প্রভাষক
০৭ মে, ২০২১ ০৫:১৭ অপরাহ্ণ
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতের বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদ। তিনি আর.ডি ব্যানার্জি নামে অধিক পরিচিত।
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মঃ এপ্রিল ১২, ১৮৮৫
– মৃত্যঃ মে ২৩, ১৯৩০ ভারতের
বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদ। তিনি আর. ডি নামেই
পরিচিত ১৯১১ সালে তিনি ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণে যোগ দেন।
|
|
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (এপ্রিল ১২, ১৮৮৫ – মে ২৩, ১৯৩০) ভারতের বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদ। তিনি আর.ডি ব্যানার্জি নামে অধিক পরিচিত। ১৯১১ সালে তিনি ভারতীয়
পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণে যোগ দেন। ১৯২২ সালে তিনি হরপ্পা সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র
মহেঞ্জোদাড়ো পুনরাবিষ্কার করেন। ১৯২৬ সালে তিনি অবসরগ্রহণ করেন।
রাখালদাস নিজেই গড়ে ফেললেন ইতিহাস
বর্হিবিশ্বে তাঁর পরিচিতি আর
ডি ব্যানার্জী নামে। আমাদের কাছে তিনি রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। সিন্ধু সভ্যতার
আবিষ্কারক। ভাবতে ভাল লাগে, নবাবের এই জেলা তাঁরও জেলা। এই জেলাতেই তাঁর জন্ম, বেড়ে
ওঠা। শুধু কি তাই? ইতিহাসের প্রতি প্রাথমিক ভালবাসা তৈরিও
এখানেই। তাঁর জন্মভূমি বহরমপুরের চারপাশে ছড়িয়ে আছে ইতিহাস। এই ইতিহাসের মধ্যে
বেড়ে উঠতে উঠতে শৈশবেই রাখালদাস বুঝে গিয়েছিলেন ইতিহাসের চিহ্নগুলো ছুঁয়ে দেখাতেই
তাঁর আনন্দ। সুতরাং লক্ষ্য স্থির হতে দেরি হয়নি। ইতিহাসকে আশ্রয় করেই তিনি চাইলেন
এগিয়ে যেতে। হাতের নাগালে রামদাস সেন, রামেন্দ্রসুন্দর
ত্রিবেদী, পূর্ণচন্দ্র নাহারের মতো এমন কিছু মানুষ ছিলেন
যাঁদের দেখে এই কাজে তিনি লাভ করলেন প্রেরণা। ইতিহাস হয়ে উঠল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। তার
পরে এক দিন নিজেই গড়ে ফেললেন ইতিহাস।
ভাবতে ভাল লাগে, বিশ্বখ্যাত এই মানুষটি
কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯০০ সালে এনট্রান্স পাশ করা পর্যন্ত এই শহরের
রাস্তা ধরেই হেঁটেছেন। বন্ধুদের সঙ্গে প্রাণখোলা আড্ডা দিয়েছেন এই শহরেরই নানা
জায়গায়। তা ছাড়া যে নবাবসুলভ চালচলন এবং বেপরোয়া স্বভাব তাঁকে বিশিষ্টতা দিয়েছে,
সমস্যাতেও ফেলেছে বারবার তার মূলটা তো এই জেলার আবহাওয়াতেই গড়া।
১৮৮৫ সালের ১২ এপ্রিল থেকে
১৯৩০ সালের ২৩ মে— রাখালদাসের মাত্র পঁয়তাল্লিশ
বছরের জীবন। কর্মময় বলতে যা বোঝায়, তাই। বাবা মতিলাল ছিলেন বহরমপুর কোর্টের
সফল আইনজীবী। ফলে পরিবারে অর্থের অভাব ছিল না। এ দিকে রাখালদাস মতিলালের দ্বিতীয়
