প্রভাষক
০৭ মে, ২০২১ ০৫:০৮ অপরাহ্ণ
১৯৭১ সাল। সময়টা যুদ্ধের। সময়টা কূটনীতির। যিনি তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী মুক্তিবাহিনীকে রুখে দিতে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিলেন।
হেনরি কিসিঞ্জার জন্মঃ ২৭/০৫/১৯২৩ স্ত্রীঃ নানসি কিসিঞ্জার শিক্ষাঃ হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় জার্মান-বংশোদ্ভূত আমেরিকান শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক বিজ্ঞানী, কূটনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ী। তিনি মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
|
|
১৯৭১
সাল। সময়টা যুদ্ধের। সময়টা রক্তের। সময়টা কূটনীতির। আর এই কূটনীতির মারপ্যাঁচে
বাংলাদেশের কোটি জনতার কাছে একটি আন্তর্জাতিক ভিলেন চরিত্রের নাম হেনরি কিসিঞ্জার।
যিনি তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী মুক্তিবাহিনীকে রুখে দিতে সপ্তম
নৌবহর পাঠিয়েছিলেন।
একইসঙ্গে
স্বাধীনতাকালে দেশে দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করার চেষ্টা
করেছেন কিসিঞ্জার। যিনি দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে বলেছিলেন, বাংলাদেশ হবে একটি তলাবিহীন ঝুঁড়ি। এছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশে
ভ্রমণ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্থ করারও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। বিজয়ের
মাসে চলুন জেনে নেই, কে এই হেনরি কিসিঞ্জার? তার সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য।
হেনরি কিসিঞ্জার
১৯২৩ সালে জার্মানির ব্যাভিলিয়া প্রদেশের ফুর্ত নামক শহরে এক জার্মান ইহুদি
পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক, মা ছিলেন গৃহবধূ।
১৯৩০-এর দশকে
জার্মানিতে হিটলারের উত্থানের পরই দেশটিতে শুরু হয় ইহুদি নিপীড়ন। সেই সময় দেশটি
থেকে হাজার হাজার ইহুদি যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে গিয়ে আশ্রয় নেয়। দেশছাড়াদের মধ্যে
হেনরি কিসিঞ্জারও ছিলেন। ১৯৩৪ সালে হেনরি কিসিঞ্জার তার মা-বাবার সঙ্গে প্রথমে
আসেন লন্ডনে। এরপর ১৯৩৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান।
নিউইয়র্ক শহরে
প্রথমদিকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া শেখেন কিসিঞ্জার। পরে ভর্তি হন
হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন তিনি। এরপর রাজনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন।
এরইমাঝে যোগ দেন
যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে। সেখানে তিনি ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত সার্জেন্ট পদে
দায়িত্ব পালন করেন। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের পরই পররাষ্ট্রনীতি ও
সমরবিদ্যার অনুশীলন করেন তিনি। এরপর যুক্ত হন রাজনীতিতে। সেখানেই তিনি নিজেকে
রিপাবলিকান রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করেন।
হেনরি কিসিঞ্জার
ব্যক্তিগত জীবনে দুই বিয়ে করেছেন। বর্তমানে দ্বিতীয় স্ত্রী ন্যন্সি ম্যাগিনসের
সঙ্গে তিনি নিউইয়র্কে বাস করছেন। তাঁদের দুই সন্তান রয়েছে।
১৯৬৮ সালে
রিচার্ড নিক্সন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ১৯৬৯ সালের
২০ জানুয়ারি হেনরি কিসিঞ্জারকে তার পররাষ্ট্রসচিব ও সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ
দেন নিক্সন। কিসিঞ্জার তার কূটনৈতিক দক্ষতার ফলে ১৯৭৩ সালে ভিয়েতনামে শান্তি
প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। পরে ওই বছর তাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।
ওয়াটারগেট
কেলেঙ্কারির মূল হোতা রিচার্ড নিক্সন পরে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালেও হেনরি
কিসিঞ্জারকে স্বপদে বহাল রাখেন অন্য প্রেসিডেন্টেরাও। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি তার দায়িত্ব
পালন করে যাচ্ছিলেন। এরপর দায়িত্ব থেকে সরে গিয়ে নিউইয়র্ক শহরে বাস করতে থাকেন
মার্কিন ওই কূটনীতিবিদ।
হেনরি কিসিঞ্জার
বর্তমানে রিপাবলিকান দলের একজন ‘থিঙ্কট্যাঙ্কের’ দায়িত্ব পালন করছেন। জানা গেছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একজন পরামর্শক কিসিঞ্জার। এছাড়া
