মানুষের বিনোদনের সুযোগ কেড়ে নিলেও নতুন করে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছে প্রাণীরা। সংসার বাড়ছে তাদের। কিছু প্রাণীর ঘরে এসেছে নতুন অতিথি। এখনও অন্তঃসত্ত্বা কিছু প্রাণী।

জনমানবহীন চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখা যায়, পাখিদের কলতানে মুখর পুরো এলাকা। গাছে গাছে ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা প্রাণী। খাঁচার প্রাণীরাও আছে ফুরফুরে মেজাজে। বেশ রাজকীয়ভাব নিয়ে চলাফেরা করছে জিরাফ। জলহস্তীর বাচ্চা পানিতে ডুব দিয়ে মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছিল। অবসর এই সময়ে রাজা বাহাদুর আর সুন্দরী ফুটবল খেলাটাও বেশ ভালোই রপ্ত করেছে। রাজা বাহাদুর আর সুন্দরী হলো হাতি। লকডাউনের বন্ধের সময় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ তাদের প্রায়ই শরীরচর্চার জন্য বাইরে ঘোরাঘুরি করতে নিয়ে যায়। চিড়িয়াখানায় বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় চারশ হরিণ রয়েছে। এই প্রাণী একটু নিরিবিলি পছন্দ করে। লকডাউনের সময় এগুলো খাঁচার কাছাকাছি চলে এসেছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে দলবেঁধে। যেসব প্রাণী গুটিসুটি মেরে আছে, তাদের চাঙ্গা রাখতে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের চেষ্টার শেষ নেই। কিছুক্ষণ পরপর কর্মীরা এই প্রাণীদের গিয়ে ডাকাডাকি করেন। চিড়িয়াখানা বন্ধ থাকলেও এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোনো ছুটি নেই, মহামারির এই সময়ে নেই কোনো বাড়তি সুযোগ-সুবিধা। প্রাণীদের পছন্দমাফিক খাবার দিতে হচ্ছে নিয়মমতো। অন্যান্য যত্নআত্তি তো আছেই।

জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক আবদুল লতিফ জানান, মহামারির সময়টায় বিভিন্ন প্রাণীর ১২০টি শাবকের জন্ম হয়েছে, যার মধ্যে পাঁচটি জন্মেছে সম্প্র্রতি। গত ৪ ফেব্রুয়ারি এবং ১১ মার্চ একটি করে ঘোড়া, ২ মার্চ একটি জলহস্তী, ৫ মার্চ এবং এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে দুটি জেব্রা শাবক জন্ম নিয়েছে। এ ছাড়া প্রতি সপ্তাহে ২-৩টি হরিণ জন্ম নিচ্ছে।

তিনি বলেন, চিড়িয়াখানা বন্ধ থাকায় পশুপাখির উপকার হয়েছে, ইমিউনিটি বেড়েছে। খাবার ভালো দিতে পেরেছি, পরিচর্যা ভালো হয়েছে। ওই সময় প্রাণীরা গর্ভধারণ করায় এখন তারা সন্তান প্রসব করছে।

গত বছর একটি জিরাফ, দুটি জলহস্তী, ১৮টি চিত্রা হরিণ, একটি মায়া হরিণ, একটি ঘোড়া, দুটি ইম্পালা, দুটি গাধা, একটি কমন ইল্যান্ড, ২৩টি ময়ূর, ১৩টি ইমু, ৩০টি বক, সাতটি ঘুঘু, ১৫টি কবুতরসহ ১১৬টি শাবক জন্ম নেয়। মিরপুরে ১৮৬ একরের চিড়িয়াখানায় নতুন-পুরোনো মিলিয়ে এখন দুই হাজার ৮২১টি প্রাণী রয়েছে। করোনাকালে চিড়িয়াখানার প্রাণীগুলোকে সুস্থ রাখতে প্রতিটি কর্মী নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি।

অনেক শাবক জন্মালেও মহামারির কারণে বাইরে থেকে নতুন প্রাণী আনা সম্ভব হয়নি বলে জানান চিড়িয়াখানার পরিচালক। তিনি বলেন, কভিডের কারণে ২ কোটি টাকার দরপত্র বাতিল করে দিতে হয়েছে।

চিড়িয়াখানার তথ্য কর্মকর্তা ডা. ওয়ালিউর রহমান বলেন, গাছগাছালিঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশে চিড়িয়াখানাটি থাকলেও এতদিন লোকজনের কোলাহলে কার্যত নিভৃত যাপনের সুযোগ পেত না বন্যপ্রাণীরা। ফলে স্বাভাবিক প্রজনন ব্যাহত হতো। করোনায় বন্ধ থাকায় চিড়িয়াখানায় নিজেদের মতো সময় কাটাচ্ছে বন্যপ্রাণী, পাখি ও সরীসৃপরা।

বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করলে গত বছর ২০ মার্চ বন্ধ করে দেওয়া হয় জাতীয় চিড়িয়াখানা। সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলে ১ নভেম্বর শর্তসাপেক্ষে দর্শনার্থীদের জন্য আবার খুলে দেওয়া হয়। তবে গত ২ এপ্রিল থেকে আবার দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভেতরের উন্নয়ন কাজসহ চলছে অন্যান্য রুটিন মাফিক কাজ। ঘষামাজা চলছে। সিঙ্গাপুরের চিড়িয়াখানার আদলে জাতীয় চিড়িয়াখানাকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।

জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক আবদুল লতিফ বলেন, বাঘের খাঁচাকেন্দ্রিক কানেক্টিং রোড, উটপাখিকেন্দ্রিক চারপাশে সড়ক, পশ্চিম-উত্তর কর্নারে লেকের মধ্য দিয়ে গাইড ওয়াল, জলহস্তী ও বানরের খাঁচার আশপাশে সড়কের কাজ চলছে। চিড়িয়াখানার সামনে বাসস্ট্যান্ড সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। রঙিন বাতি দেওয়া হয়েছে। দুটি আধুনিক মানের অজুখানা করা হয়েছে। গেট ডিজিটাল করা হয়েছে। পার্কিং সাইট আলোকিত করা হয়েছে।
সূত্র দৈনিক সমকাল