প্রধান শিক্ষক
০৭ মে, ২০২১ ০৯:৪০ পূর্বাহ্ণ
কোরআন ও হাদিসের আলোকে “যাকাতুল ফিতর”/”সাদাকাতুল ফিতর”
কোরআন ও হাদিসের আলোকে “যাকাতুল ফিতর”/”সাদাকাতুল
ফিতর”
‘ইসলাম’’ অর্থ আত্মসমর্পণ করা। আত্মসমর্পণ করা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল প্রদত্ত বিধি-বিধানের সামনে। তাই ইসলামের যে বিষয়ের সমাধান কুরআন বা সুন্নতে বর্তমান সে বিধানের সামনে আত্মসমর্পণ করা এবং তা মেনে নেয়াই হচ্ছে একজন প্রকৃত মুসলিমের বৈশিষ্ট্য ও কর্তব্য।
আল্লাহ বলেন:
“(আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোন মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন কোন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে না। কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে অমান্য করলে সে তো স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে।)” [ সূরা আহযাব/৩৬]
“ফিতরা”
ফিতরাকে শরীয়তে ‘যাকাতুল ফিতর এবং সাদাকাতুল ফিতর’ বলা হয়েছে। অর্থাৎ ফিতরের যাকাত বা ফিতরের সদকা। ফিতর বা ফাতূর বলা হয় সেই আহারকে যা দ্বারা রোযাদার রোযা ভঙ্গ করে।
ফিতরা দেয়ার সামর্থ্য রাখে এরকম প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজের ও পরিবারের ঐ সমস্ত সদস্যদের পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ফরয যাদের লালন-পালনের দায়িত্ব শরীয়ত কর্তৃক তার উপরে অর্পিত হয়েছে। [ বুখারী হাদীস নং ১৫০৩]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে কি দ্বারা এবং কি পরিমাণ ফিতরা দেওয়া হত?
বুখারী শরীফে ইবনে উমর (রাযিঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন: ‘‘আল্লাহর রাসূল যাকাতুল ফিতর স্বরূপ এক সা খেজুর কিংবা এক সা যব ফরয করেছেন মুসলিম দাস ও স্বাধীন, পুরুষ ও নারী এবং ছোট ও বড়র প্রতি। আর তা লোকদের নামাযে বের হওয়ার পূর্বে আদায় করে দিতে আদেশ করেছেন’’। [বুখারী, অধ্যায়: যাকাত হাদীস নং ১৫০৩/ মুসলিম নং ২২৭৫]
উক্ত হাদীসে দুটি খাদ্য দ্রব্যের নাম পাওয়া গেল যা, দ্বারা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর যুগে ফিতরা দেওয়া হত। একটি হচ্ছে খেজুর অপরটি যব। এবার নিম্নে আর একটি হাদীস পাঠ করুন।
আবু সাঈদ খুদরী (রাযিঃ) বলেন: “আমরা-নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে যাকাতুল ফিতর বের করতাম এক সা খাদ্য দ্রব্য কিংবা এক সা যব কিংবা এক সা খেজুর কিংবা এক সা পনীর কিংবা এক সা কিশমিশ।” [ বুখারী- ১৫০৬ মুসলিম-২২৮১]
এই হাদীসে খেজুর ও যব ছাড়া আরও যে কয়েকটি বস্তুর নাম পাওয়া গেল তা হল: কিশমিশ, পনীর এবং খাদ্য দ্রব্য। উল্লেখ থাকে যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর বিগত হওয়ার পরে মুআবীয়া (রাযিঃ) এর খেলাফতে অনেকে গম দ্বারাও ফিতরা দিতেন। [ বুখারী হাদীস নং ১৫০৮ মুসলিম ২২৮১ ]
প্রমাণিত হল যে, নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর যুগে যে সব দ্রব্যাদি দ্বারা ফিতরা দেওয়া হয়েছিল তা হল, খেজুর, যব, কিশমিশ, পনীর এবং খাদ্য দ্রব্য। এবং এটাও প্রমাণিত হল যে ফিতরার পরিমাণ ছিল এক সা। যদি নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খাদ্য দ্রব্য শব্দটি না বলতেন তো আমাদের প্রতি খেজুর, যব, কিশমিশ এবং পনীর দ্বারাই ফিতরা দেওয়া নির্ধারিত হত। কিন্ত খাদ্য দ্রব্য শব্দটি উল্লেখ হয়েছে বলেই উপরোল্লিখিত দ্রব্যাদি যাদের খাবার নয় তারাও নিজ খাবার দ্বারা ফিতরাআদায় করতে পারবেন।
সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রাযিঃ) বলেছেন:
“আমরা খাদ্য দ্রব্যের মধ্য হতে এক সা যাকাতুল ফিত্ র বের করতাম। সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী আরও বলেন: ‘‘সে কালে আমাদের খাদ্য দ্রব্য ছিল: যব, কিশমিশ, পনীর এবং খেজুর”। [ বুখারী, অধ্যায়: যাকাত নং ১৫১০]
এই হাদীসটির পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেখার প্রয়োজন আছে যে, এ যুগে আমাদের সাধারণ খাদ্য কি? সাধারণত: আমাদের খাদ্য ভাত কিংবা রুটি তাই আমাদেরকে চাল কিংবা গম দ্বারা ফিতরা দেওয়া দরকার। কারণ বর্তমানে এটাই আমাদের খাবার এবং আমাদের দেশের ফকীর মিসকিনদেরও খাবার।
আল্লাহ বলেন:
“তোমরা খাদ্যের খবিস (নিকৃষ্ট) অংশ দ্বারা আল্লাহর পথে খরচ করার সংকল্প করিও না। অথচ তোমরা স্বয়ং উহা গ্রহণ করিতে প্রস্তুত নও।” [বাক্বারাহ – ২৬৭]
আল্লাহর বলেন;
“তোমরা যা ভালবাস, তা হতে ব্যয় না করা পর্যন্ত তোমরা কখনই কল্যাণ লাভ করতে পারবে না” [আল ইমরান – ৯২]
খাদ্য দ্রব্য দ্বারা ফিতরা না দিয়ে টাকা-পয়সা দ্বারা ফিতরা দেওয়া:
প্রত্যেক মুসলিম ভাইকে জানা দরকার যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে মুদ্রা হিসেবে দীনার এবং দিরহামের প্রচলন ছিল। এবং সে কালেও ফকীর ও মিসকিনদের তা প্রয়োজন হত। তা দ্বারা তারা জিনিস-পত্র ক্রয়-বিক্রয় করত। তা সত্ত্বেও নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুদ্রা দ্বারা ফিতরা নির্ধারণ না করে খাদ্য দ্রব্য দ্বারা নির্ধারণ করেছেন। তাই উপরে হাদীসে বর্ণিত খাদ্য বস্তু দ্বারাই ফিতরা আদায় করা সুন্নত। আর এটাই অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মত। কারণ বর্ণিত খাদ্য বস্তুর বদলে মূল্য তথা টাকা-পয়সা দ্বারা ফিতরা দিলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদেশকে উপেক্ষা করা হয়।
যারা মূল্য দ্বারা ফিতরা দেয় তাদের সম্পর্কে ইমাম আহমদ (রহঃ) কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নতের বরখেলাফ হওয়ার কারণে আমার আশংকা হচ্ছে যে, তা যথেষ্ট হবে না। [মুগনী, ইবনু কুদামাহ, ৪/২৯৫]
অর্ধ সা’ র ফিতরা:
উপরে বর্ণিত প্রমাণগুলি দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক সা পরিমাণ ফিতরা জরুরী করেছেন। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং চার খলীফার ইন্তেকালের পর যখন মুআবিয়া (রাযিঃ) ইসলামী রাষ্ট্রের খলীফা নির্বাচিত হন এবং ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী মদীনা হতে দামেস্ক স্থানান্তরিত হয়, তখন তারা গমের সাথে পরিচিতি লাভ করেন। সে কালে সিরিয়ার এই গমের মূল্য খেজুরের দ্বিগুণ ছিল। তাই খলীফা মুয়াবিয়া একদা হজ্জ বা উমরা করার সময় মদীনায় আসলে মিম্বরে বলেন: আমি অর্ধ সা গমকে এক সা খেজুরের সমতুল্য মনে করি। লোকেরা তার এই কথা মেনে নেয়। এর পর থেকে মুসলিম উম্মতের মধ্যে অর্ধ সা ফিতরার প্রচলন শুরু হয়। [মুসলিম, অধ্যায়: যাকাত, অনুচ্ছেদ: যাকাতুল ফিত্র হাদীস নং ২২৮১ এবং ৮২]
এবার প্রশ্ন হল: নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক নির্ধারিত এক সা ফিতরার পরিমাণ সাহাবী মুয়াবিয়া (রাযিঃ) এর রায়ের কারণে রহিত হয়ে যাবে কি? কিংবা নবীসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নত কোন সাহাবীর সিদ্ধান্তের কারণে ছেড়ে দিতে হবে কি? এই কারণে সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী এই মতের জোরালো বিরোধ করেন। এবং বলেন: আমি তো সারা জীবন সেই পরিমাণেই ফিতরা বের করবো, যেই পরিমাণ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর যুগে বের করতাম। [প্রাগুক্ত হাদীস]
অন্য এক হাদীসে এসেছে তিনি বলেন: “আমি মুয়াবিয়ার সেই কথা না গ্রহণ করবো আর না তার প্রতি আমল করব।” [ ফাতহুল বারী,৩/৪৭০]
বুঝা গেল অনেক সাহাবী সুন্নতের প্রতি প্রতিষ্ঠিত থেকে খলীফা মুয়াবিয়ার এই রায়কে প্রত্যাখ্যান করেন এবং নবীজীর সুন্নত এক সা’র প্রতি আমল করতে থাকেন।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, সেই যুগে গমের মূল্য যবের দ্বিগুণ ছিল তাই কেউ গম দ্বারা ফিতরা দিলে অর্ধ সা দিলেই হবে বলে ফতোয়া দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে খেজুরের তুলনায় গম অনেক সস্তা তাই বিবেক বলে বর্তমানে গম দ্বারা ফিতরা দিলে দুই সা’ দেয়ার দরকার। কারণ বর্তমানে প্রায় দুই সা গমের যা মূল্য তা সমান সমান এক সা খেজুরের বরাবর। মনে রাখা ভাল যে, সমস্ত কল্যাণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নতের অনুসরণে নিহিত।মানুষের রায়, অনুমান ও কিয়াসে নয়। তাছাড়া স্বয়ং সাহাবী মুয়াবিয়া (রাযিঃ) বলেন: ‘‘আমি মনে করি এই অর্ধ সা গম এক সা খেজুরের বরাবর।” [মুসলিম, নং২২৮১] তিনি বলেননি, যে এটা নবীজীর আমল বা তোমরা অর্ধ সা দাও।
‘সা’ সম্পর্কে দুটি কথা:
ফিতরার সম্বন্ধে আলোচনা হলেই একটি শব্দ উঠে আসে আর তা হল, সা। সা হচ্ছে ওজন করার বা মাপার একটি পাত্র। যেমন গ্রামাঞ্চলে কাঠা দ্বারা ধান মাপা হয়। আধুনিক যুগে কিলো গ্রামের প্রচলন হওয়ায় সেই সা’র ওজন আরবেও বিলুপ্ত প্রায়। তবুও মক্কা মদীনায় ঈদের প্রাক্কালে ফিতরার চাল বিক্রয়কারীদের কাছে এই সা’ দেখা যায়। এই রকম এক সা’ র পাত্র শুষ্ক খেজুর ভরে ওজন করলে আড়াই কিলো থেকে সামান্য বেশী হয়। আর তাতে চাল ভরে ওজন করলে প্রায় তিন কিলো হয়। দ্রব্য যত ভারী হবে সা’ তে তার ওজনও ভিন্ন হবে। যেমন এক কাঠাতে চাল দিলে তার ওজন একরকম হবে আর ধান বা সরিষা দিলে আর এক রকম হবে। মোট কথা সা’ র পরিমাণকে সূক্ষ্ম কিলোগ্রামের এক ওজনে নির্ধারণ করা অসম্ভব। কারণ এটি একটি পরিমাপ পাত্র, কোন ওজনের নাম নয়। এই সা’র ব্যাখ্যায় বিদ্বানগণের বিভিন্ন মতের পর একটি সুন্দর, সহজ ও নির্ভরযোগ্য ওজন প্রমাণিত হয় যা, সর্বকাল ও সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তা হল: একজন সাধারণ শারীরিক গঠনের মানুষ অর্থাৎ অধিক লম্বা নয় এবং বেঁটেও নয়, এই রকম মানুষ তার দুই হাত একত্রে করলে যে অঞ্জলি গঠিত হয়, ঐরকম পূর্ণ চার অঞ্জলি সমান হচ্ছে এক সা। [ফাতাওয়া মাসায়েল/ ১৭২-১৭৩, সউদী ফাতাওয়া ও গবেষণা বিষয়ক স্থায়ী কমিটি, ফতোয়া নং ৫৭৩৩ খণ্ড ৯য় পৃ: ৩৬৫ ] আল্লাহ! তুমি আমাদের সঠিক বিধানের প্রতি আমল করার সুমতি দাও। আমীন।