রাশিয়ার সঙ্গে মার্কিনিদের ঘনিষ্টতা বাড়াতে কিসিঞ্জার কাজ করছেন বলেও জানা গেছে।
এর আগে ৬০ এর
দশকে সোভিয়েত আধিপত্য ঠেকাতে হেনরি কিসিঞ্জার দেশটির বিরাধিতা করে আসলেও বর্তমানে
রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক বাড়তে ট্রাম্পকে পরামর্শ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ
মার্কিনিদের।
বিভিন্ন দলিলে
হেনরি কিসিঞ্জারের তৎকালীন ভূমিকা নিয়ে জানা গেছে, ১৯৬৯ সালে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নিরাপত্তার প্রয়োজনে চীনের সঙ্গে একটি সোভিয়েত বিরোধী
জোট বাঁধতে চেয়েছিল । এই প্রক্রিয়ায় পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে পালন করছিল বিশেষ
ভূমিকা। ১৯৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাই পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে আসছিল।
স্বাধীনতাকালে
দেশটির প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে একান্ত আলাপকালে কিসিঞ্জার বলেন, তৎকালীন ভারতে নিযুক্ত মার্কিন কূটনীতিক চান পাকিস্তানকে ভেঙ্গে দুই টুকরো
করে দিতে। কিন্তু তিনি কেন চান, তা তিনি জানেন না। ভারতীয়দের
সম্পর্কে কিসিঞ্জার ওই মিটিংয়ে বলেন, ওরা যত সব হারামির
বাচ্চা! ওরা আমাদের জন্য কখনো কিচ্ছু করে দেখায়নি। তাহলে এখন আমরা কেন পূর্ব
পাকিস্তানের গন্ডগোলে জড়িয়ে পড়ব?এছাড়া পূর্ব পাকিস্তান যদি
স্বাধীন হয়ে পড়ে, তাহলে দেশটা একটা আস্ত ভাগাড়ে পরিণত হবে।
১০০ মিলিয়ন মানুষ, ওখানে জীবনমান হবে এশিয়ায় সবচেয়ে নিচে।
এসময় তিনি বলেন, দেশটিতে কোনো সম্পদ নেই। তাই কমিউনিস্টরা অঞ্চলটিতে অনুপ্রবেশের জন্য একদম
প্রস্তুত। যদি দেশটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তাহলে কম্যুনিস্টরা দেশটি দখল করবে। এরপর
তারা পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে ভারতে
ঢুকবে। সুতরাং ভারত কি চাইছে, তা তারা নিজেরাই জানে না।
সত্যি বলতে কি নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনছে ভারত। অবশ্য ভারত হয়তো ভেবে
থাকবে যে কলকাতায় বসে তারা সে দেশের ওপর নিজের মাতব্বরি ফলাবে। হতে পারে, মনে মনে সে রকম অভিসন্ধিই তাদের আছে।
এদিকে
স্বাধীনতার পর যুক্তরাষ্ট্রে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুঁড়ি বলে
মন্তব্য করেছিলেন কিসিঞ্জার। সে বিষয়ে পরে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি সাংবাদিকদের
বলেন,
আমি বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুঁড়ি বলেছি কি না, তা
মনে নেই।
এখন তাঁর বয়স ৯৫। বয়সের ভারে কিছুটা নুয়ে
পড়েছেন, হাঁটাচলা শ্লথ হয়ে এসেছে,
কিন্তু স্মৃতি এখনো টনটনে। এখনো বই লিখছেন, মোটা
অর্থের বিনিময়ে ভাষণ দিচ্ছেন, মাঝেমধ্যে হোয়াইট হাউসে এসে
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে যাচ্ছেন। বার্ধক্য, স্মৃতিবিভ্রাট অথবা বাতুলতা—কোনো যুক্তিই
তাঁর ক্ষেত্রে খাটে না। তাঁকে অবশ্যই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়।
ব্রিটিশ লেখক ক্রিস্টোফার হিচেনস প্রায় এক যুগ আগে হেনরি
কিসিঞ্জারের বিচার—এই নামের
একটি গ্রন্থে কোন অপরাধে এই বিচার, তার একটি তালিকা দিয়ে গেছেন। সব অপরাধ নয়, যেসব অপরাধের প্রমাণযোগ্য নথিপত্র রয়েছে, তিনি কেবল
সেসবই তালিকাভুক্ত করেছেন। তালিকাটি সংক্ষেপে এ রকম:
১. ষাট ও সত্তর দশকে ইন্দোচীনে নিরপরাধ নাগরিকদের সুপরিকল্পিত
হত্যায় মদদ।
২. ১৯৭১-এ বাংলাদেশের গণহত্যায় সমর্থন ও সাহায্য।
৩. ১৯৭৩-এ চিলির সামরিক অভ্যুত্থান ও
বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন।
৪. সাইপ্রাসের আর্চবিশপ ম্যাকারিয়সের
হত্যা পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ।
৫. পূর্ব তিমুরে ইন্দোনেশীয় সেনাবাহিনীর
হাতে গণহত্যায় সাহায্যদান।
ষাট ও সত্তর দশকে দীর্ঘ সময় কিসিঞ্জার
একাধিক মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন—কখনো জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, কখনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে। আমি কেবল প্রেসিডেন্টের
নির্দেশ পালন করেছি, এমন খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে তিনি পার পাবেন
না। কারণ, এমন নথিপত্র এখন অবমুক্ত হয়েছে যাতে স্পষ্ট অন্য
কেউ নয়, অধিকাংশ অপরাধের পেছনে রয়েছে তাঁর কলমের দাগ। যেমন
প্রমাণ রয়েছে বাংলাদেশের গণহত্যায় তাঁর ভূমিকার। এই আলোচনায় আমরা কেবল সেদিকেই
দৃষ্টি দেব।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যা শুরু
হয়েছে, এই তথ্য কিসিঞ্জারের
অজানা ছিল না। তখন তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্নে সহকারী।
উইলিয়াম রজার্স পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেও পররাষ্ট্রবিষয়ক অধিকাংশ প্রশ্নে তিনিই ছিলেন
নিক্সনের মন্ত্রণাদাতা। ২৮ মার্চ ঢাকায় মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড এক
টেলিগ্রামে হোয়াইট হাউসকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ‘ভীতির রাজত্ব’ কায়েম হয়েছে বলে
যে সতর্কবার্তা প্রেরণ করেন, পরদিন সকালেই সে তথ্য তাঁর কাছে
পৌঁছে যায়। একদিন পর দিল্লিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিটিং ‘নির্বাচিত
গণহত্যা’ এই শিরোনামে এক টেলিগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক
সরবরাহকৃত অস্ত্র দিয়ে নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে জড়িত, একথা
জানিয়ে অনুরোধ রাখলেন, ‘নীতির ভিত্তিতে কর্মপন্থা নির্ধারণের
এখনই সময়’। এক সপ্তাহ পর, ৬ এপ্রিল, ঢাকা
থেকে ২১ জন মার্কিন কূটনীতিক এক যৌথ টেলিগ্রামে বাংলাদেশে গণহত্যায় মার্কিন
নীরবতায় তাঁদের ‘ভিন্নমত’ জানিয়ে এক কঠোর বার্তা পাঠালেন। স্বাক্ষরকারীদের একজন
ছিলেন আর্চার ব্লাড।
বাঙালিদের নয়, তাঁরা পাকিস্তানের পক্ষেই থাকবেন—নিক্সন ও কিসিঞ্জার এ সিদ্ধান্ত এক বছর আগেই নিয়ে রেখেছিলেন। ২৫ অক্টোবর ১৯৭০ সালে
হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ইয়াহিয়ার সঙ্গে মুখোমুখি বৈঠকেই সে সিদ্ধান্ত তাঁরা নেন।
‘আপনাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব’—নিক্সন তাঁকে জানিয়েছিলেন। জবাবে ইয়াহিয়া বলেছিলেন, ‘আপনাদের বন্ধুত্বের জন্য আমরা গভীরভাবে
কৃতজ্ঞ। কথা দিচ্ছি, এমন কিছুই করব না যাতে আপনারা বিব্রত
হন।’
পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক উত্তেজনা
বাড়ছে, সেনা মোতায়েন হচ্ছে,
একথা কিসিঞ্জার খুব ভালো করেই জানতেন। ১৩ মার্চ নিক্সনের কাছে এক
মেমোতে তিনি পরামর্শ দিলেন, এখন এমন কিছুই আমরা করব না যা ইয়াহিয়া
আপত্তিজনক মনে করে। পাকিস্তানের ঐক্যের স্বার্থে আমাদের উচিত ইয়াহিয়ার সঙ্গে থাকা।
ঢাকা থেকে সামরিক অভিযানের খবর পেয়ে
উদ্বিগ্ন হওয়ার বদলে খুশিই হলেন কিসিঞ্জার। ২৯ মার্চ তিনি নিক্সনকে জানালেন, মনে হয় ইয়াহিয়ার গৃহীত ব্যবস্থায় কাজ
হয়েছে। ‘পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা এখন ইয়াহিয়ার নিয়ন্ত্রণে।’ সেকথা শুনে নিক্সনের
জবাব ছিল, ‘চমৎকার। মাঝেমধ্যে শক্তির ব্যবহার কাজে লাগে।’ সে
কথায় মাথা নাড়লেন কিসিঞ্জার। ইতিমধ্যে ঢাকায় পাকিস্তানিদের হাতে গণহত্যার খবর
পত্রপত্রিকার প্রকাশিত হয়েছে। ব্লাড টেলিগ্রামও নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ফাঁস
হয়েছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নিক্সন প্রশাসনের ওপর প্রবল
চাপ বাড়ছিল। কিন্তু কিসিঞ্জার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি কথা বলতেও প্রস্তুত ছিলেন
না। ১৯ এপ্রিল এক মেমোতে তিনি লিখলেন, পাকিস্তানের প্রতি
সাহায্য বন্ধের যে দাবি উঠেছে, তিনি তার বিরুদ্ধে। স্টেট
ডিপার্টমেন্টের ভেতরেই তাঁর কথার প্রতিবাদ উঠল, নৈতিক কারণে
হলেও পূর্ব পাকিস্তানে হত্যাকাণ্ড বন্ধে ইয়াহিয়াকে উৎসাহ দেওয়ার দাবি করলেন
বিভাগীয় কর্মকর্তারা। সব বাতিল করে দিলেন কিসিঞ্জার। নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে তাঁর
যুক্তি ছিল, এর ফলে ভারতকে সাহায্য করা হবে। সে কথার
সমালোচনা হলে কিসিঞ্জার নতুন পথ ধরলেন। এই নীতি আমার নয়, প্রেসিডেন্টের।
তিনি জানালেন, পাকিস্তান, বিশেষত
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার জন্য নিক্সনের ‘কিছুটা দুর্বলতা রয়েছে’।
পরে, নিজের স্মৃতিকথায় নিক্সন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পেশাদার
কূটনীতিকদের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাঁর কথায়, এখন যারা
পূর্ব পাকিস্তানের মৃত মানুষদের জন্য মায়াকান্না দেখাচ্ছে, তারা
আসলে ভিয়েতনামে মার্কিন স্বার্থ ক্ষুণ্ন করতে সবকিছু করতেই প্রস্তুত ছিল।
(ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসন সে সময় এক জটিল পর্যায়ে পৌঁছেছে।) এই ‘মায়াকান্না’র
জন্য যাদের চড়া মূল্য দিতে হয়, তাদের একজন হলেন আর্চার
ব্লাড। তাঁকে কূটনৈতিক দায়িত্ব থেকে সরিয়ে মামুলি আমলাতান্ত্রিক কাজ দেওয়া হয়,
তাঁর পদোন্নতি আটকে দেওয়া হয়।
পাকিস্তানের প্রতি এই দুর্বলতা কেন, পাকিস্তানের সামরিক শাসকের সঙ্গে ‘কী বিশেষ
সম্পর্ক’, সে কথা তখনো অনেকের অজানা। জুলাই মাসের মাঝামাঝি
জানা গেল, পাকিস্তানের সামরিক শাসকের মধ্যস্ততায় চীনের সঙ্গে
কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চলছে। নিজের স্মৃতিকথায় কিসিঞ্জার যুক্তি
দেখিয়েছেন, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন আমেরিকার জন্য
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আর সে সম্পর্ক স্থাপনে ‘একমাত্র’
সূত্র ছিল পাকিস্তানের ইয়াহিয়া। কথাটা মিথ্যা। সে সময় স্টেট ডিপার্টমেন্টের
কর্মকর্তা ছিলেন ক্রিস্টোফার ভ্যান হলেন। পরে এক দীর্ঘ প্রবন্ধে তিনি প্রমাণ
করেছেন, শুধু ইয়াহিয়া নয়, রুমানিয়ার
রাষ্ট্রপ্রধান চাউশেস্কু, ইরানের শাহ এবং পোল্যান্ডের
মাধ্যমে সে যোগাযোগের সুযোগ ছিল। বস্তুত, ইয়াহিয়ার আগে
চাউশেস্কুর মাধ্যমে চীনা নেতাদের সম্মতিসূচক চিঠি এসে পৌঁছেছিল।
ভ্যান হলেন লিখেছেন, কিসিঞ্জার পিকিং ঘুরে এসেছেন এবং চীনের
সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, এই ঘোষণার পর
স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন, পাকিস্তানের
প্রয়োজন ফুরিয়েছে, এবার হয়তো আমেরিকা পূর্ব পাকিস্তানের
গণহত্যার ব্যাপারে নীতি বদলাবে। কিসিঞ্জার তাতেও আপত্তি করেন। এবার তাঁর নতুন
মন্ত্র হলো, ভারত শুধু পূর্ব পাকিস্তানের বিভক্তি নয়,
সে পাকিস্তান আক্রমণ করে সে দেশ দখল করতে চায়। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী
ইন্দিরা গান্ধীকে এ ব্যাপারে ইন্ধন জোগাচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ভ্যান হলেন জানাচ্ছেন,
সিআইএ এবং অন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কেউই এই তথ্য দেয়নি, ভারত পাকিস্তান দখলে উদ্যত এমন কোনো কথা কোনো পক্ষ থেকেই বলা হয়নি।
৩১ জুলাই জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সভায়
দাবি উঠল, ইয়াহিয়াকে বলা হোক তিনি
যেন পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক দায়দায়িত্ব থেকে সেনাবাহিনী সরিয়ে আনেন। সে কথা
শুনে খেপে উঠলেন কিসিঞ্জার। ‘ইয়াহিয়া কীভাবে দেশ চালাবেন, তা
নিয়ে আমাদের এত মাথাব্যথা কেন?’ তিনি প্রশ্ন করলেন। সেই
সভাতেই কিসিঞ্জার জানালেন, আমেরিকার নীতি যাতে পাকিস্তানের
পক্ষে থাকে, নিক্সন তাঁকে সে ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন।
ডিসেম্বরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ
শুরু হলে সিআইএ জানায়, ভারত আজাদ কাশ্মীর দখলে বদ্ধপরিকর। কিসিঞ্জার সেই প্রতিবেদনকেই ভারতের
পাকিস্তান দখলের অকাট্য প্রমাণ বলে ধরে নেন। যেকোনো মূল্যে পাকিস্তানকে রক্ষা করতে
হবে—এই বিবেচনা থেকে তিনি চীনকে চাপ দিতে শুরু
করলেন, যাতে ভারতের পশ্চিম
সীমান্তে সে সৈন্য মোতায়েন করে। নিউইয়র্কে এক গোপন বৈঠকে কিসিঞ্জার চীনা
রাষ্ট্রদূত হুয়াং হুয়াকে অনুরোধ করলেন, সরাসরি যুদ্ধ শুরু
করতে হবে না। শুধু সীমান্তে চীনা সৈন্য মোতায়েন করলেই ভারত ভয় পেয়ে আত্মরক্ষার
খাতিরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সৈন্য সরিয়ে আনতে বাধ্য হবে। এর ফলে ইয়াহিয়ার ওপর চাপ
কমবে।
তারপরেও চীন ও ভারতের মধ্যে যদি সামরিক
সংঘর্ষ বেধেই যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র চীনের পাশে থাকবে, হুয়াকে প্রতিশ্রুতি
দিলেন কিসিঞ্জার। পরে, এক সাক্ষাৎকারে নিক্সন স্বীকার করেন,
১৯৭১-এ যদি চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ শুরু হতো,
তাহলে তিনি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে দ্বিধা করতেন না। পরবর্তীকালে
অবমুক্ত ‘নিক্সন টেপ’-এ তাঁদের দুজনের এই রকম এক কথোপকথন রেকর্ডে ধরা আছে:
কিসিঞ্জার: সোভিয়েতরা যদি চীনের বিরুদ্ধে
হামলা চালায় আর আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকি, তাহলে আমাদের মহা সর্বনাশ হবে (কোথাও কোনো সম্মান থাকবে না)।
নিক্সন: তাহলে কী করব, সোভিয়েতদের উদ্দেশে পারমাণবিক অস্ত্র ছোড়া
শুরু করব?
