ফুটবল মাঠকে একটা ক্যানভাস ধরলে মাঠের খেলোয়াড়েরা একেকজন শিল্পী। সেই ক্যানভাসের অপরিহার্য শিল্প হলো মাঝমাঠ।
মাঝমাঠ ‘প্যানডোরাস বক্স’-এর মতো। গ্রিক পুরাণের এই বাক্সে কী আছে, তা না খোলা পর্যন্ত অজানা। মাঝমাঠও তেমনই এক অদ্ভুত জায়গা। যেখানে কী ফলাফল আসবে, তা আগে থেকে ভেবে বের করা দুষ্কর। ফুটবলের শুরু থেকে নানা কোচের ট্যাকটিস খাতায় অনেক কিছু ঠাঁই পেয়েছে। কিন্তু মাঝমাঠকে সরিয়ে দিয়ে খেলার চিন্তা কারো মাথাতেই আসেনি। মাঠের ডিফেন্স আর অ্যাটাকের সন্ধিক্ষণ এই মাঝমাঠ খেলার মোড় বদলে দিতে সময় নেয় মাত্র কয়েক সেকেন্ড। আজকের গল্পটা মাঝমাঠের সেরা কিছু শিল্পীকে নিয়েই।
জেনেরো গাত্তুসো-আন্দ্রেয়া পিরলো-ক্লেরেন্স সিডর্ফ (এসি মিলান)
যেমনটা
বলছিলাম, মাঝমাঠ হলো প্যানডোরাস বক্স। কখন কার সঙ্গে কার মিলে যায়, তা
কেউই বলতে পারবে না। এসি মিলানের বিখ্যাত মিডফিল্ড-সেনাদের পাশাপাশি দাঁড়
করালে তাদের উচ্চতা ছাড়া আর কোনো দিকের মিল পাওয়া যাবে না। ৫ ফুট ১০ ইঞ্চির
তিন মিডফিল্ডার ছিলেন একজন আরেকজনের ঠিক উল্টো। কি স্বভাবে, কি খেলার
স্টাইলে, কি কথাবার্তায়। অথচ এই তিনজনকে নিয়েই অসাধ্য সাধন করেছেন কোচ
কার্লো আনচেলত্তি। তাঁদের নিয়েই ছয়বার লিগ, দুবার চ্যাম্পিয়নস লিগ আর ২৬
বছর পর কোপা ইতালিয়া উদ্ধার করেছে এসি মিলান।
জেনেরো গাত্তুসোর ডাকনাম ছিল রাইনো, অর্থাৎ গন্ডার। যেমন বিশাল
দেহ, তেমনই শক্তি। মাঠে যতক্ষণ থাকতেন, একটা মুহূর্ত থামাথামি নেই।
জলজ্যান্ত দুটো ফুসফুস নিয়ে খেলছেন যেন। খেলায় ছিল আগ্রাসী মেজাজ। খেলার
মাঝেই তাঁর হাতে চাটি খেতে হয়েছে অনেক জুনিয়রকে। কারণ? মাঠে আস্তে দৌড়ানো।
যেন ইতিহাস বই থেকে তুলে আনা এক যোদ্ধার প্রতিচ্ছবি।
আন্দ্রেয়া পিরলো ছিলেন তাঁর ঠিক উল্টো, খেলায় যেমন ধীরস্থির,
স্বভাবে তেমনই শান্ত। ন্যাচারাল ট্যালেন্ট বলতে যা বোঝায়, ফুটবল মাঠে তা–ই
ছিলেন পিরলো। দেখতে ছিলেন দেবদূতের মতো, খেলতেনও যেন সে রকম। তাঁর নাম হয়ে
গিয়েছিল ‘দ্য প্রফেসর’। কেনই–বা হবে না, ম্যাচের সুতো ধরে রাখার বেলায় তাঁর
দক্ষতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের তুলনায় কম কিছু ছিল না।
অন্যদিকে ক্লেরেন্স সিডর্ফ ছিলেন দুজনের ঠিক মিক্সচার। মেজাজ তেমন
খিটখিটে না হলেও খেলতেন নিজের সবটা দিয়ে। মাঠের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত,
সবটা যেন তাঁর নখদর্পণে। একেবারে মিডফিল্ডের পাওয়ার হাউস, ইঞ্জিনরুম। তিনি
ছিলেন গ্রাফট অ্যান্ড ক্রাফটের মিক্সচার। সব কাজের কাজি। সামনে একজন রাইনো
আর দেবদূতকে সামলাতে যে পরিমাণ খাটনি একটা ইঞ্জিনের প্রয়োজন, ঠিক তা–ই
করতেন সিডর্ফ।
তিনজনের কথা শুনে বোঝা হয়ে গেছে, এঁদের দিয়ে আর কোনোভাবেই একসঙ্গে
মাঠে চলা সম্ভব নয়। অথচ সেই অসাধ্য সাধন করেছিলেন কার্লো আনচেলত্তি।
খেলোয়াড় হিসেবে মিলানে খেলেছেন, ছিলেন মাঝমাঠের মূল সেনানী। তাঁর জানা ছিল
এঁদের একত্র করতে কী কী দরকার। গাত্তুসোর সঙ্গে যুক্ত হলেন পিরলো, সিডর্ফ।
এক মৌসুম পরে ব্রাজিল থেকে আনলেন কাকাকে। আগে থেকে তো গাত্তুসো ছিলেনই।
পারফেক্ট দশে দশ প্ল্যানিং যাকে বলে, ডিফেন্সে মালদিনি-নেস্তা জুটি, আর
সামনে শেভচেঙ্কো আর ইনজাঘি। তার মাঝখানে খুলে দিলেন প্যান্ডোরার বাক্স,
গাত্তুসো-পিরলো-সিডর্ফ। আর তরুণ কাকাকে দিলেন ফ্রি রোল। ২০০৩ চ্যাম্পিয়নস
লিগে পৃথিবী অবাক হয়ে দেখেছিল এক ভয়ংকর রোজানারিদের।
২০০২ থেকে ২০১২—পুরো এক দশক ইতালি সঙ্গে সঙ্গে পুরো বিশ্ব মেতে ছিল
এই রোজানারি মিডফিল্ডের ফ্লুয়েন্সে। কিন্তু এরপর এসি মিলানের অর্থনৈতিক
অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে দল ছাড়তে হয় অনেককে, অবসর নেন একসঙ্গে অনেক
খেলোয়াড়, এক মৌসুমে শেষ হয়ে যায় এই রোজানারি মিড। সঙ্গে সঙ্গে এসি মিলানও।
লোথার ম্যাথিউস-পিয়েরে লিটবার্স্কি-থমাস হাসলার (জার্মানি)
সেরা
জুটি কিংবা ত্রয়ীর কথা এলে সাধারণত জাতীয় দলের জুটিগুলোকে তেমন দেখা যায়
না। বরং তাঁদের নাম সব সময়ই পাদপ্রদীপের আলোর নিচে থাকে। কারণ যত বেশি
একত্রে খেলা হয়, তত নামডাক ছড়ায়। জাতীয় দলে কালেভদ্রে দেখা যায় একত্রে।
কিন্তু তারপরও যখন এদের নাম সামনে চলে আসে, তখন বোঝা যায় এঁদের প্রভাব কতটা
বড় ছিল। আশির দশকে জার্মান ফুটবলে মাঝমাঠের গল্পটা এমনই ছিল।
মিডফিল্ড ট্রিও হিসেবে তাঁদের তিনজনকে খুব বেশি সময় একত্রে দেখা
যায়নি। কিন্তু যতটা সময় দেখা গেছে তাতেই গল্পটা তাঁদের করে নিয়েছেন এই
তিনজন। লোথার ম্যাথিউসের কথাই ধরা যাক। জার্মানিকে চতুর্থ বিশ্বকাপ জেতানোর
মহানায়ককে ধরা হয় ফুটবল ইতিহাসের সেরা ডিফেন্সিভ মিডফ্লিডার হিসেবে।
কেনই–বা হবে না। একসময় মিডফিল্ড বলতে ছিল দলের আক্রমণভাগকে সাহায্য করা।
কিন্তু মাঝমাঠের খেলোয়াড়দের কাজ যে ডিফেন্সেও সহায়তা করা হতে পারে, সে
ব্যাপারে কেউ ভেবেই দেখত না। লোথার ম্যাথিউস পরিবর্তন এনেছিলেন সে
জায়গাতে।
পিয়েরে লিটবার্স্কি ছিলেন দ্য পারফেক্ট ড্রিবলার। যদিও জীবনের
প্রথম দিকে ওপরেই খেলেছেন। কিন্তু পরিণত হতেই কোচ বেকেনবাওয়ার তাঁকে নামিয়ে
দিয়েছিলেন মাঝমাঠে। তাতে যেন তাঁর খেলার ধার বেড়ে গিয়েছিল শতগুণে। জার্মান
মিডফিল্ডের লিঙ্ক আপ প্লেয়ার ছিলেন পিয়েরে।
তবু কিসের যেন একটা অভাব ছিল। ১৬ বছর বিশ্বকাপের ছোঁয়া না পাওয়া
যতটা না কষ্টের, তার থেকে কষ্টের পরপর দুই বিশ্বকাপ ফাইনাল হারার স্মৃতি।
ইতালি-আর্জেন্টিনাকে দেখেছেন সামনে দিয়ে আনন্দ মিছিল করতে। কিছুই করতে
পারেননি ম্যাথিউস-লিটবার্স্কি। মনে মনে গোঁ ধরে ছিলেন, এবার আর কোনো ছাড়
দেওয়া চলবে না। ঠিক তখনই সব কাজের কাজি হয়ে এলেন থমাস হাসলার। অ্যাটাকিং
মিডফিল্ডার ছিলেন না শুধু, ছিলেন ফ্রি–কিক স্পেশালিস্ট, পাস মাস্টার,
টেকনিক্যালি সাউন্ড। কোনো দিক দিয়েই কম নয়, একেবারে দশে দশ। হাসলার আসার পর
নিজেকে আরও নিচে নামিয়ে নিয়ে আনলেন ম্যাথিউসের পাশাপাশি। অ্যাটাক আর মিডের
লিংটা ছেড়ে দিলেন হাসলারের ওপর। এরপর যা হওয়ার তা–ই। প্রথম ইউরোতে বেশ
ভালো খেলা দেখালেও সন্তুষ্ট থাকতে হয় তৃতীয় হয়েই। কিন্তু লক্ষ্য যে
বিশ্বকাপ। তাতেই স্থির রইলেন তাঁরা।
বিশ্বকাপ আসতেই দেখা গেল তাঁদের রুদ্ররূপ। কোনো ম্যাচের হার তো দূরে থাক, ফাইনালে যাওয়ার পথে ছিটকে ফেললেন যুগোশ্লোভিয়া, নেদারল্যান্ডস, ইংল্যান্ডের মতো দলকে। এরপর ফাইনালে আর্জেন্টিনা। যাদের সঙ্গে চার বছর আগে ফাইনাল হারার দগদগে স্মৃতি। তাঁকে থোড়াই কেয়ার করলেন জার্মান ট্রিও। বরং তাঁদের উড়িয়ে দিয়ে ১৬ বছর পর নিজেদের মাটিতে বিশ্বকাপ নিয়ে ফিরল জার্মানরা। সেই সঙ্গে শেষ হয়েছিল এক অসাধারণ মিডফিল্ডের ইতিকথা। খেলেছেন মাত্র এক বিশ্বকাপ, অথচ তাদের মতো ‘ইমপ্যাক্টফুল মিডফিল্ড’ এসেছে খুব কমই।
জাভি হার্নান্দেস-আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা-সার্জিও বুসকেটস (বার্সেলোনা, স্পেন)
মাঝমাঠের
গল্প আসবে আর এই তিনজনের নাম আসবে না, তা কি কখনো হয়? হয় না। মাঝমাঠ
নিয়ন্ত্রণ কী জিনিস, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ দিতেই সম্ভবত যুগে যুগে এই তিনজনের
নাম বারবার উঠে আসবে। অন্য সব জুটির থেকে এই তিনজনের গল্প অনেক বেশিই
আলাদা, তার কারণটা জাতীয় দল আর ক্লাবে একসঙ্গে রাজত্ব চালানো।
বার্সেলোনা তাদের ট্রেডমার্ক টিকি-টাকার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল
ইয়োহান ক্রুইফের আমলে। ইয়োহান ক্রুইফ খেলোয়াড়ি জীবনে এসে বদলে দিতে
চেয়েছিলেন বার্সেলোনাকে। তাতে খুব একটা সফল না হলেও কোচ হিসেবে এসে রেখে
গিয়েছেন নিজের পদচিহ্ন। তারই শিষ্য পেপ গার্দিওলা যখন ডাগআউটে আসেন, তখন
নিজের দুই পুরোনো সতীর্থই হয়ে উঠল তাঁর সাথি। টিকি-টাকা নামক পাসিং ফুটবলের
অন্য এক রূপ দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ড। প্ল্যানটাও ছিল
একেবারে দশে দশ। কিন্তু কোথায় যেন আটকে যাচ্ছিলেন। সামনে এগোতে পারছিলেন,
কিন্তু পেছনে বালির বাঁধের মতো ভেঙে পড়ছিল সব। সেখানেই ত্রাতা হিসেবে এলেন
পেপ গার্দিওলা। ২০০৮ সালে মূল দলের কোচ হতে না হতেই নিয়ে এলেন বুসকেটসকে।
বার্সেলোনার বালির বাঁধের সমাধান।
এরপরের আট বছর পৃথিবী হাঁ করে শুধু দেখেছিল কীভাবে মাঝমাঠে রাজত্ব
করতে হয়, কীভাবে মাঝমাঠকে নিজেদের দুর্গ বানাতে হয়, কীভাবে তৈরি করতে হয়
শিল্প, শুধু তুলির আঁচড়ে।
ছোটখাটো একটা মানুষ, মাঠের এদিক–সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শরীরে না
আছে তেমন শক্তি, না আছে ক্ষিপ্রতা। কিন্তু মুহূর্তের ব্যবধানে পায়ে বল
পাওয়ামাত্র বদলে যেতেন তিনি। খেলাটা চলত তাঁর মাথা দিয়ে। পুরো মাঠের ছকটা
মাথায় নিয়ে এরপর যুদ্ধে নামতেন। জাভিকে এর থেকে ভালোভাবে পরিচিত করিয়ে
দেওয়ার সুযোগ নেই।
এরপর ছিলেন ইনিয়েস্তা, আরেক নাম ম্যাজিশিয়ান। কেনইবা হবে না?
২০১৮-১৯ সালে প্রথমবারের মতো ইনিয়েস্তাকে ছাড়া সিজন শুরু করেছিল বার্সা,
তাতেই দেখা গিয়েছিল মাঝমাঠ আর অ্যাটাকে কতটা ফাঁকা। যেন এক ছন্নছাড়া বার্সা
মিডফিল্ড। তাঁর গল্পটাই এ রকম, তিনি মাঠে জাদু দেখাতেন। এখান থেকে ওখানে
ছুটে সামান্য একটা পাস কিংবা শট, বদলে দিত খেলার চিত্রনাট্য।
আর ধাঁধার শেষ গল্প বুসকেটসের। মাত্র ২০ বছর বয়সে দলে ঢুকেই জায়গা
পাকা করে নিয়েছিলেন শুধু নিজের খেলা দিয়েই। তাঁর গল্পটা আড়ালে থাকার কারণ?
কারণ তিনি আড়ালেই খেলেন। ফুটবল ইতিহাসের গ্রেটেস্ট ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের
নাম আসলে তাতে ম্যাকেলেলে আর তাঁর নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হবে। গোল নেই,
অ্যাসিস্ট নেই, তবু ভিসেন্তে দেল বস্কের কথাটা তাঁর খেলা ব্যাখ্যা করতে
যথেষ্ট, ‘পুরো ম্যাচ খুঁটে খুঁটে দেখো, বুসকেটসকে কোত্থাও পাবে না। শুধু
বুসকেটসকে দেখো, পুরো ম্যাচ দেখতে পাবে।’
জাভি, ইনিয়েস্তা, বুসকেটস; পেপ গার্দিওলার নতুন বার্সেলোনা পাজলের
পারফেক্ট থ্রি পিস। পিভট রোলে বুসকেটস সামলাতেন প্রতিপক্ষের আক্রমণ, জাভি
সামলাতেন পুরো মাঝমাঠ, আর শেষমেশ ইনিয়েস্তার একটুখানি ম্যাজিক।
বার্সেলোনাকে সেরা ক্লাবের কাতারে তুলে আনতে এটুকুই যথেষ্ট। শুধু এটুকু
দিয়েই ইউরোপিয়ান জায়ান্টদের নাস্তানাবুদ করেছে বার্সেলোনা।
আর স্পেনে তো এক কাঠি সরেস। ভিসেন্তে দেল বস্কের দলের সঙ্গে যোগ
দিতেন জাবি আলানসো আর সেস্ক ফেব্রিগাস। দুই পাসমাস্টার নিজেদের গুণে যোগ
দিলে আর কী লাগে। স্পেনের ট্রফিবোর্ডের দিকে তাকালেই তো দিনের আলোর মতো
পরিষ্কার সেটা।
জাভি–ইনিয়েস্তা–বুসকেটস ছিলেন ইফেক্টিভ আর আর্টের মিশ্রণে তৈরি
মাঝমাঠের সম্ভবত শেষ সংস্করণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সুন্দর ফুটবলে ফল আসে না।
ব্রাজিলের ‘জাগো বনিতো’ মিইয়ে যাওয়ার পেছনের গল্পটাও ফল না আসা। আবার
রিয়ালের টানা তিন চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার গল্পে ‘ইফেক্টিভনেস’ ছিল, শিল্প
খুঁজে পাওয়া গেছে খুবই কম। সাফল্যের জন্য শিল্প ছেড়ে ইফেক্টিভনেসের পেছনে
ছোটা দোষের কিছু নয়, কিন্তু ট্রফির কাছে ফুটবল নিয়ে গল্প ফাঁদার আসর কমছে।
তাই পীড়া দেয় মাঝেমধ্যে।