Loading..

মুজিব শতবর্ষ

১৮ অক্টোবর, ২০২০ ০১:৪২ অপরাহ্ণ

শেখ রাসেল: একটি শৈশবের অপমৃত্যু.............
শেখ রাসেল বেদনার এক মহাকাব্যের নাম
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট শেখ রাসেল। দুই কন্যা, তিন পুত্র। কন্যা দুজন বেঁচে আছেন। একজন শেখ হাসিনা, অন্যজন শেখ রেহানা। শেখ হাসিনা এখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং কনিষ্ঠতম শেখ রাসেলকে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাবা-মায়ের সঙ্গেই।
একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে, যিনি আবার সেই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা-স্থপতি, সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করার নজির পৃথিবীতে বিরল। সরকারপ্রধান, রাষ্ট্রনেতা কিংবা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে প্রতিহিংসাবশত বা অন্য কোনো ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক বিবাদে হত্যা কিংবা গুপ্তহত্যার ঘটনা একাধিক ঘটেছে। কিন্তু রাষ্ট্রপিতাকে সপরিবার হত্যার ঘটনা বাংলাদেশেই ঘটেছে।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট এমন অনেককে হত্যা করা হয়েছে, যাদের কোনো রাজনীতি সংশ্লিষ্টতা ছিল না, যাদের বিরুদ্ধে ছিল না কোনো ধরনের অভিযোগ কিংবা তাদের কারও আবার অপরাধ সংঘটনেরও কোনো ক্ষমতা বা সুযোগ ছিল না। কিন্তু ঘাতক দল বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কাউকে মার্জনা করেনি, বিবেচনা করেনি কারও বয়স। ভাগ্যক্রমে দেশের বাইরে থাকায় জীবন রক্ষা পায় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা হাসিনা ও রেহানার।
বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল তখন মাত্র চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র, ১১ বছরের শিশু। তার চোখের সামনেই একে একে হত্যা করা হয়েছে বাবা, ভাই, ভাবিদের। মায়ের কাছে গিয়ে বাঁচার আকুতি জানিয়ে হতবিহ্বল রাসেল ঘাতকদের কাছে উপহার পেয়েছিল তপ্ত বুলেট এবং স্নেহময়ী জননীর রক্তাক্ত দেহ। সেদিন অমন নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলেও আকাশ ভেঙে পড়েনি কিংবা শিশু হত্যার বিক্ষোভে সেদিন কেঁপে ওঠেনি বসুন্ধরা। সব শিশুর বাসযোগ্য একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু তার জীবনের উজ্জ্বল সময়গুলো উৎসর্গ করেছেন, কিন্তু দেশ স্বাধীন করে নিজেকে জীবন দিতে হলো, এমনকি শিশু পুত্রের জীবনও রক্ষা করা গেল না। কিছু বিশ্বাসঘাতক প্রত্যক্ষভাবে হত্যাকাণ্ডে শরিক হলো, আর পুরো জাতি প্রতিবাদহীন নীরবতায় সব মেনে নিল।
যে জাতিকে অমিত সাহসে বলীয়ান করে তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতার মন্ত্রে করেছিলেন উজ্জীবিত, সেই জাতির এমন অসহায় আত্মসমর্পণ বড় কষ্ট এবং বেদনার।
১৮ অক্টোবর, শেখ রাসেলের জন্মদিন। ১৯৬৪ সালের এমন এক হেমন্তের মৃদু শিশিরস্নাত রাতে মুজিব দম্পতির ঘরে জন্ম হয়েছিল এক শিশুর। তার নাম রাখা হয়েছিল রাসেল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন পৃথিবীবিখ্যাত দার্শনিক-চিন্তাবিদ-শান্তি আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠক রার্ট্রান্ড রাসেলের ভক্ত। রাসেলের লেখা তিনি পড়তেন। রাসেলকে নিয়ে বেগম মুজিবের সঙ্গে আলোচনাও করতেন। বেগম মুজিব গৃহবধূ হয়েও যে প্রখর রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন হয়ে উঠেছিলেন, তার পেছনেও ছিল বঙ্গবন্ধুরই অবদান। বঙ্গবন্ধুর কাছে শুনেশুনে বেগম মুজিবও হয়ে উঠেছিলেন রাসেলভক্ত। আর সে কারণেই হয়তো কনিষ্ঠ সন্তানের নাম রেখেছিলেন রাসেল। মনে হয়তো প্রচ্ছন্ন আশা ছিল তাদের ছোট ছেলেটিও যদি বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো যশস্বী-মনস্বী হয়ে ওঠে।