কিসিঞ্জারের কথায়, সেটিই হবে চূড়ান্ত খেলা, ফাইনাল শোডাউন। তিনি এমন যুক্তিও দেখালেন, ‘পাকিস্তানের
বলাৎকার’ ঠেকাতে অন্য কোনো পথ আমাদের জন্য খোলা নেই। ‘আমাদের ও চীনের এক বন্ধু
সোভিয়েত ইউনিয়নের এক বন্ধুর সঙ্গে বিবাদে ঠকে যাবে, তা তো
হতে দিতে পারি না।’
পাকিস্তানের সমর্থনে কিসিঞ্জার আরও একটি ব্যবস্থা
গ্রহণের পরামর্শ দিলেন। তিনি জর্ডান ও ইরানের মাধ্যমে পাকিস্তানকে মার্কিন
যুদ্ধবিমান সরবরাহে সম্মত হলেন। মার্কিন কংগ্রেস আগেই পাকিস্তানকে কোনো অস্ত্র
সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। সে কথা অগ্রাহ্য করে কিসিঞ্জারের পরামর্শে নিক্সন
জর্ডানের মাধ্যমে যুদ্ধবিমান ব্যবহারের নির্দেশ দিলেন। ব্যাপারটা বেআইনি, খবরটা জানাজানি হলে তিনি বিপদে পড়বেন,
সে কারণে নিক্সন কিছুটা দ্বিধায় ছিলেন। কিসিঞ্জার তাঁকে আশ্বাস
দিলেন, ‘যদি এই তথ্য ফাঁস হয়, তো আমরা
সাফ অস্বীকার করব।’
ভারতীয় বাহিনী ও বাংলাদেশের
মুক্তিবাহিনীর যৌথ আক্রমণের মুখে দীর্ঘ সময় পাকিস্তানি সেনারা টিকে থাকতে পারবে না, একথা কিসিঞ্জার ও নিক্সনের অজ্ঞাত ছিল না।
শেষ চেষ্টা হিসেবে তাঁরা বঙ্গোপসাগরে ভারত-বাংলাদেশ নৌসীমানায় আণবিক অস্ত্র সজ্জিত
সপ্তম নৌবহর পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।
কোনো ব্যবস্থাই কাজে লাগেনি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা
ইয়াহিয়া-কিসিঞ্জার-নিক্সন ঠেকাতে পারেননি। কিসিঞ্জার পরে তাঁর হোয়াইট হাউস ইয়ার্স
গ্রন্থে সাফাই গেয়েছেন, তাঁর জন্যই (পশ্চিম) পাকিস্তানকে
বাঁচানো গেছে। বাংলাদেশের গণহত্যায় তিনি বাধা দেননি, কিন্তু
‘সবই করতে হয়েছিল পাকিস্তানকে বাঁচাতে’।
মিথ্যা সাফাই গেয়ে নিজের অপরাধকে ঢাকতে
পারবেন না কিসিঞ্জার। তিনি ও তাঁর পরিবার হিটলারের ইহুদি নিধনযজ্ঞের শিকার, উদ্বাস্তু হিসেবে আমেরিকায় আশ্রয়
নিয়েছিলেন। সেই তিনি ইন্দোচীন থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত একের পর এক নারকীয়
হত্যাযজ্ঞের প্রধান মন্ত্রণাদাতা হয়ে ওঠেন। তিনি নিজ হাতে কাউকে হত্যা করেননি,
সে যুক্তি ধোপে টেকে না, যেমন ধোপে টেকেনি
ইহুদি হত্যায় অভিযুক্ত আইখম্যানের ক্ষেত্রে। জন এন্ডারসন লি বলেছেন, কিসিঞ্জার একজন ‘নিষ্ঠুর চিয়ারলিডার’ বা হাততালিওয়ালা। তাঁরই পরামর্শে
হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা হচ্ছে, সীমানার বাইরে বসে তিনি
ডুগডুগি বাজিয়ে সেই হত্যাকাণ্ড দেখেছেন। সেইমোর হার্শ লিখেছেন, নিজের ক্ষমতা ব্যবহারে অন্ধ ছিলেন কিসিঞ্জার। হিচেন্স বলেছেন আরও শক্ত
কথা। ‘কিসিঞ্জার হলেন ক্ষমতার পর্নোগ্রাফির এক প্রতীক’। পাকিস্তান রক্ষা নয়,
তাঁর আসল লক্ষ্য ছিল নিক্সনের পুনর্নির্বাচন নিশ্চিত করা এবং নিজের
জন্য ইতিহাসে নাম কেনা।
একাত্তরের গণহত্যা আর এরপর ৪৮ বছর কেটে
গেছে। বিচারের কাঠগড়ায় উঠতে হয়নি কিসিঞ্জারকে, কিন্তু বিশ্বের বিবেকবান মানুষের ঘৃণা ও বিদ্রূপ আমৃত্যু
তাঁকে আঘাত করবে। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত।
সকাল থেকে তাড়াহুড়া চলছে, সংবাদ সম্মেলনে যেতে হবে। ভারতে
হেনরি কিসিঞ্জার এসেছে। জেপি মর্গ্যান ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিলের বৈঠকে যোগ দিতে।
৯৬ বছরের বৃদ্ধ হলেও পুরো প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে ঘোরাফেরা করেন। আজকের সংবাদ
সম্মেলনে তাকে একটা প্রশ্ন করতেই হবে, অনেক দিনের শখ। হাতের
এতো কাছে উনি যে অস্থিরতায় সব কাজে প্যাঁচ লেগে দেরি হচ্ছে।
দিল্লির সাত নম্বর জনকল্যাণ মার্গের বাংলোর লনে সংবাদ
সম্মেলন,
ভারতীয় সাংবাদিকের পাশাপাশি অন্যান্য দেশের সাংবাদিকে লনের
চেয়ারগুলি ভর্তি। নিজের নির্ধারিত আসনে বসতেই দেখি টোনি ব্লেয়ার, কন্ডোলিজা রাইস, জন হাওয়ার্ড, রবার্ট গেটস, মোদীজি ও হেনরি কিসিঞ্জার এগিয়ে আসছে
উনাদের নির্ধারিত আসলের দিকে। ধীর কিন্ত দীপ্ত পদভারে এগিয়ে এসে বসলেন হেনরি
কিসিঞ্জার।
অধিকাংশ মানুষই জানেন হেনরি কিসিঞ্জারকে তারপরও উনার একটু
পরিচয় দিতেই হয়। যদিও কিসিঞ্জার – মার্কিন কূটনীতিক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে যার
বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকার কথা কারও অজানা নয়।
কুখ্যাত ‘নিক্সন টেপে’ তো হেনরি কিসিঞ্জারকে বলতে শোনা
গিয়েছিল ভারতীয়রা ‘সাচ বাস্টার্ডস’ (এত বড় বেজম্মা), আর ইন্দিরা গান্ধী একজন
‘বিচ’!
একাত্তর সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের চালানো
গণহত্যাকেও প্রচ্ছন্ন সমর্থন করে স্বাধীন বাংলাদেশেও তার পরিচয় এক নিন্দিত
চরিত্রের।
আর সেই তিনি আমাদের বাংলাদেশকে একদা ‘বটমলেস বাস্কেট’ বা ‘তলাবিহীন
ঝুড়ি’ বলে কিসিঞ্জারের বর্ণনা তো প্রায় লোকগাথায় পরিণত!
কাম্বোডিয়ায় বেআইনিভাবে বোমা ফেলে গণহত্যা থেকে চিলিতে
গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে উৎখাত – এমন বহু ঘটনায় বারে বারে নাম
জড়িয়েছে কিসিঞ্জারের।
শীতল যুদ্ধের সময়কার ‘রিয়ালপলিটিকে’র মূর্ত প্রতীক বলেও
তাঁকে মনে করেন অনেকেই।
১৯৭৩ সালে এহেন বিতর্কিত হেনরি কিসিঞ্জার ও লে ডাক থো
যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। জানুয়ারি, ১৯৭৩ সালে উত্তর ভিয়েতনাম ও
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার যুদ্ধ বিরতি এবং সেখান থেকে আমেরিকান সেনা
প্রত্যাহারের প্রেক্ষাপটে তাকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। কিন্তু লে ডাক থো
পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান কেননা তখনো যুদ্ধ চলছিল। কিন্তু তাদেরকে নোবেল
শান্তি পুরস্কার প্রদানের ফলে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি
হয়। এরফলে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির দুইজন সদস্য পদত্যাগ করেন। কিন্তু যখন এ
পুরস্কারের বিষয়টি ঘোষিত হয়, তখনও উভয় পক্ষের মধ্যে
আলাপ-আলোচনা অব্যাহত ছিল। অনেক সমালোচকদের অভিমত, কিসিঞ্জার
শান্তি প্রণেতা ছিলেন না; বরঞ্চ যুদ্ধের ব্যাপক প্রসারে
সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখেছিলেন।
সেই হেনরি কিসিঞ্জার আজ চোখের সামনে। মোদিজির কানে কানে কি
যেন বললেন তিনি,
এতে দুইজনেই হেসে ওঠেন। প্রধানমন্ত্রীকে দেখে মনে হল না, যে উনি ভারতীয় ও ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে কি উক্তি
করেছিলেন তা মনে রেখেছেন।
অধীর হয়ে অপেক্ষা করে চলেছি আমার প্রশ্ন করার পালার আসার জন্য।
১২জনের প্রশ্ন-উত্তর পালা শেষ হতেই আমার সুযোগ আসল প্রশ্ন
করার।
রাত জেগে দেশের অর্থনীতি অবস্থা, জিডিপি নিয়ে পড়াশনা করেছি
যাতে ব্যাকগ্রাউন্ড ইনফরমেশনে কোন ভুলচুক না করি।
নিজের পরিচয় দিয়ে উনাকে প্রশ্ন করি মিস্টার কিসিঞ্জার, বাংলাদেশকে নিশ্চয় মনে আছে?
আহা! বাংলাদেশ নামটা শুনেই হাসি হাসি মুখটা কেমন গম্ভীর হয়ে গেল।
আপনি একদা বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিলেন।
উনি উত্তর দিলেন ‘বিশেষ সময়ের এক পরিস্থিতিতে এ কথা
বলেছিলাম।
আমি আবারো প্রশ্ন করি আজকের বাংলাদেশকে দেখে আপনি কি কেমন
বোধ করেন?
লজ্জিত কিনা বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলার জন্য?
উনি টেবিলের দিকে একটু ঝুকে এসে আরো গম্ভীর গলায় বললেন, তোমার দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হয়েছিল বিশেষ পরিস্থিতিতে, আর তলাবিহীন ঝুড়ির অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এমন একটি দেশ,
যে দেশকে যাই দেওয়া হোক না কেন, তা থাকবে না।
সেই ঝুড়িতে কোনো কিছুই ধরে রাখা যায় না, রাখলেই তলা দিয়ে পড়ে
যায়। বিদেশি সাহায্য দেওয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে এ কথাটি বলা। অর্থাৎ বাংলাদেশকে যতই
সাহায্য দেওয়া হবে, তা কোনো কাজে আসবে না। তারপরও সাহায্য
দিয়ে বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখতে হবে। ৭২ সালে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সেই রকম ছিল বলেই
বলা। আর বাস্কেট কেস কথাটা প্রথমে আমি বলিনি, বলেছিল উরাল
এলেক্সিস জনসন, তৎকালীন আন্ডার-সেক্রেটারি অব স্টেট।
ধন্যবাদ দিয়ে মাইকটা পাশের জনকে দেয়ার আগেই উনি আমাকে বললেন,
এবার আমি তোমাকে প্রশ্ন করি? অবাক হলাম আমাকে
কেন প্রশ্ন করবেন? আর কি প্রশ্নই বা করবেন? ৯৬ বছরের বৃদ্ধ হলেও হাতটাত কাঁপে না। গলাও বেশ বলিষ্ঠ।
হেনরি কিসিঞ্জার উলটো আমাকেই প্রশ্ন করলেন, তোমাদের বাংলাদেশকে আমি
বিশেষ পরিস্থিতে বাস্কেট কেস বলেছিলাম। কিন্তু এখন আমার মনে এখন তিনটা নাম এসেছে
তোমাদের দেশকে বিশেষিত করার, হেল্প করো কোনটা বেশি মানানসই,
“বাস্কেট অফ লুঠেরাস” বলব নাকি “ল্যান্ড অফ করাপশন” বলবো নাকি
“সুইটেবল কান্ট্রি অফ মানি হেইস্ট” বলবো?
ওরে বাবা বলে কি? কিসিঞ্জার সাহেব ত পুরো ডিফেন্সে খেলছে।
তোমাদের তলা বিহীন দেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে দৌড়ে চলেছে।
কিন্তু সেই সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছে দুর্নীতি, অনিয়ম, অনাচার, বেআইনি কারবার। কেউ দেখার নেই। কারণ ব্যস্ত
লুটপাটে। সংবাদ মাধ্যমে চোখ রাখলেই পাওয়া যায়, তহবিল তসরুফের
খবর, ব্যাংক লুট, বিভিন্নভাবে অর্থ
লুটের সংবাদ। হাজার কোটির নীচে কোন লুটপাট নেই। মুষ্টিমেয় সৎ অফিসাররা সততার সাথে
কাজ করলেও কিন্তু অধিকাংশ নিয়োজিত অবৈধভাবে জনগণের অর্থ লুট করে বিত্তশালী হতে।
বিদেশী ব্যাংকে টাকার পাহাড় গড়তে।
তোমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেকে
ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়ে,
তোমার দেশের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে কাতারে এনেছেন
ঠিকই কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের তলা কাটছে তোমার দেশের একদল মানুষ যা কেউ দেখছে না।
ধারাল দাঁতাল ধেড়ে ইঁদুরের মত ঝুড়ি ফুটো করে অবিরাম খেয়ে চলেছে। ইঁদুরের পেট ভরে
গেলে থামে কিন্তু তোমাদের দেশের সেই ক্ষমতাবান মানুষরূপী ধেড়ে ইঁদুরগুলির পেট কোন
কিছুতেই ভরছে না। তারা ঝুড়ির তলা কেটে খেয়ে চলেছে তো চলেছেই। তোমাদের দেশে কি আইন
নেই, নিয়ম নেই নীতি নেই, তোমার দেশ
বিশ্বের অন্যতম ঘন বসতিপূর্ণ দেশ, ময়লা আবর্জনায় হাঁটাচলা দায়,
দিনদুপুরে জন সমক্ষে হত্যা লুট, এমনকি
ক্ষমতাবান সহায়তায় ধর্ষণের মত ঘৃন্য অপরাধ সংঘটিত হয়, গণপিটুনির
মত জঘন্য কাজ তোমাদের দেশে ঘটে থাকে হরহামেশা, আইন নিরব
থাকে। নারীর নিরাপ্ততা নেই, ঘরে, রাস্তায়
অফিসে, স্কুলে, মন্দিরে মসজিদে,
দুর্নীতিতে তোমরা চাম্পিয়ান হচ্ছো। তোমাদের দেশে একজন চতুর্থশ্রেণির
কর্মচারী শত কোটি টাকার মালিক ভেবে বল তো কি তোমরা নিজেরাই তো নিজেদের কে তলাবিহীন
ঝুড়ি বানাচ্ছো কিনা। দুনিয়ার বুকে দুর্নীতিবাজ বলে নাম লেখাচ্ছো কিনা। আমাদের আর
কষ্ট করে কিছু বলতে হবে না, তোমাদের দেশ তোমাদের হাতেই ধ্বংস
হচ্ছে। তোমরা দেশকে ভালবাসো না, বাসলে নিজের দেশের লোকসান ও
ক্ষতি করে, সুন্দরবন ধ্বংস করে রামপাল প্রজেক্ট পাশ করতে না।
তোমাদের দেশের স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি তো আরব্যরজনীর গল্পকেও হার মানায়। গুম,
খুন, ইচ্ছে হলেই মামলা দেয়া, তোমাদের দেশের সব মন্ত্রণালয় দুর্নীতিতে ভারাক্রান্ত। বাংলাদেশের নারীরা
মিডিলইস্টে যায় কাজ করতে, সেখানে তাদের উপর অন্যায় অত্যাচার
হয়, রেপ হয়, খুন হয় কিন্তু তোমার দেশ
তা নিয়ে উচ্চবাচ্য করে না। তোমাদের দেশের মানুষ ওইসব দেশে শ্রমিক হয়ে যায়, যাদের পশুর মত ট্রিট করে। তোমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সে ব্যাপারে মুখ
সেলাই করে রাখে। এসব নিয়ে কিছু বলবে বা করবে কি অন্য কেউ কিছু বলবে কি, তোমরাই তোমাদের দেশকে শেষ করে ফেলছোস। তোমার দেশে রাজনীতি করতে আসে মানুষ
সর্ট টার্মে বিত্তবান হতে, দেশকে ভালবেসে, দেশের উন্নয়নের জন্য কেউ একটুও কাজ করে না, তোমাদের
প্রধানমন্ত্রী একা উন্নয়ন করছে কিন্তু সেই উন্নয়নের ফসল কেউ কি তোমরা ভোগ করতে
পারছো? পারছো না কারন তোমাদের দেশে সুশাসন নেই, টেকসই সুশাসন দরকার। কিন্তু এই নিয়ে কেউ কি ভাবছে……….. ওহ দেখ দেখ আজকের পত্রিকায় কি লেখেছে শিশু
ধর্ষণ!, দেখ ধর্ষণ
সব দেশে কম বেশি আছে কিন্তু ধর্ষকদের বিরুদ্ধে তোমাদের আইন কতটা কার্যকর হচ্ছে
দেখ। কমার বদলে রোজ বাড়ছে ধর্ষণ। পাকিস্তানীরা যা করতে পারেনি, তোমাদের স্বাধীনদেশে তাই হচ্ছে। মৌলবাদে নিমরজিত হচ্ছ। আর তোমাদের দেশের
জাতির পিতাকে বাইরে থেকে এসে কেউ হত্যা করেনি তোমরাই করেছো…… আরো কি কি যেন উনি বলেই যাচ্ছেন আমার কান ভোঁ
ভোঁ করছে,
ইস কেউ কি থামাবে উনাকে……
কিন্তু হেনরি কিসিঞ্জার চোখমুখ লাল করে বলেই যাচ্ছে বলেই
যাচ্ছে, উপস্থিত
বাকি সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে, সবার দৃষ্টিতে করুণা আর
উপহাস ঝরছে, তাদের দিকে না তাকিয়েও বেশ বুঝতে পারছি। লজ্জায়
মাথা নত হয়ে যাচ্ছে চোখ তুলে তাকাতে পারছি না, হাত পায়ের
তালু ঘেমে ভিজে যাচ্ছে। চারদিকে মনে হচ্ছে কোন বাতাস নেই। উফ নিঃশ্বাস নিতে পারছি
না। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে উফ একটু বাতাস, একটু বাতাস চাই………
ওদিকে হেনরি কিসিঞ্জার মাইক হাতে গ্যাক গ্যাক করে দেশের বদনাম
করেই যাছে। আমি একটু বাতাসের জন্য মরিয়া হয়ে চিৎকার করে উঠি।
ও মা চারদিক দেখি অন্ধকার! সেকি অন্ধ হয়ে গেলাম নাকি, ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল। অন্ধকার
চোখে সইতেই দেখি এতো আমার ঘর। ঘড়িতে ভোর পৌনে চারটা বাজে। কোথায় সংবাদ সম্মেলন আর
কোথায় হেনরি কিসিঞ্জার আর কোথায় বাকি লোকজন? মাথা পরিস্কার
হতেই বুঝলাম গতরাতে আমাজন প্রাইমে The Trials of Henry Kissinger ডকুমেন্টারি দেখার ফল হিসেবে দুঃস্বপ্ন দেখেছি।
ঘুম আর ফেরত না আসলেও, ভাবনা আসলো, আসলেই তো
কিসিঞ্জার তো মিথ্যে কিছু বলেনি। এই দুর্নীতি, ধর্ষণ,
লুঠ, অপচয়, অন্যায় অবিচার
না জানি কবে বন্ধ হবে। আবার না জানি বিদেশী রাষ্ট্রের কাছে হাত না পাততে হয়। সত্যি
সত্যি না আবার তলা বিহীন ঝুড়িতে ফেরত না যায়।