পক্ষের স্ত্রী কালিমতীর আট সন্তানের মধ্যে একমাত্র জীবিত সন্তান। ফলে আদরের
আধিক্যও ছিল তাঁকে ঘিরে। এনট্রান্স পাস করার আগেই রাখালদাসের বিয়ে হয়ে গেল
উত্তরপাড়ার জমিদার নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা কাঞ্চনমালার (যিনি পরবর্তীকালে
বাংলা সাহিত্যে লেখিকা হিসাবে পরিচিতি ও খ্যাতি লাভ করেন) সঙ্গে। পড়াশোনা অবশ্য এর
জন্য বিঘ্নিত হল না। এনট্রান্স পাশ করেই রাখালদাস উচ্চ শিক্ষার জন্য পাড়ি দিলেন
কলকাতায়। ১৯০৩ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ পাশ করলেন। যদিও এই বছর বাবা
মতিলাল পরলোকগমন করায় এবং পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে গন্ডগোলে জড়িয়ে পড়ায় তাঁর পড়াশোনায়
সাময়িক ছেদ পড়ল। কিন্তু সব বাধা কাটিয়ে আবার পড়াশোনায় ফিরে এলেন অচিরেই। ১৯০৭ সালে
প্রেসিডেন্সি থেকে ইতিহাসে অনার্স নিয়ে বিএ, ১৯১০ সালে
ইতিহাস নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করলেন।
রাখালদাস বিএ পাশ করার আগেই
কিন্তু ইতিহাস-দুনিয়ায় মোটামুটি পরিচিত হয়ে গিয়েছেন। ১৯০৬ থেকে ১৯০৮ সালের মধ্যে
এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে তাঁর অনেক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা প্রাচীন
লেখা ও
মুদ্রার ব্যাপারে তিনি যে আর কিছুদিনের মধ্যেই জহুরি হয়ে উঠবেন,তার লক্ষণও ইতিমধ্যেই দেখা গিয়েছে তাঁর এই সংক্রান্ত কাজকর্মে। এমন
মানুষকে আড়ালে রাখা যায় না। এমএ পাশ করার বছরটিতেই ভারতীয় যাদুঘরের আর্কিওলজিক্যাল
বিভাগে কাজ হয়ে গেল রাখালদাসের। ঢুকেছিলেন এক জন অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে।
আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের ডিরেক্টর জেনারেল স্যার জন মার্শাল রাখালদাসের
কাজকর্ম দেখে একেবারে মুগ্ধ। পরের বছরেই তাঁকে সার্ভের অ্যাসিস্ট্যান্ট
সুপারিনটেন্ডেন্ট করে দিলেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেন্ডেন্ট থেকে ১৯০৭ সালে
ওয়েস্টার্ন সার্কেলের সুপার হয়ে চলে গেলেন পুণে অফিসে। এখান থেকেই পরবর্তী ছ’বছর
বোম্বাই প্রেসিডেন্সির দূর দূর জায়গায় তাঁর নেতৃত্বেই চলে নানা প্রত্নতাত্ত্বিক
অভিযান। এই পর্বেই তিনি সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কারক।
একক না স্যার জন মার্শালের সঙ্গে যুগ্ম
ভাবে তিনি সিন্ধু সভ্যতা তথা মহেঞ্জাদারোর আবিষ্কারক তা নিয়ে বিতর্ক আছে। পি কে
মিশ্র তাঁর ‘Rakhal
Das Banerji: The Forgotten Archaelogist’ বইয়ে দাবি করেছেন, ১৯২৪
সালের আগে মার্শাল সে ভাবে মহেঞ্জাদারোর কথা জানতেনই না। পি কে মিশ্রের মতে,
‘Marshall
took direct charge of the excavation from winter 1925-26. By that time Banerjee
had done all the work a discoverer should have done।’ সুতরাং বর্হিবিশ্ব যাই জানুক আমরা মহেঞ্জাদারোর আবিষ্কর্তা
হিসাবে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামই যে ছোটবেলা থেকে বড় ভাবে জেনে এসেছি, জানা থাক সেটাই।
পরাধীন ভারতবর্ষে ভারতীয়দের
কৃতিত্বকে চেপে দেওয়ার ঘটনা কম নেই। সেদিক থেকে রাখালদাসের ঘটনা সত্যি না হওয়ার
কারণ নেই। কিন্তু এর পরে যা হল, তা অবিশ্বাস্য। যিনি ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক কাজকর্মে এত
সাফল্য এনে দিলেন, সেই কাজকর্ম থেকেই সরিয়ে দেওয়া হল তাঁকে
১৯২৬ সালে। সোজা কথায় চাকরি গেল রাখালদাসের। অপ্রমাণিত একটি চুরির অভিযোগে। আসলে
সে সময় রাখালদাসের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল তাঁর অফিস। মার্শাল তাঁর গুণমুগ্ধ। কিন্তু
তাঁর সঙ্গে ধুমপান, আড়ালে নিজেকে তাঁর সমকক্ষ ভাবা এবং তা
বলে বেড়ানো অফিসের কেউই ভাল ভাবে নিতে পারেনি। তাঁর কর্মচ্যুতির পিছনে এটাও কাজ
করেছিল বলে মনে হয়।
কর্মচ্যুতিতে রাখালদাস
আর্থিক প্রতিকূলতায় পড়লেন। বিষয়সম্পত্তি কম ছিল না, বেতনও পেতেন প্রচুর। কিন্তু এ সবের সঙ্গে
তাঁর খরচের বহরও ছিল দেখার মতো। বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে আড্ডা খানাপিনা বাড়িতে লেগেই
থাকত। আর চালচলনে তো ছোটবেলা থেকেই নবাবিয়ানা। যে সময় টাকায় এক মণ চাল, সে সময় রেলস্টেশনে কুলিকে তিনি অবলীলায় দশ টাকা বখশিস দিয়ে দেন।
আর্থিক অসুবিধার সঙ্গে যুক্ত
হল শারীরিক প্রতিকূলতাও। ডায়াবেটিস ধরা পড়েছিল আগেই। এ বার তা একেবারে কাহিল করে
দিল। এই অবস্থায় উড়িষ্যার ইতিহাস লেখার কাজ পেয়ে কিছুটা আর্থিক সুরাহা হল। এর পরে
১৯২৮ সালে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ‘মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী প্রফেসর’ হিসাবে
তিনি নিযুক্ত হলেন। তবে এই কাজে সম্মান যতটা ছিল, অর্থ ততটা ছিল না। বিশেষ করে রাখালদাসের
মতো খরচে মানুষের পক্ষে। এ দিকে শরীর ভাঙছে দ্রুত। এর সঙ্গে বড় ছেলের অকাল
প্রয়াণের শোক আর সামলাতে পারলেন না রাখালদাস। একজন অসুখী আর উদ্বিগ্ন মানুষ হিসাবে
প্রয়াত হলেন দু’বছরের মধ্যেই।
অনেক কাজ অসমাপ্ত থেকে গেল।
তবে যা করে গেলেন সেটাও কম নয়। মহেঞ্জাদারো-সহ নানা প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারে
অংশগ্রহণ করা তো আছেই সেই সঙ্গে রয়েছে প্রচুর গবেষণামূলক বইপত্র, ঐতিহাসিক, সামাজিক উপন্যাস। তাঁর দুখণ্ডে ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’; ‘পাষাণের কথা’, ‘শশাঙ্ক’, ‘ধর্মপাল’
ইত্যাদি সুখপাঠ্য, তথ্যানুগ ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলি আজও পড়তে
ভাল লাগে। কিন্তু গবেষণার প্রয়োজন ছাড়া এ সব উলটে দেখার আর সময় কই বাঙালির?
বইয়ে তাই ধুলো জমে। ধুলো জমে মানুষটার ছবিতেও। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের
জন্মদিন, মৃত্যুদিন চলে যায় নীরবে।
শিক্ষক,ভগবানগোলা হাইস্কুল
বন্দ্যোপাধ্যায় রাখালদাস
বন্দ্যোপাধ্যায় রাখালদাস (১৮৮৫-১৯৩০) ঐতিহাসিক। তিনি একাধারে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব, উৎকীর্ণ
লিপিতত্ত্ব ও প্রাচীন হস্তলিপি বিষয়ের পথপ্রদর্শক এবং সাহিত্যিক
ছিলেন। ১৮৮৫ সালের ১২ এপ্রিল মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে তাঁর জন্ম। তাঁর বাবা
মতিলাল ও মা কালিমতী। রাখালদাস ১৯০৭ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ হতে ইতিহাস বিষয়ে
সম্মানসহ স্নাতক এবং ১৯১০ সালে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইতিহাস বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
রাখালদাস ১৯১০ সালে কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরের প্রত্নতাত্ত্বিক
বিভাগের সহকারী কর্মকর্তা এবং ১৯১১ সালে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক
জরিপ বিভাগএ সহকারী তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি
১৯১৭ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক তত্ত্বাবধায়ক পদে পদোন্নতি লাভ
করেন। কিন্তু ১৯২৬ সালে তিনি স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। এর
পর ১৯২৮ সালে তিনি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন
ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির মণিন্দ্রচন্দ্র নন্দী অধ্যাপক পদে
যোগ দেন এবং ৪৫ বছর বয়সে ১৯৩০ সালের ৩০ মে কলকাতায় তাঁর
অকাল মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
এ স্বল্পকালীন জীবনে রাখালদাস কমপক্ষে ১৪টি
এককগ্রন্থ (monographs) ও পুস্তক, ৯টি উপন্যাস এবং বাংলা ও ইংরেজিতে তিনশরও বেশি প্রবন্ধ রচনা করেন।
রাখালদাস ভারতীয় সভ্যতার সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গী সম্পন্ন
জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক ছিলেন। তাঁর গ্রন্থসমূহকে কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায় যথা, (১) বর্ণনামূলক তালিকা, (২) উৎকীর্ণ লিপিতত্ত্ব ও
প্রাচীন হস্তলিপি বিদ্যা, (৩) মুদ্রাতত্ত্ব, (৪) স্থাপত্য ও ভাস্কর্যবিদ্যা, (৫) খনন ও মাঠ পর্যায়ে প্রত্নতত্ত্ববিদ্যা, (৬) ভারতীয় ও আঞ্চলিক ইতিহাস বিষয়ে পাঠ্যপুস্তক এবং (৭) বাংলা
ভাষায় উপন্যাস।
রাখালদাসের বর্ণনামূলক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে (ক) লক্ষ্ণৌ জাদুঘরে রাখা প্রাচীন নিদর্শনের তালিকা (১৯০৮, অপ্রকাশিত)
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
(খ) এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গলের সংগ্রহে
তাম্রলিপির তালিকা (১৯১০), (গ) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ এর জাদুঘরে রাখা মুদ্রা ও
ভাস্কর্যের বর্ণনামূলক তালিকা (১৯১১) এবং (ঘ) অযোধ্যা রাজ্যের প্রাচীন নিদর্শন
(১৯২৯)। তাঁর এ কাজগুলি উৎকর্ষে লুদারস, কীলহর্ন এবং ডি.আর
ভান্ডারকারের রচনার সাথে তুলনীয়।
প্রাচীন হস্তলিপি বিদ্যা ও লিপি উৎকীর্ণ
বিদ্যায় রাখালদাসের
অবদান গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ The Origin of the Bengali
Scripts’ হরপ্রসাদ
শাস্ত্রী ও থিওডর ব্লককে উৎসর্গ করেন এবং এজন্য তিনি ১৯১৩ সালে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় এর মর্যাদাকর ’জুবিলী
গবেষণা পুরস্কার’ লাভ করেন। ১৯১৯ সালে (১৯৭৩ সালে পুনঃমুদ্রিত) প্রথম প্রকাশিত
তাঁর এ গ্রন্থ ছিল তাম্রলিপি ও পান্ডুলিপির ওপর ভিত্তি করে বাংলা লিপির বিকাশ তুলে
ধরার প্রথম প্রচেষ্টা। তিনিই প্রথম আদি বাংলা লিপির প্রতি পন্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ
করেন। আদি বাংলা লিপিই পরবর্তীকালে বাংলা লিপির রূপ পরিগ্রহ করে। ১৯২৯ সালে
প্রকাশিত তাঁর Memoir of the Asiatic Society of Bengal-এ প্রকাশিত হাতিগুমফা ও
নানাঘাট অভিলেখের প্রাচীন হস্তলিপি গ্রন্থখানি ভারতীয়
হস্তলিপি বিদ্যার গবেষণার ক্ষেত্রে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান বলে চিহ্নিত। Epigraphia Indica,
Journal of the Asiatic Society of Bengal, Indian Antiquary, Journal of the
Bihar and Orissa Research Society ইত্যাদির বিভিন্ন খন্ডে প্রকাশিত আশিটিরও
বেশি অভিলেখ তিনি সম্পাদনা ও পুনঃসম্পাদনা করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাখালদাস কর্তৃক
অভিলেখ সমূহের মূল পাঠ অদ্যাবধি প্রশ্নাতীত। খরোষ্ঠী লিপির প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ
ছিল। ১৯২০ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে তিনি খরোষ্ঠী লিপির বিবরণ দিয়েছেন।
ভারতীয় মুদ্রা গবেষণার ক্ষেত্রে প্রাচীন মুদ্রা,
প্রথম পর্ব (বাংলায় লিখিত) ছিল সন্দেহাতীতভাবে
রাখালদাসের সবচেয়ে বড় অবদান। এ গ্রন্থে প্রাচীন ও
প্রাক-মধ্যযুগীয় ভারতের মুদ্রাসমূহের বিজ্ঞানসম্মত বর্ণনা ও
সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। ১৯১৪ সালে
প্রকাশিত এটিই ভারতীয় ভাষায়
মুদ্রাতত্ত্বের ওপর লিখিত সর্বপ্রথম গ্রন্থ। এর আগে রাখালদাসের সামনে কেবল র্যাপসনের
Indian
Coins (১৮৯৮)
বইটি ছিল। রাখালদাস সম্পূর্ণভাবে ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে
মুদ্রাতত্ত্বের ওপর গবেষণা করেন। তিনি প্রাচীন ভারতীয়ে
ইতিহাস পুনর্গঠনে এর গুরুত্ব তুলে ধরেন। মধ্যযুগীয় ও পরবর্তী
মধ্যযুগীয় ভারতের মুদ্রার ওপর তাঁর প্রবন্ধগুলি Journal and Proceedings
of the Asiatic Society of Bengal, Numismatic Supplement of the Journal of the
Asiatic Society
ইত্যাদিতে প্রকাশিত হয়। তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ এর জাদুঘরে সংরক্ষিত
ভাস্কর্য ও মুদ্রার ক্যাটালগের মুখবন্ধ রচনা করেন।
রাখালদাস প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাস সম্পর্কিত কলা,
স্থাপত্য ও মূর্তিতত্ত্বের গবেষণায় অনবদ্য
অবদান রাখেন। Temple
of Shiva at Bhumara, Bas Reliefs of Badami ‰es The Haihayas of Tripra and
their Monuments-এর ওপর লিখিত তাঁর তিন খন্ড Memoirs of the Archaeological Survey of
India যথাক্রমে,
১৯২৪, ১৯২৮ এবং ১৯৩১ (মরণোত্তর প্রকাশিত) সালে
প্রকাশিত হয়। ভারতীয় কলা ও তার বিভিন্ন
দিকে তাঁর যে প্রগাঢ় পান্ডিত্য ছিল তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ হলো এ তিনটি খন্ড। এ
রচনাগুলি ভারতীয় সকল ছাত্রছাত্রী ও ইতিহাসবিদদের নিকট
উৎসগ্রন্থ হিসেবে এখনও অতি মূল্যবান। ভারতীয় কলার বৃহত্তর
প্রেক্ষাপটে রাখালদাসের বিশ্লেষণকে বোঝার জন্য The Age of the Imperial
Guptas (১৯৩৩) এবং History of Orissa from
the Earliest Times to the British Period (দুটি খন্ড-১৯৩০ ও ১৯৩১-এ প্রকাশিত)-এ
অন্তর্ভুক্ত ভাস্কর্য ও স্থাপত্যের ওপর লিখিত অধ্যায়সমূহ গুরুত্বপূর্ণ। গুপ্ত যুগীয় স্থাপত্য বিষয়ক অধ্যায়ে
রাখালদাস তাঁর আবিষ্কৃত ও তাঁর জানা ধ্বংসাবশেষসমূহের এক বিস্তৃত বর্ণনা দেন। এগুলিকে
ভৌগোলিক দিক থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের মধ্যে অবস্থিত বলে চিহ্নিত করা যায়। উড়িষ্যার স্থাপত্য বিষয়ক অধ্যায়ে তিনি উড়িষ্যা মন্দিরের রীতিকে উত্তর ভারতের নাগর রীতি থেকে আলাদাভাবে
চিহ্নিত করেন এবং কর্ণাটকের বেল্লারী জেলার অমৃতেশ্বর মন্দির থেকে প্রাপ্ত একটি তথ্যের
ভিত্তিতে উড়িষ্যা মন্দিরকে কলিঙ্গ রীতির নমুনা হিসেবে উল্লেখ করেন।
Age of the Imperial Guptas এর মৃণ্ময় শিল্পের অধ্যায়ে রাখালদাস বিভিন্ন অঞ্চলে বিকশিত
গুপ্ত-কলার শৈলীগত বৈশিষ্ট্যাবলি সতর্কতার সাথে চিহ্নিত করেন এবং মথুরা, বারাণসী (সারনাথ) ও পাটলিপুত্রকে গুপ্ত ভাস্কর্যের প্রধান তিনটি ধারা এবং
মান্দাসোর (প্রাচীন দসপুর) ও এরান (ঐরকিন) প্রভৃতিকে উপ-ধারার বিকাশ কেন্দ্র রূপে
দেখান।
ভারতীয় শিল্পকলার চর্চায়
রাখালদাসের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কীর্তি হলো তাঁর মৃত্যুর পরে ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত Eastern Indian Medieval
School of Sculpture নামক গ্রন্থটি। প্রায় চারশত শোভাবর্ধক চিত্র সম্বলিত
এ গ্রন্থে রাখালদাস পূর্ব ভারতীয় কলার নির্মাণ কৌশল, উৎপত্তি ও বিকাশ, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণদের দেব-দেবীদের
মূর্তিতত্ত্ব, ধাতব ভাস্কর্যের কৌশল, জৈন
প্রতিমা ও পূর্ব ভারতের মধ্যযুগীয় স্থাপত্য সম্পর্কে আলোচনা
করেন। তিনি উৎকীর্ণ মূর্তিতে উল্লিখিত তারিখ ও তারিখ বিহীন মূর্তির অভিলেখ-এর
বৈচিত্রপূর্ণ্য হস্তলিপির ওপর ভিত্তি করে কালানুক্রমে পাল-সেন যুগের ভাস্কর্যকে
বিন্যস্ত করেন। পূর্ব ভারতীয় শিল্পকলার ওপর তিনি বাংলায় ৬টি মূল্যবান প্রবন্ধ রচনা করেন। তিনি এগুলির নামকরণ করেন ‘গৌড়ীয় শিল্প’। ১৯২৭ ও ১৯৩০ সালের মধ্যে প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত এ প্রবন্ধগুলিতে গৌড়ীয় রীতির বিকাশের
বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
মূর্তিতত্ত্বে রাখালদাসের গভীর অনুরাগ ছিল।
ভারতীয় গবেষণার এ বিষয়ের ওপর তাঁর জ্ঞান ১৯০৯-১০ সালে Annual Report of the
Archaeological Survey of India-ˆZ 'Three Sculptures in the Lucknow Museum' নামক শিরোনামে প্রকাশিত
প্রবন্ধে দৃষ্টান্তস্বরূপ প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি এ তিনটি ভাস্কর্যের মধ্যে একটিকে
পঞ্চমুখ শিবলিঙ্গ হিসেবে যথার্থভাবেই শনাক্ত করেন। তিনি তাঁর Eastern Indian Medieval
School of Sculpture-এ বেশ কিছু বিভ্রান্তিকর মূর্তি শনাক্ত করেন এবং পৌরাণিক কাহিনী ও যথার্থ
উদাহরণসহ পাল-সেন যুগের ধ্যানমগ্ন মূর্তির ব্যাখ্যা দেন।
মহেঞ্জোদারোর আবিষ্কর্তা হিসেবে রাখালদাস
বন্দোপাধ্যায় (সংক্ষেপে আর.ডি ব্যানার্জী) একটি অতি পরিচিত নাম। পশ্চিম অঞ্চলের
প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ের তত্ত্বাবধায়ক প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবে তিনি গ্রিক বিজয়
স্তম্ভের সন্ধানে সিন্ধু অঞ্চলে গিয়েছিলেন এবং ঢিবির শীর্ষদেশে বৌদ্ধ বিহারের
উৎখননকালে তিনি এমন কতগুলি নিদর্শনের সন্ধান পান যা তাঁকে হরপ্পায় সাহানী কর্তৃক
প্রাপ্ত অনুরূপ নিদর্শনের কথা মনে করিয়ে দেয়। ১৯২২ সালে তিনি খননকার্য শুরু করেন।
এসময়ে প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শনাদি আবিষ্কৃত হয়। এ সভ্যতা সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যা ও
বিশ্লেষণ বেশ কিছু প্রবন্ধ ও গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলি হলো: An Indian City Five
Thousand Years Ago (Calcutta Municipal Gazette, November, 1928);
মুহেন-জোদরো (বসুমতী, ১৩৩১ বা.স); Prehistoric, Ancient
and Hindu India
(১৯৩৪ সালে মরণোত্তর প্রকাশিত) এবং Mahenjodaro - A Forgotten
Report (১৯৮৪)।
১৯২৪-২৫ সালে পূর্বাঞ্চলে বদলি হয়ে রাখালদাস
পাহাড়পুরে উৎখননকাজ চালান এবং এর রিপোর্ট ১৯২৫-২৬ সালে Annual Report of the
Archaeological Survey of India-তে 'Temple of Paharpur' নামে প্রকাশিত হয়।
প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগে চাকরির শেষ দুবছরে রাখালদাস বাংলা ও
আসামে ব্যাপক ভ্রমণ করেন এবং মহাস্থানগড় ও ঘোড়াঘাট অঞ্চলে অনুসন্ধান চালান
এবং মুর্শিদাবাদ ও ঢাকার ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহ পরীক্ষা করেন। তিনি প্রথমবারের মতো
আসামের প্রাচীন ও মধ্যযুগের প্রাথমিক সময়ের ভাস্কর্য ও কাঠামোগত ধ্বংসাবশেষসমূহের
প্রতি পন্ডিতদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন এবং তেজপুরের নিকটস্থ দহপর্বতিয়ার একটি
ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের দরজা-বাজুর ভাস্কর্য আবিষ্কার করেন।
রাখালদাস কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিক
পরীক্ষার পাঠ্যক্রম অনুযায়ী দুটি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। বই দুটি হলো History of India (১৯২৪) ও A Junior History of India (১৯২৮)। তাঁর The Age of the Imperial
Guptas (১৯৩৩) ছিল
১৯২৪ সালে তাঁর প্রদত্ত বক্তৃতার একটি সঙ্কলন গ্রন্থ। মধ্য এশিয়ায় সভ্যতার উষালগ্ন
ও প্রাচীনকালে ভারতে বিভিন্ন জাতির আগমনকাল থেকে শুরু করে ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গির
আলোকে রাখালদাস বাংলার ইতিহাস আলোচনা করেন। তাঁর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থসমূহ
হলো বাংলার ইতিহাসের ওপর দুখন্ডে লিখিত বাঙ্গালার ইতিহাস (১৯১৪ সালে ১ম খন্ড ও
১৯১৭ সালে ২য় খন্ড প্রকাশিত) ও উড়িষ্যার ইতিহাসের ওপর লিখিত দুটি বিশাল খন্ড। রমাপ্রসাদ চন্দ এর গৌড় রাজমালার
পাশাপাশি বাঙ্গালার ইতিহাস-কে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে প্রথম
প্রচেষ্টা বলে অভিহিত করা যায়। বাঙ্গালার ইতিহাসে প্রাচীন ও মধ্য যুগীয়
পূর্বভারতের ইতিহাস আলোচিত হয়েছে। অপরপক্ষে, দুখন্ডে রচিত
উড়িষ্যার ইতিহাসে উড়িষ্যার প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক কালের ইতিহাস লিখিত হয়েছে।
রাখালদাস শশাঙ্ক, ধর্মপাল, করুণা, ময়ূখ, অসীম, লুৎফ-উল্লা, ধ্রুব, পাষাণের
কথা, অনুক্রম, হেমকণা প্রভৃতি বাংলা
উপন্যাস সমূহ লেখেন। এ উপন্যাসগুলি তাঁকে সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত করেছে। এগুলির
মধ্যে কয়েকটি ভারতের অন্যান্য ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে। [অমিতাভ
ভট্টাচার্য]
মহেঞ্জোদারো সভ্যতা আবিষ্কার করেও মেলেনি স্বীকৃতি, চুরির
দায়ে চাকরি গিয়েছিল রাখালদাসের
আর কষ্টকর নিজের
দুরন্ত সব খোঁজের ফল ভুগতে হয়েছিল। অফিস রাজনীতির কোপে পড়ে চাকরি যায় তাঁর। অভিযোগ
, তিনি নাকি মূর্তি চুরি করেছেন। এমনই মিথ্যা অভিযোগে রাখালদাসবাবুকে চাকরি
থেকে বরখাস্তও করা হয়। তখন ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধীনে উড়িষ্যার হিরাপুরের
চৌষট্টি যোগিনীর মন্দিরে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চলছিল। দায়িত্বে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
নিজে। সেই সময় সেখান থেকে মূল্যবান একটি মূর্তি চুরি যায়। সেই বড়কর্তা জন মার্শাল
যিনি তাঁকে খুব পছন্দ করতেন, পদন্নোতিতে সাহায্য করেছিলেন,
খুব কাছের মানুষ সেই তিনিই রাখালদাসের আবিস্কারে ভাগ বসানোর
পাশাপাশি চাকরিটিও খেয়ে নিয়েছিলেন। কোন প্রমাণ ছাড়াই দোষী সাব্যস্ত করেন রাখালদাস
বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সেটা ১৯২৬ সাল। এসব আর নিতে পারেননি। পয়সার অভাবে জর্জরিত হয়ে
পড়েন আরও কষ্ট দেয় পুত্রের অকাল মৃত্যু। ১৯৩০ সালে ৪৫ বছর বয়সে অকাল প্রয়াণ ঘটে
বাঙালির বিখ্যাত প্রত্নতত্ববিদের। আর জন্মদিন? এই তো আজকের
১২ এপ্রিলে ১৮৮৫ সালে বহরমপুরে। কেউ মনে রেখেছে। উত্তর নেতিবাচক ছাড়া কিছু মেলে
না।