সময়টা ছিল লড়াই আর যুদ্ধের উত্তেজনায় মুখর। ১৯৬৪ সাল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে চলেছে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ওই সময় সমগ্র পাকিস্তানজুড়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ডামাডোল। একদিকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান, অন্যদিকে সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতেমা জিন্নাহ। অনিশ্চয়তা আর অন্ধকারের মাঝেও এ অঞ্চলের মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছে।
যিনি এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটিয়ে বাঙালি জাতিকে এনে দেবেন মুক্তির স্বাদ, তার ঘর আলো করে জন্ম নিল এক ছোট্ট শিশু।
১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবরে ধানমন্ডির বিখ্যাত ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়িটি আলোকিত করে এলো শেখ রাসেল। রাসেলের যেদিন জন্ম হয় বঙ্গবন্ধু সেদিন ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে প্রচারণায় অংশগ্রহণের জন্য চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন।
সেই দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেজো ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেজো ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখব। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালোচুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড় সড় হয়েছিল রাসেল। ’
১৯৭৩ সালের ২৩ মে বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জুলিও কুরি শান্তি পদকে ভূষিত করে। শিশু রাসেলের জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে বাবাকে ছাড়াই। কারণ তার বাবা রাজনৈতিক বন্দী হয়ে কারাগারে ছিলেন দীর্ঘদিন।
বাবাকে দেখতে না পেয়ে মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে আব্বা বলে সম্বোধন করতেন রাসেল। এই চাপা কষ্ট যেমন অনুভব করতেন ছোট্ট শিশু রাসেল, ঠিক তেমনি তার বাবা শেখ মুজিবও। যা স্পষ্টত ফুটে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও।
১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনের পর থেকেই রাজবন্দী হিসেবে জেলে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কারাগারে দেখা করার সময় রাসেল কিছুতেই তার বাবাকে রেখে আসবে না। এ কারণেই তার মন খারাপ থাকত।
‘কারাগারের রোজনামচা’য় শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন ‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, আব্বা বাড়ি চলো। ’ কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দী। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো। ’ ও কি বুঝতে চায়! কী করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলে-মেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।
‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ের ২১ পৃষ্ঠায় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার বিষয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আব্বার সঙ্গে প্রতি ১৫ দিন পর আমরা দেখা করতে যেতাম। রাসেলকে নিয়ে গেলে ও আর আসতে চাইত না। খুবই কান্নাকাটি করত। ওকে বোঝানো হয়েছিল যে, আব্বার বাসা জেলখানা আর আমরা আব্বার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমরা বাসায় ফেরত যাব। বেশ কষ্ট করেই ওকে বাসায় ফিরিয়ে আনা হতো। আর আব্বার মনের অবস্থা কী হতো, তা আমরা বুঝতে পারতাম। বাসায় আব্বার জন্য কান্নাকাটি করলে মা ওকে বোঝাতেন এবং মাকে আব্বা বলে ডাকতে শেখাতেন। মাকেই আব্বা বলে ডাকত। '
শেখ রাসেল ছিলেন ভীষণ দুরন্ত। তার দুরন্তপনার সঙ্গী ছিল বাই-সাইকেল। তিনি রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ছাড়াই সাইকেলে করে স্কুলে যেতেন। পাড়ার আর দশজন সাধারণ ছেলের মতো।
বিখ্যাত সাংবাদিক এ বি এম মুসা স্মৃতিকথায় শেখ রাসেল সম্পর্কে লিখেছেন, ‘একদিন বিকেল পাঁচটার দিকে শাঁ করে ৩১ নম্বরের অপ্রশস্ত রাস্তা থেকে ৩২ নম্বরে ঢুকেই আমার সামনে একেবারে পপাতধরণিতল। গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল সদ্য শৈশবোত্তীর্ণ ছেলেটি। ...অতঃপর সাইকেলে উঠে লেকপাড়ে উধাও হলো শৈশবের শেষ প্রান্তের ছোট্ট ছেলেটি। ...বিকেলে লেকের পূর্বপাড়ে এমনি করে চক্কর মারত। মধ্যবর্তী ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পূর্ব প্রান্তের সাদা একটি দালান পর্যন্ত সাইকেলারোহীর দৌড়ানোর সীমানা। ...এদিকে ৩২ নম্বরের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন স্নেহময়ী মা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন দুষ্টু ছেলেটির সাইকেল-পরিক্রমা যেন সীমাবদ্ধ থাকে। ’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মাত্র ১১ বছর বয়সে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে ঘাতকদের হাতে হত্যার নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তিনি। পৃথিবীতে যুগে যুগে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে কিন্তু এমন নির্মম, নিষ্ঠুর এবং পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড কোথাও ঘটেনি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে রাসেলকে নিয়ে পালানোর সময় ব্যক্তিগত কর্মচারীসহ তাকে আটক করা হয়।
আতঙ্কিত হয়ে শিশু রাসেল কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, ‘আমি মায়ের কাছে যাব’। পরবর্তী সময়ে মায়ের লাশ দেখার পর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মিনতি করেছিলেন ‘আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) কাছে পাঠিয়ে দিন’।
‘মা, বাবা, দুই ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, চাচা সবার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে সবার শেষে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল রাসেলকে। ওই ছোট্ট বুকটা কি তখন ব্যথায় কষ্টে বেদনায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। যাদের সান্নিধ্যে স্নেহ-আদরে হেসে খেলে বড় হয়েছে তাদের নিথর দেহগুলো পড়ে থাকতে দেখে ওর মনের কী অবস্থা হয়েছিল- কী কষ্টই না ও পেয়েছিল!!’
রাসেল স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবের ছেলে এটাই হয়তো ছিল তার একমাত্র এবং সবচেয়ে বড় অপরাধ। এ প্রসঙ্গে শিশু রাসেল-কে নিয়ে লেখা দুই বাংলার বিখ্যাত কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিশু রক্ত’ কবিতাটি খুব মনে পড়ছে-
‘তুইতো গল্পের বই, খেলনা নিয়ে
সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন বয়সেতে ছিলি!
তবুও পৃথিবী আজ এমন পিশাচি হলো
শিশুরক্তপানে তার গ্লানি নেই?
সর্বনাশী, আমার ধিক্কার নে!
যত নামহীন শিশু যেখানেই ঝরে যায়
আমি ক্ষমা চাই, আমি সভ্যতার নামে ক্ষমা চাই। ’
শেখ হাসিনার আদর-স্নেহেই বড় হয়ে উঠছিল রাসেল। এই ভাইটিকে হারানোর দুঃসহ বেদনা যে ভোলার নয়! এই দুঃখ ভার বুকে নিয়ে, উদ্‌গত কান্না চেপে দেশ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে তাকে। শেখ রাসেল আমাদের কাছে বেদনার এক মহাকাব্যের নাম। শেখ রাসেলের জন্মদিনে আমাদের অঙ্গীকার হোক, আর অসহিষ্ণুতা নয়, আর অপরাধীদের প্রশ্রয় বা দায়মুক্তি নয়। বাংলাদেশ হোক সব শিশুর, সব মানুষের নিরাপদ বাসভূমি। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।(Copied)

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি