Loading..

ম্যাগাজিন

৩০ এপ্রিল, ২০২০ ০৯:১৮ পূর্বাহ্ণ

আর পারিনা বহিতে, আর পারিনা সহিতে....


প্রিয় জেরী !

School শব্দটি এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে, যার অর্থ ছিল ‘অবসর যাপন’। তখন এ শব্দটি দিয়ে এমন এক সময়কে বোঝানো হতো যখন সৈন্যদের আর যুদ্ধে যাবার দরকার ছিল না, কৃষক তার কৃষিকাজ থেকে মুক্তি পেত, ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা বন্ধ রাখত- অর্থাৎ পুরোপুরি অবসর যাপন। অনেকটা প্রাচ্যের দেশগুলোর গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনের মতো। তখনকার স্কুলে পড়াশোনার কোন ঝামেলা ছিল না, বই সাথে করে না নিলে বা সেটা না খুললে চলত। এখানে তারা গল্প-গুজবের মাধ্যমে অনেক কিছু শিখে ফেলত। সময়ের পরিক্রমায় ঝপযড়ড়ষ পরিণত হলো জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে, প্রাচীন ভারতের নালন্দা থেকে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিষ্টটলের লাইসিয়াম হলো আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বসূরি। দুঃখের ব্যাপার এই যে, আজ স্কুলে অবসর পাওয়া যায় মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ মিনিট। 


আর আজ .. .. ‘পরীক্ষা যতই এগিয়ে আসতে থাকে, ততই ধরা পড়তে থাকে পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে শিক্ষার্থীর প্রণয় কত গভীর। সারাদিন টেবিলে বসে শুধু ন্যা-ন্যা-ন্যা-ন্যা-ন্যা- ন্যা-ন্যা-ন্যা-ন্যা করতে থাকে। এই আওয়াজ যত বাড়ে ততই খাওয়া কমে আসে, স্বাস্থ্য এতটাই খারাপ হয় যে মুখ শুকিয়ে থুতনি লম্বা হয়ে যায়। পড়তে পড়তে চোখ গর্তে বসে যায়। পরীক্ষা যত কাছে আসতে থাকে ততই ঈশ্বরপ্রেম বাড়ে, দিনরাত নামাজ আর সেজদায় পৃথিবী ধুন্দুমার হয়ে যায়। দরকারের ওই যাঁতাকল শিক্ষার্থীর সমস্ত আনন্দ নিংড়ে নেয়।’১.. .. .. ‘এই পরীক্ষা জিনিসটা আমাদের জীবনকে এত কষ্ট দেয়, এত নির্যাতন করে যে এক-একসময় কেবল পাঠ্য নয়, পাঠ্য-অপাঠ্য সব বইয়ের ওপরেই আমরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠি; বইয়ের ব্যাপারে আমাদের ভালোবাসা চলে যায়। বই দেখলে ভয়ে আঁতকে উঠি। আগেই বলেছি এটা বইয়ের দোষ নয়, দোষ ওই খারাপ শিক্ষাব্যবস্থার, পরীক্ষা ব্যবস্থার। যা হোক, ব্যাপারটা এত নিষ্ঠুর আর কুৎসিত যে, বই জিনিসটা ছেলেবেলা থেকেই আমাদের কাছে একটা বিভীষিকা হয়ে যায়। এই দুর্বিষহ কষ্টের স্মৃতিটাকে সারাজীবন আমরা আর তাড়াতে পারি না।’২


মা আমার, প্রাইভেট পড়া আর কোচিং ক্লাসের জন্যে দিন-রাত দৌড়ে বেড়ানো, প্রশ্ন মুখস্থ, পরীক্ষার প্রস্তুতি এতসবের যাঁতাকল থেকে তোমরা কিছুতেই আর বেরোতে পারছো না। আমরা সপ্তাহে মাত্র দুটো ঘণ্টাও তোমাদের মানুষ হবার জন্যে দিতে নারাজ। পারলে দিনে চব্বিশ ঘণ্টাই তোমাদের দিয়ে পাঠ্যবই মুখস্থ করাতে চাইছি। ইংল্যান্ডে ১৮১৮ সালে একটা আইন হয়েছিল। আইনটা হচ্ছে: দিনে বিশ ঘণ্টার বেশি শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো যাবে না। কী ভয়ংকর কথা! মানে কী? মানে, আগে নিশ্চয়ই বিশ ঘণ্টারও বেশি তাদের খাটানো হত। হয়তো বাইশ-তেইশ ঘণ্টাই। ঘুমাতেও হয়তো দিত না। আমাদের অভিভাবকদের ভাবসাব অনেকটা এমন যে, ক্লাস ফোরের ছেলেকে দিয়ে পি.এইচ.ডি-র গবেষণা করতে হবে। ক্লাস ফাইভ এর পি.এস.সি পাশ করে মেয়েটা বুঝি বি.সি.এস ক্যাডার হয়ে কালই যোগদান করবে।


দূরন্ত মা আমার, ‘ শৈশব মানে তো কেবল পড়াশোনা নয়। শৈশব মানে তো বন্ধুত্ব, আড্ডা, খেলাধুলা, স্বপ্ন, প্রজাপতির পেছনে বেড়ানো, নীল আকাশ, খোলা মাঠ-কোথায় আজ এসব তোমাদের জীবনে? আলসেমির আর অবকাশের সময়টাই আমাদের জীবনের সবচেয়ে সৃজনশীল সময়। দেখবে যে-মানুষ ঊর্ধ্বশ্বাসে লেজ তুলে দৌড়াচ্ছে তার মাথায় নতুন আইডিয়া আসে না। যে খুব বেশি কাজ করে, তার মাথা নিরেট হয়ে যায়। কিন্তু দাঁত মাজতে মাজতে আমাদের মাথায় অনেক সময় নতুন আইডিয়া এসে পড়ে। কেন আসে? কারণ অবসর আর আলসেমির ভেতর আমাদের মন তখন স্বপ্ন, কল্পনা আর আনন্দের উপযোগী হয়ে যায়। এজন্যে বাথরুমে গোসল করতে গেলে গায়ক হয় না এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল।’৩.. .. ‘মানুষের গোটা জীবন আসলে তার শৈশবের সমান। এই সময় সে যে-মানুষটি হয়ে বড় হয়, মৃত্যু পর্যন্ত সে-মানুষটিই সে থেকে যায়। সেই শৈশব থেকে আমরা আমাদের শিশুদের পুরোপুরি বঞ্চিত করে ফেলছি। তাই তারা এমন ফ্যাকাসে আর নিষ্প্রাণ। একটা দুঃখী রোবট ছাড়া যেন কিছু নয়। জীবনকে দুদ-ের স্বপ্নের অবকাশে ভরে দেওয়া এমন কঠিন কিছু নয়। এতে জীবনটা মৌচাকের মতো সোনালি মধুতে ভরে ওঠে। দিনে ঘণ্টা-দুই নিজের আনন্দের জন্যে রাখতে পারলেও জীবনকে সোনা দিয়ে মুড়ে ফেলা যায়। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র দুটি ঘণ্টা। এই একমুষ্টি অবসরও কি আমরা আমাদের শিশুদের দেব না ?’৪ 


আসলে, জীবনের একমাত্র লক্ষ্য যখন জ্ঞানার্জনকে ছাড়িয়ে গোল্ডেন এ প্লাসের দিকে ধাবিত হয়, তখন জানার জন্য মানুষ জানে না, শেখার জন্য মানুষ শেখে না বরং সেই শিক্ষার মূলে থাকে কতগুলো বাণিজ্যিক লক্ষ্য যেমন: ভালো একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া, ভালো চাকরি পাওয়া ইত্যাদি। বর্তমান যুগে শিক্ষা একটি পণ্য আর এই পণ্যের বিক্রেতা অসৎ শিক্ষক তো বটেই সাথে রয়েছে বিভিন্ন চক্র; যাদের যোগসাজশ রয়েছে বিভিন্ন প্রশ্নপত্র ফাঁসের ক্ষেত্রে, যারা করে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন জায়গায় তদবির: হতে পারে তারা শিক্ষক, হতে পারে তারা রাজনৈতিক নেতা। সভ্যতার খোলসে কোনো এক অসভ্য সমাজে আমাদের বসবাস। যেখানে আমাদের লক্ষ্য বাণিজ্যিক, লক্ষ্যে পৌঁছানোর রাস্তা অসৎ আর সেই রাস্তায় অসংখ্য অসৎ মানুষের ভিড় যারা কম কষ্টের মাধ্যমেই লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন দেখায় কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরও। 

এটা কেমন সমাজ? যে বয়সে হেসে খেলে প্রকৃতি থেকে, সমাজ থেকে জ্ঞান অর্জন করার কথা তখনই বইয়ের ভারে পিষ্ট সেই কোমলমতি শিশু-কিশোর। তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে গোল্ডেন এ প্ল¬াস অর্জন করে পরিবারকে খুশি করার দায়ভার। আর এ দায়ভার পূরণ করতে গিয়ে শিক্ষার্থীর সুকোমল বৃত্তি, সৃজনশীলতা ও মননের চর্চা হচ্ছে বিঘিœত। আর এদের শৈশবের আশা কৈশোরের স্বল্প বাষ্পায়িত হয়ে উড়ে যাচ্ছে। ওরা যে দৌঁড়ে নাম লিখিয়েছে সেখানে তাদের সহযাত্রীদের দেখছে হয়তো কাউকে ধাক্কা মেরে, চিটিং করে পৌঁছে যাচ্ছে লক্ষ্যে। আর সেই চিটিংবাজ দৌঁড়ের সহযাত্রীই হয়তো পাচ্ছে সবার কাছে সংবর্ধনা। তার মা-বাবাও তাকে বরণ করে নিচ্ছে সহাস্যে। তাই বাধ্য হয়ে বাকিরাও দৌঁড়ে কুকৌশলে জয়ী হওয়ার কৌশল রপ্ত করে নিচ্ছে। আর সেখানে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে গোল্ডেন এ প্ল¬াস নিয়ে চিন্তিত মা-বাবা। তার মা-বাবা তাকে এমন কোচিং-এ ভর্তি করাচ্ছে যেখানে পাওয়া যায় সাজেশন, খুব কম পড়েই লাভ করা যায় ভালো ফলাফল। আবার তারা শরণাপন্ন হয় এমন মানুষের কাছে যেখান থেকে টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন পাওয়া যাবে। কী দরকার এত পড়াশোনা করার? জানার? বোঝার? টাকাই তো কিনে দিতে পারছে শিক্ষা ও মর্যাদা। 


সোনা মা, আমাদের দেশের .. .. ‘শিক্ষা ব্যবস্থা নানাদিক থেকে দুঃখজনক অবক্ষয়ের শিকার হয়ে পড়েছে। শিক্ষাগৃহ আজ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে শিক্ষকদের বাড়িতে বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়ে গেছে। প্রায় প্রতিটি শিক্ষকের বাসাই আজ একেকটা দোকান। মুক্তবাজার অর্থনীতির আদর্শে সেখানে অবাধ বিদ্যার কেনাবেচা। শহরের কোনো কোনো শিক্ষকের বাড়িকে একেকটা সুপার মার্কেটের মতোই মনে হয়। যেসব বাড়ির সামনে ছাত্রছাত্রীদের যত গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে, অনেক সুপার মার্কেটের সামনেও তত থাকে না। অভিভাবকেররাও আজ ধরে নিয়েছেন, পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার জন্যে ছাত্রদের যোগ্য করে তোলাই শিক্ষকদের একমাত্র কাজ। নোট দিয়ে, সাজেশন দিয়ে পরীক্ষায় ছাত্রকে ভালো ফল করানোই একমাত্র দায়িত্ব। আজ দেশে কেউ আর শিক্ষার্থী নেই, সবাই আজ পরীক্ষার্থী। .. .. যে শিক্ষক ছাত্রকে শুধুমাত্র পরীক্ষা-সফল করে তোলার জন্যেই তার যাবতীয় শক্তি নিঃশেষ করেন, তিনি শিক্ষক নন। ইংরেজি ভাষায় তার অন্য একটি নাম আছে। টিউটর। তিনি প্রাইভেট টিউটর, কোচিং সেন্টারের ইন্সট্রাক্টর- এমন অনেক কিছুই হতে পারেন, শিক্ষক নন। শিক্ষক টিউটরের চেয়ে বড়। .. .. শিক্ষকের নিজের ভেতর এই বিষয়টিকে ঘিরে যদি একই ধরনের স্বপ্ন, আনন্দ আর ভালোবাসার উথালপাতাল না থাকে, যদি তাঁর সেই স্বপ্ন এবং মদিরতাকে তিনি উজ্জ্বল শব্দে প্রদীপ্ত ভাষায় ছাত্রের হৃদয়ে সঞ্চারিত না করতে পারেন, তবে কীভাবে তিনি সফল হবেন ?’৫



‘আমরা সবাই সেলসম্যান, বিক্রেতা। এই কনজ্যুমারিজমের যুগে আমরা সবাই কিছু-না-কিছু উৎপাদন করি আর বিক্রি করি। আমি কারো কাছে  স্নো বেঁচি, তো সে আমার কাছে কলম বেঁচে, আমি টেলিভিশন বিক্রি করি তো সে গাড়ি বিক্রি করে। সারাদিন আমরা অন্যদের কাছে কিছু-না-কিছু বিক্রি করি বলে তাদের দেখলেই আমাদের মিষ্টি করে হাসতে হয়। না হাসলে জিনিস বিক্রি হয় না। তাই আরও বেশি বেশি হাসি। অথচ আশ্চর্য, যে-আমরা সারাদিন অন্যদের জন্যে এত হাসি উপহার দিই- সন্ধ্যায় সেই আমরাই যদি স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বসে শুধু আধঘন্টা সময় এমনি একটু হেসে কাটাতাম তাহলে গোটা পৃথিবীর মানুষের জীবনই সুখে-আনন্দে ভরে উঠত। কিন্তু দয়া করেও এটুকু আমরা করি না। আমাদের ছোটবেলায় বৃদ্ধরা অবসর গ্রহণ করলে অন্তত কিছু সময় পেত- নাতি কোলে রাস্তায় হাঁটাহাঁটির বা তসবি হাতে আল্লাহ-বিল্লাহ করার। এখন কারো সময় নেই- না বৃদ্ধের, না যুবকের, না শিশুর।’৬ প্রমথ চৌধুরী এক জায়গায় লিখেছিলেন, ‘দেহের মৃত্যুর রেজিষ্ট্রি রাখা হয়, কিন্তু আত্মার মৃত্যুর রেজিষ্ট্রি রাখা হয় না।’ যদি সে রেজিষ্ট্রি রাখা হত তাহলে হয়ত দেখা যেত, আমাদের এই কোটি শিক্ষার্থীর মধ্যে নব্বই লক্ষ শিক্ষার্থীই মৃত। নানা কারণে আমরা মরে যাই, মরে যায় আমাদের সন্তানেরা। সামান্য একটু সুযোগের অভাবে, আনন্দের অভাবে, এক কণা আলোর অভাবে এই মৃত্যু ঘটে যায় লোক চক্ষুর অগোচরে । 


আধুনিক মননশীল যে কোন কিন্ডার গার্টেন বা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের যে কোন শিক্ষার্থীর বইয়ের ব্যাগ, ক্লাস টেষ্ট, মডেল টেষ্ট, Weekly test, Monthly test, Sudden Test  ইত্যাদি আজগুবী নামের পরীক্ষার চাপে কেন যেন আমার চোখ ছলছল করে উঠে। নিজেকে একজন পিতা হিসাবে খুবই অপরাধী মনে হয়, সেই অপরাধবোধ আরও দ্বিগুণ হয়ে উঠে যখন শিক্ষক হিসাবে হোম ওয়ার্ক দিতে বাধ্য হই। শিশুশ্রম যদি অপরাধ হয়, হোমওয়ার্ক কেন অপরাধের নয়? এই প্রশ্ন আমার বিবেককে প্রতিনিয়ত দংশন করে, অপমানিত করে। কবে আমার ছাত্র ছাত্রীদের আমি এই হোম ওয়ার্ক নামক শিশুশ্রম থেকে মুক্তি দিতে পারবো ? সোনা মা, পড়ার চাপ ও বইয়ের ব্যাগ এর ভারে তোমাদের ক্লান্ত শৈশব দেখে দেখে ক্লান্ত আমি যে, ‘আর পারিনা বহিতে, আর পারিনা সহিতে, আর পারিনা ভাবতে অনিবার.. ..!’  

তোমার বন্ধু 

‘টম’

       তথ্যসূত্র : ১। উদ্বৃত্তি ১-৫, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাইয়ীদ, বক্তৃতা সমগ্র-২

            ২। উদ্বৃত্তি ৬, ডেল কার্নেগি, রচনা সমগ্র 

লেখকঃ

শামীম আখতার শিমুল, 

সহকারী শিক্ষক (আইসিটি)

০১৯১১৭৪৮৮৪৮

                                                                                                          


আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি