Loading..

পাঠসংশ্লিষ্ট ছবি/ইমেজ

১৭ আগস্ট, ২০২১ ১২:৫৪ পূর্বাহ্ণ

সুকান্ত ভট্টাচার্য্য

মাত্র ২১ বছর বয়সে প্রাণপ্রদীপ নিভে যাওয়া সত্ত্বেও বেঁচে আছেন সগৌরবে। লিখে গেছেন সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রাম, যন্ত্রণা ও বিক্ষোভকে পুঁজি করে অসাধারণ সব কবিতা। যিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত গণমানুষের মুক্তি ও নতুন সমাজ গড়ার জন্যে লড়াই করেছেন তিনি অন্য কেউ নন বাংলা সাহিত্যের ‘ক্ষণজন্মা কবি’ সুকান্ত ভট্টাচার্য।


১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট বাংলা সাহিত্যের ক্ষণজন্মা প্রতিভা সুকান্ত ভট্টাচার্য অবিভক্ত বাংলার পশ্চিমবঙ্গ কলকাতার ৪৩, মহিম হালদার স্ট্রীটে তাঁর মামার বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার (বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া থানার উনশিয়া গ্রামে)। পিতা নিবারণ ভট্টাচার্যের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী সুনীতি দেবীর দ্বিতীয় পুত্র তিনি। জেঠতুতো দিদি রাণীদি নাম রাখেন সুকান্ত, ‘রমলা’ খ্যাত সাহিত্যিক মনীন্দ্রলাল বসুর গল্প ‘সুকান্ত’ - এর নামে।


শৈশব কাটিয়েছেন বাগবাজারের তাদের নিবেদিতা লেনের বাড়িটিতে এবং সেখানকারই কমলা বিদ্যামন্দিরে তাকে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ভর্তি করা হয়। কমলা বিদ্যামন্দিরেই সুকান্তের সাহিত্যেও হাতেখড়ি হয়। বলা হয়ে থাকে, ‘উঠন্তি মূলো পত্তনেই চেনা যায়’…সুকান্তের ক্ষেত্রেও এর ব্যাত্যয় ঘটেনি। শৈশবেই তার সাহিত্যানুরাগ স্পষ্ট হতে থাকে, তার প্রথম ছোটগল্প ছাপা হয় বিদ্যালয়েরই একটি পত্রিকা - ‘সঞ্চয়’ এ। এরপর ‘বিবেকানন্দ জীবনী’ - আরো একটি গদ্য শিখা পত্রিকায় ছাপা হয়। শিখা পত্রিকায় সেসময় প্রায়ই সুকান্তের লেখা ছাপা হতো।


কবি সুকান্তের সাহিত্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে তাঁর নয় দশ বছর বয়স থেকেই। স্থানীয় প্রাথমিক স্কুল কমলা বিদ্যামন্দিরে পড়ার সময় সেখানকার চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্ররা মিলে একটি হাতে লিখা পত্রিকা বের করে। সুকান্ত এই পত্রিকার নাম দেন 'সঞ্চয়', এতে তিনি নিজেও একটি হাসির গল্প লিখেন। ছেলেবেলাতে সুকান্ত অভিনয়েও পারদর্শীতা দেখান। স্কুলের নাটক 'ধ্রুব'-তে তিনি নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ১৯৪১ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা যান। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে সুকান্ত রেডিওতে 'গল্পদাদুর আসরে' কবিতা আবৃত্তি করে প্রশংসা লাভ করেন সবার।


কমলা বিদ্যামন্দিরে লেখাপড়ার পাট চুকবার পর সুকান্ত ভর্তি হন বেলেঘাটা দেশবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়ে। সুকান্ত সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন এবং ১৯৪৪ সাল থেকে তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যোগদান করেন ভারতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের মাধ্যমে। ১৯৪৪ সালেই ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ’ এর প্রকাশনায় তিনি ‘আকাল’ নামে একটি সাহিত্য সংকলন সম্পাদনা করেন। ১৯৪৫ সালে সুকান্ত প্রবেশিকা পরিক্ষায় অংশ নেন এবং উত্তীর্ন হতে পারেননি।


ছোটবেলা থেকেই বিদ্যালয়ের বাঁধাধরা নিয়ম-কানুন তার একদম পছন্দ ছিলো না। জীবনের প্রতিটি অংশেই সুকান্ত যেন অনিয়মকে তার নিয়ম করে নিয়েছিলেন। একদিকে পার্টির কাজ, অন্যদিকে কলমযুদ্ধ, অভাব অনটন…সব মিলিয়ে অনিয়মের স্রোত তার রুগ্ন শরীর মেনে নিতে পারেনি; যক্ষ্মারোগ বাসা বাঁধে এই অনিয়মের ফাঁকে ফাঁকে। সুকান্ত সূর্যের কাছে ‘রাস্তার ধারের উলঙ্গ ছেলেটিকে’ উত্তাপ দেবার জন্য পরম আকুতি জানিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু কখনো নিজেকে রক্ষার জন্য কারো কাছে হাত পাততে পারেননি। যে নিজেকেই মানবতার, আর্তের রক্ষক নিযুক্ত করেছে তাকে রক্ষা করবে কে? কেউ পারেনি, তাই সুকান্ত তার জীবনাঙ্কের সবটুকু বেঁচে যেতে পারেননি। তার রাজনৈতিক জীবন, তার সাহিত্য জীবন এমনভাবে ‘ব্যক্তি সুকান্ত’কে গ্রাস করে নিয়েছিলো যে তার ব্যক্তিজীবনকে থেমে যেতে হয় অকাল মৃত্যুতে।


সুকান্তের লেখনী গভীরভাবে প্রভাবিত হতো তার সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গী ও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির অভিজ্ঞতা থেকে। চারপাশের মানুষকে নিয়ে সুকান্তের যে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি ছিলো, তাই তিনি ঢেলে দিতেন কলমে-কাগজে। তার অনুভূতিগুলো এতই প্রখর ছিলো যে তা প্রকাশ করতে গিয়ে কলম হয়ে উঠতো তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর। ‘ছাড়পত্র’ কাব্যগ্রন্থের ‘হে মহাজীবন’ কবিতাটিতে সুকান্ত পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটির সাথে তুলনা করেছেন, এ যেন আপামর জনতার ক্ষুধারই আক্ষরিক রূপ। পদ্য কী করে গদ্যের চেয়েও বেশি সত্য হয়ে ওঠে, সুকান্ত তো তা বারবারই দেখিয়ে দিয়েছেন তার মূর্তমান কবিতায়। কবিতা যে শুধু অদেখা, অছোঁয়া বা বিমূর্তই নয় - সুকান্তের কবিতার মূর্ততা আপনি আপনার পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়েও অনুভব করতে পারবেন।


একজন লেখক অবশ্যই একজন ভালো পাঠক, এই বৈশিষ্ট্যটিও ছিল কবি সুকান্তের। অনেক বই পড়তেন তিনি। সুকান্তের প্রিয় বইয়ের তালিকায় বিভূতিভুষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ বইটির স্থান ছিল অনেক উঁচুতে। বইটি সম্পর্কে সুকান্ত বলেছিলেন, “ধর্মগ্রন্থের সঙ্গে সমান আদরে এই বই সকলের ঘরে রাখা উচিত”। সুকান্তের মনে সবসময়ই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি গভীর অনুরাগ কাজ করতো। একবার তো তিনি কলকাতায় মহাজাতি সদনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুষ্ঠানে চলে গিয়েছিলেন শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথকে দেখবার জন্য!


সুকান্ত ভট্টাচার্য কানে একটু কম শুনতেন ঠিকই, কিন্তু সর্বহারার আর্তচিৎকার শুনতে একদম ভুল করেননি! সুকান্তের কবিতার সহজ সরলতা অনেককে আশ্চর্য ও মুগ্ধ করেছে, সেই সরলতার সমগ্র তাৎপর্য সকলের কাছে ধরা পড়েনি; কারণ আমরা শুধু প্রকাশভঙ্গিটাই বুঝতে চাই - বার্তাটি নয়!


সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু সুকান্তের বর্ণনা দিয়েছেন এমন করে - “গোর্কীর মতো, তার চেহারাই যেন চিরাচরিতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কানে একটু কম শোনে, কথা বেশি বলেনা, দেখামাত্র প্রেমে পড়ার মতো কিছু নয়, কিন্তু হাসিটি মধুর, ঠোঁট দু’টি সরল”। বুদ্ধদেব বসু সুকান্তের কথা আরো বলেছেন, “যে চিলকে সে ব্যঙ্গ করেছিলো, সে জানতো না সে নিজেই সেই চিল; লোভী নয়, দস্যু নয়, গর্বিত নিঃসঙ্গ আকাশচারী, স্খলিত হয়ে পড়লো ফুটপাতের ভিড়ে, আর উড়তে পারলো না, অথবা সময় পেলো না। কবি হবার জন্যই জন্মেছিলো সুকান্ত, কবি হতে পারার আগে তার মৃত্যু হলো”।


কবিতার পৃষ্ঠায় সুকান্তই সূর্যকে বলতে পেরেছিলেন,“হে সূর্য তুমি ত জানো আমাদের গরম কাপড়ের কত অভাব!”, সিগারেটকে আহবান জানাতে পেরেছিলেন ‘হঠাৎ জ্বলে উঠে বাড়িসুদ্ধ পুড়িয়ে’ মারতে, ‘যেমন করে তোমরা আমাদের পুড়িয়ে মেরেছ এতকাল’; সুকান্ত কেঁদেছেন ডাকঘরের রানারের দুঃখে - ‘পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া!’


সুকান্ত ভট্টাচার্যের রচনাবলীর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো - ছাড়পত্র (১৯৪৭), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫) প্রভৃতি।


কলকাতা শহরকে নিয়ে এক অদ্ভূত আতিশয্য কাজ করতো সুকান্তের মাঝে, কলকাতাকে এক রহস্যময়ী নারী ভেবে ভালবেসেছেন তিনি। কলকাতা তার প্রেয়সী, কলকাতা তার হারিয়ে যাওয়া মা। তার বাইরের কোনো জগত ছিলো না, যা ছিল তা এই কলকাতাতেই। সুকান্তের জগত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো কলকাতার অলিতে গলিতে। তিনি বাঁচতে চাইতেন কলকাতাকে নিয়েই, কলকাতার মৃত্যু তার জীবনেরও ইতি টানবে এই বিশ্বাস ছিলো সুকান্তের…।


সুকান্তের জীবন ও কাব্য ছিলো একই সুরে গ্রথিত ও একই মন্ত্রে অনুরণিত। তাই কোন এক অংশকে আলাদা করে বলা যায় না…বলতে হলে সমান্তরালভাবে, একসাথেই বলতে হয়। সুকান্ত ভট্টাচার্য তার কোন বইই প্রকাশিত হবার পর দেখে যেতে পারেননি। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় ‘ছাড়পত্র’, এবং এরপর অন্যগুলোও।


একাধারে বিপ্লবী ও স্বাধীনতার আপোসহীন সংগ্রামী কবি সুকান্ত ছিলেন কমুনিষ্ট পার্টির সারাক্ষণের কর্মী। পার্টি ও সংগঠনের কাজে অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে নিজের শরীরের উপর যে অত্যাচারটুকু তিনি করলেন তাতে তার শরীরে প্রথম ম্যালেরিয়া ও পরে দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৩ই মে মাত্র ২১ বছর বয়সে কলিকাতার ১১৯, লাউডন স্ট্রিটের 'রেড এড কিওর হোমে' মৃত্যুবরণ করেন। সুকান্ত ভট্টাচার্যের জীবন মাত্র ২১ বছরের আর লেখালেখি করেন মাত্র ৬ - ৭ বছর। সামান্য এই সময়ে নিজেকে মানুষের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। তার রচনা পরিসরের দিক থেকে স্বল্প অথচ তা ব্যাপ্তির দিক থেকে সুদূরপ্রসারী।


আজ তাঁর জন্মদিবসে, বিপ্লব ও সাম্যবাদের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রতি রইলো আমার গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।


★ তথ‍্যসূত্র  :- উইকিপিডিয়া ও ইন্টারনেট।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি