
সহকারী শিক্ষক

১৬ মে, ২০২৫ ০৬:৫৪ পূর্বাহ্ণ
সহকারী শিক্ষক
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক অগ্রগতি সত্ত্বেও গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া ও অনুপস্থিতি এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার অবৈতনিক পাঠদান, উপবৃত্তি, স্কুল ফিডিংসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করলেও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। এই সমস্যার পেছনে রয়েছে বহুস্তরীয় কারণ—দারিদ্র্য, অসচেতনতা, নৈতিক শিক্ষার অভাব, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, আত্ম-অহমিকা, অর্থকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও দিকনির্দেশনার ঘাটতি ইত্যাদি।
এই প্রবন্ধে গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতি ও ঝরে পড়ার কারণসমূহ বিশ্লেষণ করা হবে এবং বাস্তবমুখী সমাধান প্রদান করা হবে। উদাহরণ হিসেবে সৈয়দ কুতুব জালাল মডেল হাইস্কুলে গৃহীত একজন শিক্ষকের উদ্ভাবনী পদক্ষেপও উপস্থাপন করা হবে।
*ঝরে পড়া ও অনুপস্থিতির মূল কারণসমূহ*
*১. দারিদ্র্য ও জীবিকার চাপে পড়াশোনার ব্যাঘাত*
বাংলাদেশের বহু গ্রামে পরিবারগুলো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। শিশুরা বিদ্যালয়ে যাওয়ার পরিবর্তে ক্ষেতখামারে কাজ করে বা গৃহস্থালির কাজে লিপ্ত হয়। এমনকি অনেক কিশোরকে দেখা যায় স্থানীয় দোকান বা প্রবাসীদের পাঠানো টাকায় খোলা ব্যবসায় সাহায্য করতে।
*২. অসচেতন অভিভাবক**
গ্রামীণ অনেক অভিভাবক এখনো শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেন না। তাদের দৃষ্টিতে ছেলে-মেয়ের সংসার বা জীবিকা অর্জনের প্রস্তুতি বেশি জরুরি। বিশেষ করে কন্যাশিশুদের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা আরও প্রবল। এক পর্যায়ে মেয়েদের বিদ্যালয় থেকে তুলে এনে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেওয়া হয়।
*৩. নৈতিক শিক্ষার অভাব*
শুধু পাঠ্যপুস্তক মুখস্থ করিয়ে পরীক্ষা পাস করানো নয়, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তিত্ব গঠন ও মূল্যবোধ তৈরি। কিন্তু বর্তমান পাঠ্যক্রম ও শিক্ষার পরিবেশে নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে দায়িত্ববোধ, আত্মশৃঙ্খলা ও অধ্যবসায় গড়ে উঠছে না।
*৪. অর্থকেন্দ্রিক মানসিকতা ও আত্ম-অহমিকা*
গ্রামের অনেক পরিবার আজ অর্থ-সম্পদকেই সর্বোচ্চ মূল্য দিচ্ছে। অর্থ উপার্জনের সাথে সম্পর্কিত কাজকেই তারা “বাস্তব” মনে করে, আর বিদ্যালয়কে মনে করে সময়ের অপচয়। কিছু পরিবারের মধ্যে এমন মানসিকতা গড়ে উঠেছে যে, “বিদেশ যাওয়া বা ব্যবসা করলেই চলবে, পড়াশোনার দরকার নেই।” আবার কিছু শিক্ষার্থী নিজেরাই অহংকারী হয়ে পড়ে—মনে করে তারা ‘সব জানে’, বিদ্যালয় আর তাদের কিছু দিতে পারবে না। এই ইগো বা আত্ম-অহমিকা তাদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
*৫. পারিবারিক সমস্যা ও একক মাতৃত্ব**
যেসব পরিবারের পিতা প্রবাসী, সেখানে মায়েরা একা সন্তানদের নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খায়। আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পিতার উপস্থিতি অনেক সময় সন্তানকে শাসন ও অনুপ্রেরণার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখে। পিতা না থাকলে মা সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে পারলেও সন্তানের অনুপস্থিতি ঠেকাতে পারেন না। এক্ষেত্রে পারিবারিক অসঙ্গতি, বিচ্ছিন্নতা, এবং যোগাযোগের অভাব শিক্ষার্থীর মনোযোগ বিচ্যুতি ঘটায়।
*৬. শিক্ষকদের দিকনির্দেশনার অভাব*
অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা শুধু পাঠদানেই সীমাবদ্ধ থাকেন; শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি, মনোযোগ বা পারিবারিক প্রেক্ষাপট বোঝার চেষ্টা করেন না। ফলে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের সনাক্তকরণ ও পুনরায় একীভূত করার প্রক্রিয়ায় বড় ফাঁক থেকে যায়।
*বাস্তব উদাহরণ: সৈয়দ কুতুব জালাল মডেল হাইস্কুলে একটি ব্যতিক্রমী প্রয়াস*
নবম শ্রেণির ‘ক’ শাখার শ্রেণি শিক্ষক হিসেবে আমি লক্ষ্য করি, ৫০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে গড়ে ১২ থেকে ১৫ জন প্রতিদিন অনুপস্থিত থাকে। প্রথমে এটিকে আমি সাধারণ বিষয় মনে করলেও পরে বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখি—এই অনুপস্থিতি একটি ধারাবাহিক সমস্যা।
আমি শিক্ষার্থীদের এলাকা অনুযায়ী ৬টি গ্রুপে ভাগ করি এবং প্রতিটি গ্রুপকে দায়িত্ব দেই অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের বাসায় গিয়ে কারণ অনুসন্ধান করতে। তারা হাতে-লিখে প্রতিবেদন জমা দেয়, ফোন নম্বর সংগ্রহ করে দেয় এবং শিক্ষার্থীর পরিবারের অবস্থা সম্পর্কে তথ্য দেয়।
এই প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ উঠে আসে—মেয়েশিক্ষার্থীরা ছেলেদের তুলনায় অনেক বেশি নিয়মিত, মনোযোগী ও দায়িত্বশীল। তারা কেবল উপস্থিতিতেই নয়, বরং ক্লাসে ভালো ফল করছে, বাড়ির কাজ নিয়মিত করে আনছে এবং শৃঙ্খলার দিক থেকেও এগিয়ে রয়েছে। গ্রুপভিত্তিক কার্যক্রমেও মেয়েরা নেতৃত্ব দিয়েছে এবং বন্ধুদের স্কুলে ফেরাতে আন্তরিকভাবে কাজ করেছে। অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগেও মেয়েরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।
এছাড়া দেখা যায়, অধিকাংশ অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর পিতা প্রবাসে। মা একা সন্তানের শৃঙ্খলা ও মনোভাব নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকে বলেন, “বাবার কথা শুনে, আমার কথা শুনে না।” কিছু ক্ষেত্রে পারিবারিক কলহ, দারিদ্র্য ও অশিক্ষা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
পরবর্তীতে আমি নিজেই অভিভাবকদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ শুরু করি, মেয়েদের সচেতনতাকে উৎসাহিত করি, স্কুলে নৈতিক শিক্ষা বিষয়ক কনটেন্ট চালু করি এবং মাসিক উপস্থিতি মনিটরিং শুরু করি। কয়েক মাসের মধ্যেই অনুপস্থিতির হার অর্ধেকে নেমে আসে।
*সমাধানের পথ ও *করণীয়*
*১. দারিদ্র্য নিরসনে সামাজিক উদ্যোগ**
সরকারি সহায়তার পাশাপাশি স্থানীয় সম্পদবান ব্যক্তি, প্রবাসী সমাজ এবং এনজিওদের নিয়ে একটি তহবিল গঠন করে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা দেওয়া যেতে পারে। স্কুলভিত্তিক ‘অপশনাল ফান্ড’ চালু করে টিফিন, ইউনিফর্ম ও খাতা-কলম নিশ্চিত করতে হবে।
*২. অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি*
প্রতি মাসে অভিভাবক সমাবেশ আয়োজন করে শিশুদের শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মায়েদের জন্য বিশেষ সচেতনতামূলক ক্লাস চালু করা যেতে পারে—যেখানে মায়ের দায়িত্ব, ছেলেমেয়ের মনস্তত্ত্ব, এবং ঘরে পড়ালেখার পরিবেশ তৈরির ওপর দিকনির্দেশনা থাকবে।
*৩. নৈতিক শিক্ষা চালু ও পুনর্গঠন*
প্রতিটি সপ্তাহে কমপক্ষে একদিন নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধভিত্তিক কার্যক্রম যেমন—কুইজ, বিতর্ক, গল্প বলা, নাটক—আয়োজন করতে হবে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দায়িত্ববোধ, সহানুভূতি ও আত্মশুদ্ধি তৈরি হবে।
*৪. *শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং ও পিয়ার গাইডেন্স*
যেসব শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকে বা পড়াশোনায় পিছিয়ে থাকে, তাদের জন্য ‘পিয়ার গাইড’ নিয়োগ করা যেতে পারে। মানে সহপাঠীদের মধ্য থেকে কিছু শিক্ষার্থী নির্বাচন করে তাদের দায়িত্ব দেওয়া—পিছিয়ে পড়া বন্ধুর পাশে দাঁড়ানোর। এটি শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাস বাড়াবে এবং বন্ধু-বন্ধুর মধ্যে সহানুভূতির সম্পর্ক গড়ে তুলবে।
*৫. শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও দিকনির্দেশনা*
শিক্ষকদের শুধু পাঠদানের দক্ষতা নয়, শিক্ষার্থীদের আচরণ, মনস্তত্ত্ব, ও সামাজিক বাস্তবতা বুঝতে পারার দক্ষতা বাড়াতে হবে। প্রত্যেক শ্রেণি শিক্ষকের উচিত তার শিক্ষার্থীদের সামাজিক প্রেক্ষাপট ও পরিবারের অবস্থান সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ফাইল রাখা। এই ফাইলের ভিত্তিতে শিক্ষক প্রয়োজনমতো কাউন্সেলিং বা বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন।
*৬. প্রযুক্তির সহায়তা*
আজকের যুগে প্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি মনিটরিং করা সম্ভব। যেমন: ডিজিটাল অ্যাটেনডেন্স, এসএমএস বা অ্যাপের মাধ্যমে অভিভাবকদের জানিয়ে দেওয়া—“আপনার সন্তান আজ স্কুলে আসেনি।” এতে সচেতনতা বাড়বে এবং অভিভাবকও দায়িত্বশীল হবেন।
গ্রামীণ বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া ও অনুপস্থিতি কোনো একক কারণের ফল নয়, বরং এটি একটি বহুমাত্রিক সামাজিক সংকট। এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব শুধুমাত্র সম্মিলিত উদ্যোগ, সচেতনতা বৃদ্ধি, এবং সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতির মাধ্যমে। সৈয়দ কুতুব জালাল মডেল হাইস্কুলের উদাহরণটি প্রমাণ করে—যদি শিক্ষক নিজে দায়িত্বশীল হন এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের পথে এগিয়ে যান, তবে ফলাফল ইতিবাচক হয়।
শিক্ষা হলো জাতির মেরুদণ্ড—এই মেরুদণ্ড শক্তিশালী করতে হলে আমাদের প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ, নৈতিকতার পুনর্জাগরণ এবং শিক্ষক-অভিভাবক-শিক্ষার্থী এই ত্রিমাত্রিক সম্পর্কের সঠিক সংহতি।
৫৫
১০৭ মন্তব্য